কুরআন ও হাদিসের আলোকে এতিম প্রতিপালন
ভূমিকাঃ-
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধানের নাম, যা পূর্ণ রূপে ইসলামের মূলনীতি, চিন্তা-চেতনা ও দ্বীনের দৃষ্টান্তমূলক নমুনার উপর ভিত্তিশীল, যার মধ্যে দুনিয়া ও আখেরাত, আসমান ও জমিন, শাসক ও শাসিত, নারী ও পুরুষ, গরীব ও ধনী এবং বংশ ও সমাজের যাবতীয় বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সামাজিক জীবনে ছোট-বড় সব বিষয় এবং যাবতীয় আইন-কানুনের উৎস একমাত্র ইসলামি শরিয়ত।
এতিম সমাজেরই একজন। সে ছোট অবস্থায় তার বাবাকে হারিয়েছে, হারিয়েছে তার রক্ষণাবেক্ষণকারী ও পথ প্রদর্শনকারীকে। এজন্য তার বিশেষ প্রয়োজন এমন একজন ব্যক্তির যে তার খরচ যোগাবে, দেখাশোনা করবে, তার সাথে ভাল ব্যবহার করবে, তাকে নসিহত করবে, উপদেশ দিবে এবং সৎ পথ প্রদর্শন করবে। যাতে সে মানুষের মত মানুষ হতে পারে, পরিবারের জন্য কল্যাণকর কর্মী এবং সমাজের জন্য দরদী ও উপকারী হতে পারে। আর যদি এতিমের প্রতি অবহেলা করা হয়। দায়িত্ব না নিয়ে তার অবস্থার উপর ছেড়ে দেওয়া হয়। তার যদি কোনো পথ প্রদর্শক ও রক্ষণাবেক্ষণকারী না থাকে, তাহলে সে বিপথগামী হয়ে যেতে পারে। পরিশেষে সমাজের বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে। আর সেক্ষেত্রে এসমাজই দায়ী হবে। কেননা তার হক আদায়ের ব্যাপারে সমাজ অবহেলা করেছে এবং দায়িত্ব পালনে কমতি করেছে। তাই এতিম প্রতিপালন বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সমাজ ও জাতির ভবিষ্যৎ সুখ শান্তিময় হওয়া এ বিষয়ের উপর নির্ভরশীল।
এতিম কে?
এতিম শব্দটি আরবি, যার অর্থ নিঃসঙ্গ। ইবনু মঞ্জুর লিসানুল আরব অভিধানে বর্ণনা করেছেন, এতিম এমন বাচ্চাকে বলা হয় যার পিতা মারা গিয়েছে, বালেগ হওয়া অবধি সে এতিম বলে গণ্য হবে, বালেগ হবার পর এতিম নামটি তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। আর মেয়ে বাচ্চা বিয়ের পূর্ব পর্যন্ত এতিম বলে গণ্য হবে, বিয়ের পর তাকে আর এতিম বলা যাবে না।
মহা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ “বালেগ হওয়ার পর আর কেউ এতিম থাকে না”। (মেশকাতঃ পৃষ্ঠা নং ২৮৪)
লিসানুল আরবে আরো বর্ণিত আছে যে, মানুষের মধ্যে এতিম হয় পিতার পক্ষ থেকে আর চতুষ্পদ জন্তুর মধ্যে এতিম হয় মায়ের পক্ষ থেকে। যে সন্তানের বাল্য কালে তার মাতা মারা যায়, কিন্তু পিতা বেঁচে থাকে তাকে এতিম বলা হবে না।
এতিম প্রতিপালনের ফজিলতঃ-
আল্লাহ তাআলার প্রিয় হাবিব, আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাতৃ গর্ভে থাকা অবস্থায় তাঁর পিতা আব্দুল্লা হইন্তেকাল করেন এবং ছয় বছর বয়সে মা আমিনা কেও হারান। তারপর তাঁর লালন পালনের দায়িত্ব নিলেন দাদা আব্দুল মুত্তালিব। কিন্তু তিনিও মাত্র দু-বছর পর এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। সে হিসেবে তিনি ছিলেন সর্বদিক দিয়েই এতিম। তাই আল্লাহ তাআলা বলেন, “তিনি কি আপনাকে এতিম রূপে পাননি? অতঃপর আশ্রয় দিয়েছেন। তিনি আপনাকে পেয়েছেন পথহারা, অতঃপর পথ প্রদর্শন করেছেন। আপনাকে পেয়েছেন নিঃস্ব, অতঃপর অভাব মুক্ত করেছেন। সুতরাং আপনি এতিমের প্রতি কঠোর হবেন না”। (সুরা দুহাঃ ৬-৯)
এক দিকে সর্ব শ্রেষ্ঠ নবী ছিলেন এতিম, অপর দিকে এতিমরা হচ্ছে সমাজের সবচেয়ে দুর্বল ও অসহায়। তাই তাদের প্রতি আল্লাহর করুনা ও রহমত রয়েছে, বিধায় পবিত্র কোরআন ও হাদিসে এতিম প্রতিপালনের বিশেষ ফজিলত রয়েছে।
১) এতিম প্রতিপালনে জান্নাতের উচ্চাসন লাভ হয়ঃ-
যেমন, সাহল বিন সা’দ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমি ও এতিম প্রতিপালনকারী জান্নাতে এভাবে থাকব। তিনি তর্জনী ও মধ্য আঙ্গুল দিয়ে ইঙ্গিত করলেন এবং এ দুটির মধ্যে ফাক করলেন। (বুখারি)
উক্ত হাদিসে এটাই প্রতীয়মান হয়, যে ব্যক্তি জান্নাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথী হতে চায় সে যেন এই হাদিসের উপর আমল করে এবং এতিম প্রতিপালনের প্রতি ব্রতী হয়। সার্বিক দিক থেকে তার প্রতি গুরুত্ব দেয়। কারণ আখেরাতে এর চেয়ে উত্তম আর কোনো স্থান হতে পারে না।
২) এতিম প্রতিপালনে রিজিক প্রশস্ত হয় এবং রহমত ও বরকত নাজিল হয়:-
যেমন, আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বর্ণনা করেছেন, মুসলিমদের ওই বাড়িই সর্বোত্তম যে বাড়ীতে এতিম রয়েছে এবং তার সাথে ভাল ব্যবহার করা হয়। সব চেয়ে নিকৃষ্ট ওই বাড়ী যে বাড়ীতে এতিম আছে, অথচ তার সাথে খারাপ ব্যবহার করা হয়। অতঃপর তিনি তার আঙ্গুলের মাধ্যমে বললেন, আমি এবং এতিম প্রতিপালনকারী জান্নাতে এমন ভাবে অবস্থান করব। (ইবনে মাজাহ)
৩) এতিম প্রতিপালনে হৃদয় নম্র হয়:-
যেমন, আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে তার অন্তর কঠিন মর্মে অভিযোগ করল। তিনি তাকে বললেন, যদি তুমি তোমার হৃদয় নরম করতে চাও তাহলে দরিদ্রকে খানা খাওয়াও এবং এতিমের মাথায় হাত বুলিয়ে দাও। (মুসনাদে আহমাদ: ২/৩৮৭)
৪) এতিম প্রতিপালন ও তাদের প্রতি সদয় হওয়ায় অত্যাধিক সওয়াব হাসিল হয়:-
যেমন, আবু উমামা (রা:) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো ছেলে অথবা মেয়ে এতিমের মাথায় একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে হাত বুলিয়ে দেয়, মাথায় যত চুল দিয়ে তার হাতটি অতিক্রম করবে তার তত সওয়াব অর্জিত হবে। আর এতিমের প্রতি সে যদি ভাল ব্যবহার করে তাহলে এই দুই আঙ্গুলের ন্যায় সে এবং আমি জান্নাতে অবস্থান করব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর দুই আঙ্গুলকে মিলিয়ে দেখালেন। (মুসনাদে আহমাদ)
এতিমের সম্পদ ভক্ষণকারীর শাস্তি :-
এতিমের সম্পদে অবৈধ ক্ষমতা প্রয়োগকারীদের জন্য ভীষণ শাস্তির হুমকি রয়েছে, মহান আল্লাহ তাআলা বলেন:- “নিশ্চয় যারা এতিমদের ধন-সম্পদ অন্যায় ভাবে ভক্ষণ করে তারাতো তাদের পেটে আগুন খাচ্ছে, আর অচিরেই তারা প্রজ্বলিত আগুনে প্রবেশ করবে”। (সুরানিসা : ১০)
জাহেলি যুগে মানুষেরা এতিমদের ধন-সম্পদ থেকে উপকার হাসিলের মধ্যে সীমালঙ্ঘন করত। এমনকি সম্পদের লোভে কখনো বিয়ে করত অথবা সম্পদ যাতে হাত ছাড়া না হয়ে যায় সে জন্য নিজের ছেলেকে দিয়ে বিয়ে করাতো এবং বিভিন্ন পন্থায় তাদের সম্পদ ভক্ষনের চেষ্টা করত। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাদেরই ব্যাপারে উপরোক্ত আয়াতটি নাযিল করেন।
এই আয়াতের পরিপ্রেক্ষিতে ইবনে জাবির (রহঃ) বলেন, “এতিমের মাল অন্যায় ভাবে ভক্ষণকারী কিয়ামতের দিন এমতাবস্থায় উত্থিত হবে যে, তার পেটের ভিতর থেকে আগুনের লেলিহান শিখা মুখ, দুই কান, নাক ও দুই চক্ষু দিয়ে বের হতে থাকবে। যেই তাকে দেখবে সে চিনতে পারবে যে, এ হচ্ছে এতিমের মাল ভক্ষণকারী। (ইবনে কাসীর)
উপসংহার:-
এতিম প্রতিপালন নিঃসন্দেহে এমন কাজ যার দ্বারা দুনিয়া-আখিরাত দুই উভয় জগতের যাবতীয় কল্যাণ সাধন হয়। সন্তষ্টি পাওয়া যায় মহিম আল্লাহ তাআলার। তাছাড়াও বহু কুরআনের আয়াত ও প্রিয় রাসূলের হাদিস দ্বারা প্রমাণিত যে, এতিম প্রতিপালনে কত ফযিলত আছে। তার সাথে সাথে এতিমের ঠিকভাবে দেখাশোনা না করলে কি ভয়ঙ্কর শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে তাও কুরআন ও হাদিসে উল্লেখ করে দিয়েছে। তবে চিন্তার বিষয়তো এই যে, বর্তমানে আমরা কুরআন ও হাদিসকে এড়িয়ে চলে থাকি। ধীরে ধীরে দুনিয়ার দিকে ধাবিত হচ্ছি। অথচ আমরা সকলেই জ্ঞাত যে এই দুনিয়া চিরস্তর নই। তাই আমাদের সকলের ঈমানি ও নৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে এ বিষয়ে সচেষ্ট হয়ে উভয় জগতের সফলতা অর্জন করা এবং এতিম প্রতিপালনের মতো বরকতপূর্ণ কর্ম হাত ছাড়া না করা।