যুব সমাজ ও নৈতিকতা: ইসলামের ভূমিকা

যুবসমাজ হল একটি জাতির ভবিষ্যৎ। তাদের আদর্শ, নৈতিকতা ও চরিত্রই নির্ধারণ করে একটি সমাজ ও জাতির উন্নতি বা অবনতি। বর্তমান যুগে নৈতিক অবনয়ন, অশ্লীলতা ও বিভ্রান্তির মাঝে যুবকদের সঠিক পথ দেখানো অত্যন্ত জরুরি। ইসলাম আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে, বিশেষ করে যুব সমাজের নৈতিক উন্নয়নের জন্য ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাগুলো রয়েছে। আজকের এই ডিজিটাল যুগে ইনস্টাগ্রাম, টিকটক এবং এ জাতীয় সফট পর্ন অ্যাপ্লিকেশনগুলো অশ্লীলতা, নির্লজ্জতা এবং নৈতিক অবক্ষয়ের আঁতুড়ঘরে পরিণত হয়েছে। যা একসময় লজ্জাজনক ও গর্হিত বলে বিবেচিত হতো, তা এখন "এক্সপ্রেশনের স্বাধীনতা" বা "দেহ-পজিটিভিটির" নামে বৈধতা পাচ্ছে। গালাগালি, অর্ধনগ্নতা ও যৌন উত্তেজক কনটেন্ট এখন আর ইন্টারনেটের গোপন কোনে সীমাবদ্ধ নেই, বরং মূলধারার সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মেই এগুলোকে বিনোদনের নামে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।

দুঃখজনকভাবে, অনেক মুসলিম যুবক-যুবতী—সচেতনতা কিংবা আত্মজ্ঞানহীনতার কারণে—এই ডিজিটাল দূষণের শিকার হয়ে পড়ছে। যে সময়টা আগে কুরআন, জ্ঞান অর্জন, পরিবার বা উম্মাহর সেবায় ব্যয় হতো, তা এখন অশালীন রিল ও ভিডিও স্ক্রল করতে করতেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই প্ল্যাটফর্মগুলো মানুষের মনোজগতকে প্রভাবিত করে, মনোযোগ কমিয়ে দেয়, এবং এমন জিনিসকে স্বাভাবিক করে তোলে যা আদতে চরমভাবে অনৈসলামিক। কৌতূহল থেকে শুরু হয়ে এই জিনিসগুলো অল্প সময়েই আসক্তিতে পরিণত হয়—যা আত্মাকে দূষিত করে এবং আল্লাহ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:

أَبْغَضُ النَّاسِ إِلَى اللَّهِ الْفَاحِشُ الْبَذِيءُ
“আল্লাহর কাছে সবচেয়ে অপছন্দনীয় ব্যক্তি হলো সেই ব্যক্তি, যে অভদ্র ও নির্লজ্জ।” (তিরমিযি)
এই হাদীস আমাদের সতর্ক করার জন্য যথেষ্ট হওয়া উচিত।

যুবকদের নৈতিক গঠনে ইসলাম

যুবকদের চরিত্র গঠনে আল্লাহর ভয় (তাকওয়া) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য সৎপথে চলা এবং পাপ থেকে বিরত থাকা ইসলামের অন্যতম শিক্ষা। কুরআনে আল্লাহ বলেন—

يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُم مِّن ذَكَرٍ وَأُنثَىٰ وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا ۚ إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِندَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ ۚ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ

"হে মানব, আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিতি হও। নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত যে সর্বাধিক পরহেযগার। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবকিছুর খবর রাখেন।" (সূরা আল-হুজুরাত: ১৩)

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—

إِنَّ مِنْ خِيَارِكُمْ أَحْسَنَكُمْ أَخْلَاقًا

"তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সে, যার চরিত্র উত্তম।" (বুখারি)

তাই যুবকদের উচিত সদাচার, সততা, ভদ্রতা ও শিষ্টাচার রক্ষা করা।

অশ্লীলতা ও পাপ থেকে দূরে থাকা

বর্তমান সমাজে অশ্লীলতা, মাদকাসক্তি ও অনৈতিক কাজগুলো যুবকদের নৈতিক অবনয়ের অন্যতম কারণ। ইসলাম কঠোরভাবে এগুলো নিষেধ করেছে।

"ব্যভিচারের নিকটেও যেয়ো না। নিশ্চয়ই এটি একটি অশ্লীল কাজ ও মন্দ পথ।" (সূরা আল-ইসরা: ৩২)

সুতরাং যুবকদের উচিত অশ্লীলতা, মাদক ও অপসংস্কৃতি থেকে দূরে থাকা ও আত্মগঠন করা।

ইসলামে আদর্শ যুবকদের উদাহরণ

ইসলামের ইতিহাসে বহু যুবকের দৃষ্টান্ত রয়েছে, যারা তাদের নৈতিকতা, সাহস ও ধর্মপরায়ণতার জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন। হযরত ইউসুফ (আ.): তিনি নারীর প্রলোভন থেকে বেঁচে আল্লাহর পথে অটল ছিলেন। আসহাবে কাহাফ: তারা সত্যের পথে থেকে অত্যাচারী শাসকের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। হযরত আলী (রা.) : রাসূল (সা.)-এর অন্যতম সঙ্গী, যিনি তার চরিত্র ও জ্ঞানের জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন।

সালাহউদ্দিন আইয়ুবি ও যুবসমাজের আদর্শ

ভেবে দেখো, সালাহউদ্দিন আইয়ুবি—আল কুদস বিজয়ী মহান নেতা—যখন মুসলিমদের বিনোদন, বিশৃঙ্খলা ও নৈতিক দুর্বলতায় নিমজ্জিত হতে দেখলেন, তখন তিনি বলেছিলেন, “আমিও ইচ্ছা করলে আমোদ-প্রমোদে জীবন কাটাতে পারতাম, কিন্তু আমি তা ত্যাগ করেছি কারণ দেখেছি এগুলো মানুষকে বড় লক্ষ্যের কথা ভুলিয়ে দেয়।”

তিনি এমন এক প্রজন্ম গড়ে তুলেছিলেন যারা দুনিয়ার বিলাসিতায় নয়, বরং আল্লাহর পথে কাজ করতে ও সত্যের পক্ষে দাঁড়াতে নিজেদের প্রস্তুত করেছিল।

তিনি আরও এক ঐতিহাসিক সতর্কবার্তা দিয়ে গিয়েছেন:

“কোন জাতিকে যুদ্ধ ছাড়াই ধ্বংস করতে চাইলে, সেই জাতির যুবসমাজের মধ্যে অশ্লীলতা ও নগ্নতা ছড়িয়ে দাও।”

এটি কোনো সাধারণ মন্তব্য নয়—এটি ছিল একটি কৌশল, যা তিনি বুঝেছিলেন মুসলিম সমাজকে ভিতর থেকে দুর্বল করে দেওয়ার একটি পদ্ধতি। আজকে আমরা সেই কৌশল বাস্তবে দেখছি—সোশ্যাল মিডিয়া অ্যালগরিদমের মাধ্যমে অশ্লীলতা তরুণদের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাচ্ছে, তরবারির মাধ্যমে নয়, বরং স্ক্রিন ও নোটিফিকেশনের মাধ্যমে।

সালাহউদ্দিন আইয়ুবির বিজয় কোনো গাফেল ও বিভ্রান্ত প্রজন্মের দ্বারা সম্ভব হয়নি, বরং এমন এক তরুণ প্রজন্মের দ্বারা হয়েছিল যারা সংযম, লজ্জাশীলতা ও তাকওয়ায় লালিত ছিল। আমরা কী ধরনের প্রজন্ম হতে চাই? যে প্রজন্ম স্ক্রলে ব্যস্ত, যখন আল আকসা আক্রান্ত আর উম্মাহ রক্তাক্ত?

বাস্তব পরিণতি

কুরআনে আল্লাহ বলেন:

قُل لِّلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا۟ مِنْ أَبْصَـٰرِهِمْ وَيَحْفَظُوا۟ فُرُوجَهُمْ ۚ ذَٰلِكَ أَزْكَىٰ لَهُمْ ۗ إِنَّ ٱللَّهَ خَبِيرٌۢ بِمَا يَصْنَعُونَ

“মুমিন পুরুষদের বলো, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নিচু করে এবং নিজেদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে; এটা তাদের জন্য অধিক পবিত্র। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের কর্ম সম্বন্ধে অবগত।” (সূরা আন-নূর: ৩০)

হারামের দিকে বারবার তাকানো ধীরে ধীরে ঈমানকে ক্ষয় করে, মানসিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে, সম্পর্ক ধ্বংস করে দেয় এবং এমনকি সালাতে মনোযোগ নষ্ট করে। আজ অনেক তরুণ-তরুণী বিষণ্নতা, একাকীত্ব ও নেশায় ভুগছে—হৃদয় যদি অন্ধকারে ভরে যায়, আলোর প্রবেশ কীভাবে সম্ভব?

সুস্থ সমাজ গঠনে যুব সমাজের করণীয়

সৎ ও নৈতিক জীবনযাপন, নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত ও ইসলামী শিক্ষা অর্জন, অনৈতিক কাজ ও মন্দ সঙ্গ পরিহার করা, পরোপকারী ও সমাজসেবক হওয়া, সঠিক নেতৃত্ব ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা। এছাড়াও আরো দৃঢ় কিছু পদক্ষেপগুলি হলো:

১. অশালীন কনটেন্ট ছড়ানো অ্যাকাউন্ট বা অ্যাপ আনফলো, ব্লক এবং ডিলিট করো।

২. হারাম কনটেন্টের পরিবর্তে ইসলামিক স্মরণিকা, কুরআন তিলাওয়াত ও জ্ঞানমূলক কনটেন্টে মনোযোগ দাও।

৩. অনলাইন ও অফলাইনে নেক সঙ্গী বেছে নাও।

৪. সালাহউদ্দিন আইয়ুবিকে স্মরণ করো—তাঁর মতো একজন উদ্দীপক আদর্শ হোন, যারা উম্মাহকে জাগ্রত করেছিল।

কিয়ামতের দিনে আমরা যেন এমনদের দলে না পড়ি, যারা প্রতিটি স্ক্রল, ক্লিক ও দৃষ্টির জন্য অনুতপ্ত হবে। বরং আমরা যেন সেই যুবকদের অন্তর্ভুক্ত হই, যাদের প্রশংসা করে রাসূল ﷺ বলেছেন:

“সাত শ্রেণির মানুষ কিয়ামতের দিনে আরশের ছায়ায় থাকবে... তাদের একজন হল সেই যুবক, যে তার যৌবনকাল তার প্রভুর ইবাদতে কাটিয়েছে।” (বুখারী ও মুসলিম)

আজকের যুদ্ধ শুধু রণাঙ্গনে নয়—এটি তোমার মোবাইলের ভিতরে, তোমার স্ক্রিনে, এবং তোমার অন্তরে। তাই বেছে নাও—আল্লাহর পথ, না শয়তানের ফাঁদ।

উপসংহার

যুব সমাজ যদি ইসলামের নির্দেশনা অনুসরণ করে, তাহলে তারা নিজেদের নৈতিক ও আত্মিক উন্নতি অর্জন করতে পারবে এবং সমাজে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারবে। ইসলামের মূল শিক্ষা হলো ন্যায়পরায়ণতা, সৎ চরিত্র ও উন্নত নৈতিক গুণাবলি অর্জন করা। তাই প্রতিটি যুবকের উচিত ইসলামের আলোকে জীবন পরিচালনা করা এবং সমাজে শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। আল্লাহ আমাদের সকলকে নৈতিক ও আদর্শ যুবক হিসেবে গড়ে তুলুন। আমিন।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter