সব ধর্ম কি এক?—ইসলামের দৃষ্টিতে পারেনিয়ালিজমের চ্যালেঞ্জ ও সত্যপথের সন্ধান
আধুনিক বিশ্বে ধর্মীয় সহনশীলতা, বহুত্ববাদ, এবং আন্তঃধর্মীয় সংলাপের উপর জোর অনেক বেড়েছে। বহু দেশেই মানুষ এখন নিজ নিজ ধর্মের চর্চার পাশাপাশি অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের অভ্যাস করছে, যা একটি ইতিবাচক সামাজিক রূপান্তর। এই প্রেক্ষাপটে একটি ধারণা বিশেষভাবে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে—“সব ধর্ম একই মূলতত্ত্বে বিশ্বাস করে, সব ধর্মের পথই একই গন্তব্যে যায়।” এই দর্শনকে বলা হয় পারেনিয়ালিজম (Perennialism)। এটা এক ধরনের দর্শন, যা মনে করে সব ধর্মই মূলত একটি সর্বজনীন আধ্যাত্মিক সত্যের বিভিন্ন প্রকাশ।
এই চিন্তাধারা অনেককে বিশেষভাবে আকর্ষণ করে, কারণ এটি সহনশীলতা ও বৈচিত্র্যের প্রশংসা করে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—এই ধারণা ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের সাথে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ? আরও গভীরে প্রশ্ন হচ্ছে—সত্য কি আপেক্ষিক, না নির্দিষ্ট? আর সব ধর্মই যদি সত্য হয়, তাহলে ইসলামের দাবি—“ইসলামই একমাত্র সত্য দ্বীন”—এর স্থান কোথায়?
পারেনিয়ালিজম কী এবং এটি কেন গুরুত্বপূর্ণ?
পারেনিয়ালিজম একটি দার্শনিক মতবাদ যা বলে, সব বড় ধর্মই এক চূড়ান্ত আধ্যাত্মিক সত্যের দিকে ধাবিত হয়, যদিও তাদের বাহ্যিক রীতিনীতি, ভাষা ও সংস্কৃতি ভিন্ন হতে পারে। এই মতবাদের প্রবক্তাদের মতে, বৌদ্ধ ধর্ম, হিন্দুধর্ম, খ্রিস্টান ধর্ম, ইসলাম, ইহুদী ধর্ম কিংবা তাও ধর্ম—সবাই একই পরম সত্যের অনুসন্ধানে রত।
এই ধারণার পেছনে মূল উদ্দেশ্য হলো—ধর্মীয় সহাবস্থান এবং পারস্পরিক সম্মান নিশ্চিত করা। পাশ্চাত্য দার্শনিক অল্ডাস হাক্সলি (Aldous Huxley) তাঁর বই The Perennial Philosophy-এ এই ধারণাকে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন: “Truth is one, sages call it by different names.”
অর্থাৎ “সত্য এক, জ্ঞানীরা তাকে বিভিন্ন নামে ডেকে থাকেন।”
এই চিন্তা শুধু দার্শনিক নয়; এটি বহু আন্তঃধর্মীয় সংলাপ, এনজিও কার্যক্রম, ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কনীতির ভিত্তি হয়ে উঠছে।
ইসলামের দৃষ্টিকোণ: সত্য কি আপেক্ষিক না নির্দিষ্ট?
ইসলাম এই চিন্তাধারার সাথে সরাসরি দ্বিমত পোষণ করে। ইসলামে বিশ্বাস করা হয় যে সত্য একটিই—যা আল্লাহ নিজে নির্ধারণ করেছেন। সেই সত্য হলো ইসলাম, যা কুরআন ও রাসূল মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে প্রেরিত হয়েছে।
পবিত্র কুরআন ঘোষণা করে: "إن الدين عند الله الإسلام"
“নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট একমাত্র গ্রহণযোগ্য ধর্ম ইসলাম।” (সূরা আলে ইমরান, ৩:১৯)
এবং আরও বলা হয়েছে: "ومن يبتغ غير الإسلام دينا فلن يقبل منه وهو في الآخرة من الخاسرين"
“যে ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো দ্বীন কামনা করবে, তা কখনো গ্রহণযোগ্য হবে না। আর আখিরাতে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।” (সূরা আলে ইমরান, ৩:৮৫)
এই বক্তব্য দ্ব্যর্থহীন। ইসলামে মুক্তির পথ একটাই—আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস, রাসূল মুহাম্মদের (সা.) অনুসরণ, ও কুরআনের বিধান পালন। ইসলাম পূর্ববর্তী নবীদের সম্মান করে, কিন্তু সেই পূর্ববর্তী ধর্মগুলো এখন বিকৃত বলে গণ্য করা হয়। তাই কেবল ঐতিহাসিক সত্য বা আধ্যাত্মিক অনুভূতি নয়, বরং আল্লাহর নির্ধারিত ও সংরক্ষিত পথই ইসলাম।
ইসলামি পণ্ডিতদের দৃষ্টিভঙ্গি
ইসলামের প্রধান চিন্তাবিদ ও আলেমরা পারেনিয়ালিজমকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। নিচে কিছু বিশিষ্ট আলেমের বক্তব্য তুলে ধরা হলো:
- ইবন তাইমিয়া (রহ.) বলেন:
“সত্য এক—যা আল্লাহ নবীদের মাধ্যমে পাঠিয়েছেন। এর বাইরে যা আছে, তা বাতিল।”
(Majmoo’ al-Fataawa)
- ইমাম গাজ্জালি (রহ.) তাঁর "তাহাফুতুল ফালাসিফা"-তে স্পষ্ট করে বলেন, মানবজীবনের লক্ষ্য হলো আল্লাহর পরিচয় ও তাঁর ইবাদত, যা কেবল রাসূলদের মাধ্যমে জানা সম্ভব।
- ড. ইয়াসির কাদি, সমসাময়িক ইসলামি চিন্তাবিদ, বলেন: “পারেনিয়ালিজম ইসলামের ‘la ilaha illallah’-র মৌলিক বার্তার সাথে সাংঘর্ষিক। ইসলাম সব ধর্মকে সম্মান করে, কিন্তু সত্য কেবল একটিই।”
- ড. নুয়মান আলি খান বলেন: “আল্লাহ বলেছেন, এই কিতাব (কুরআন) সত্য ও বাতিলের মাঝে ফয়সালার জন্য। তাহলে আপনি কীভাবে বলবেন—সব পথই সমান?”
পারেনিয়ালিজমের বিপদ: আপোষে আধ্যাত্মিক বিভ্রান্তি
পারেনিয়ালিজমের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো—এটি সত্যের ধারণাকে আপেক্ষিক করে তোলে। যদি সব ধর্মই মুক্তির পথ হয়, তাহলে মানুষ কীভাবে জানবে কোন পথ সত্য?
এর ফলে তিনটি বিপদ ঘটে:
তাওহিদের চেতনায় দুর্বলতা আসে—যেহেতু অন্যান্য ধর্মেও মুক্তির আশা রাখা যায় বলে মনে করা হয়, মানুষ আল্লাহর নির্ধারিত পথে গুরুত্ব কম দেয়।
ধর্মীয় দায়িত্ববোধ হ্রাস পায়—যদি সবই সত্য হয়, তাহলে ইসলামের বিধান পালনের প্রয়োজনীয়তা কমে যায়।
আখিরাতের উপলব্ধি ঝুঁকির মুখে পড়ে—যেখানে কুরআন জানাচ্ছে, ইসলামের বাইরে মুক্তি নেই, সেখানে পারেনিয়ালিজম এর বিপরীত দাবি করছে।
ইসলাম ও সহনশীলতা: সত্যকে অটুট রেখেই সদ্ব্যবহার
ইসলাম সহনশীলতার বিরোধী নয়। বরং ইসলাম অন্য ধর্মাবলম্বীদের সাথে সদ্ব্যবহার, ইনসাফ এবং মানবিক আচরণের নির্দেশ দেয়। রাসূল (সা.) নিজেই খ্রিস্টান ও ইহুদি প্রতিনিধিদের সাথে সংলাপে বসতেন। কিন্তু এই সহনশীলতা সত্যের সাথে আপোষ নয়। ইসলাম বলে—সত্যকে নম্রভাবে, কিন্তু দৃঢ়ভাবে উপস্থাপন করো।
ٱدْعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِٱلْحِكْمَةِ وَٱلْمَوْعِظَةِ ٱلْحَسَنَةِ ۖ وَجَـٰدِلْهُم بِٱلَّتِى هِىَ أَحْسَنُ ۚ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَن ضَلَّ عَن سَبِيلِهِۦ ۖ وَهُوَ أَعْلَمُ بِٱلْمُهْتَدِينَ
“তোমার প্রভুর পথে আহ্বান কর প্রজ্ঞা ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে।”
(সূরা নাহল, ১৬:১২৫)
পারেনিয়ালিজম মানবিক এবং সহনশীলতার দৃষ্টিকোণ থেকে আকর্ষণীয় হলেও, ইসলামের মৌলিক আকিদা ও সত্যবোধের দৃষ্টিতে এটি এক বড় বিপদ। এটি একদিকে যেমন আধ্যাত্মিক বিভ্রান্তির কারণ হতে পারে, তেমনি মুসলিমদের ঈমান ও আত্মপরিচয়কেও দুর্বল করে। ইসলাম স্পষ্টভাবে বলে—সত্য একটিই, তা হলো আল্লাহর নির্দেশিত পথ। তাই ইসলামে মুক্তি ও চূড়ান্ত সফলতা কেবল ইসলাম গ্রহণ এবং সেই পথ অনুসরণের মাধ্যমেই সম্ভব। ধর্মীয় সংলাপ, আন্তঃধর্মীয় সম্মান এবং বৈচিত্র্যের মধ্যে সহাবস্থান অবশ্যই কাম্য; কিন্তু তা হতে হবে সত্যকে অক্ষুণ্ন রেখেই। ইসলাম সেই সত্যেরই ঘোষণা দেয়—স্পষ্ট, নির্ভুল ও একমাত্র।