ড. মুনাক্কির হোসেন:  এক মাটির মানুষ ও সমাজসেবী বিজ্ঞানীক

যে জাতির মধ্যে ডক্টর মুহাম্মদ মুনাক্কির হোসেনের মতো মানুষ আছেন, তারা কীভাবে বিভ্রান্ত হতে পারে?

এক ব্যক্তিত্ব যিনি কখনোই তাঁর জ্ঞানতৃষ্ণাকে দমন করতে পারেননি এবং যিনি ধর্ম ও দাওয়াতের প্রতি তাঁর আকর্ষণকে কখনোই দমিয়ে রাখতে পারেননি। গবেষকরা তাঁর চিত্রকে অস্বীকার করতে পারেননি, কারণ তিনি ছিলেন অনন্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী, যিনি বাংলার মাটিতে একজন মহামানব হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

সময় এমন মানুষের প্রতি অত্যন্ত কৃপণ এবং তাঁর সমকক্ষ খুব কমই পাওয়া যায়। কারণ তিনি এমন অবদান রেখেছেন যা ইতিহাসে স্থায়ী হয়ে থাকবে এবং তাঁর জীবন ছিল এক মহান ব্যক্তিত্বের প্রতিচ্ছবি। ডক্টর মুনাক্কির হোসেন একজন সুফি ব্যক্তিত্ব, যিনি জ্ঞানের প্রচার এবং দাওয়াতের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।

যখন বাংলা দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষের মধ্যে ছিল এবং মানুষ তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর সামর্থ্য রাখত না, তখন আল্লাহ্‌র কৃপায় তিনি জন্ম নেন। ১৯৫৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর পশ্চিম বাংলার খুতাকেল গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন এবং গবেষণা ও ইসলামি শিক্ষার উন্নয়নে অনন্য ভূমিকা রাখেন। তিনি পশ্চিম বাংলার বীরভূম জেলার বাইকার বিএস গ্রামে বেড়ে ওঠেন। তাঁর পিতা ছিলেন কৃষক ফায়েজ হোসেন এবং তাঁর মাতা ছিলেন গৃহিণী রাজিয়া বিবি।

শিক্ষাজীবনের কঠিন পথচলা

ডক্টর মুনাক্কির হোসেন ছোটবেলা থেকেই শিক্ষার প্রতি অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন। জীবনীগ্রন্থ অনুসারে, তিনি বীরভূম জেলার ভীমপুর বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। পরে নায়াগ্রাম Y.M জুনিয়র হাই স্কুলে অধ্যয়ন করেন এবং এরপর বাইকার হাই স্কুল থেকে ১৯৭৩ সালে মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি হেতামপুরের কৃষ্ণচন্দ্র কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে বিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক ডিগ্রি (B.Sc.) অর্জন করেন।

এরপর তিনি বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন এবং রসায়নে স্নাতকোত্তর (M.Sc.) ও পিএইচডি (Ph.D.) সম্পন্ন করেন। পিএইচডি অর্জনের পর তিনি মুম্বাইয়ের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (IIT) এ সাত বছর পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণা করেন। এরপর তিনি জাপানে যান এবং দুই বছর গবেষণা চালান। পরে তিনি ১৯৯৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত তাইওয়ানের অ্যাকাডেমিয়া সিনিকায় পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণা করেন এবং ৫৫টিরও বেশি গবেষণাপত্র আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশ করেন। এছাড়া তিনি ৭টি গবেষণা নিবন্ধ জাতীয় পর্যায়ে প্রকাশ করেন।

সামাজিক ও শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর অবদান

ডক্টর মুনাক্কির হোসেন বিশ্বাস করতেন যে শিক্ষা হলো সমাজ উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি। তিনি টেকসই উন্নয়নের জন্য একটি সমন্বিত পরিকল্পনা তৈরি করেন, যেখানে দরিদ্র শিশুদের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষা, যুবকদের জন্য কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং স্বাস্থ্যসচেতনতা কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত ছিল।

২০১৬ সালে অবসর গ্রহণের পর, তিনি তাঁর জন্মভূমি ভীমপুরে ফিরে আসেন এবং শিক্ষার প্রসারে নিজেকে নিয়োজিত করেন। তিনি পশ্চিম বাংলায় দারুল হুদা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি শাখা প্রতিষ্ঠার জন্য ১০ একর জমি দান করেন। এই প্রতিষ্ঠান বিনামূল্যে মাধ্যমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষা প্রদান করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে রয়েছে আধুনিক গ্রন্থাগার, ডিজিটাল ক্লাসরুম, খেলার মাঠ ও গবেষণাগার। ছাত্রদের ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে ভর্তি নিয়ে ১২ বছরের মধ্যে মাস্টার্স ডিগ্রি (M.M এবং M.A) সম্পন্ন করার সুযোগ দেওয়া হয়।

শিক্ষা উন্নয়নের পাশাপাশি, তিনি ভীমপুরে মাতৃ ও শিশুর জন্য একটি হাসপাতাল স্থাপনের পরিকল্পনাও করেছিলেন, যা স্থানীয় জনগণের চিকিৎসার ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ।

সুফিবাদ ও আধ্যাত্মিক জীবন

তিনি শুধুমাত্র একজন গবেষকই ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত সুফি। তিনি জ্ঞানকে আত্মশুদ্ধি ও সমাজ উন্নয়নের মাধ্যম হিসেবে দেখতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে আধুনিক বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর বক্তৃতাগুলোতে সবসময় এই সমন্বয়ের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হতো।

তিনি মনে করতেন যে মানবজীবন অন্যদের সেবার জন্য নিবেদিত হওয়া উচিত এবং শিক্ষার পাশাপাশি স্বাস্থ্য ও সামাজিক কল্যাণকেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে। তাঁর এই স্বপ্ন কেবল কল্পনা ছিল না; বরং তিনি বাস্তবে তা বাস্তবায়িত করেছেন এবং সমাজের জন্য এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছেন।

জীবনের শেষ অধ্যায়

২০২৪ সালে ডক্টর মুনাক্কির হোসেন ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। তবে তিনি ধনী বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ না করে, সাধারণ মানুষের মতো সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। তাঁর এই বিনয় ও মানবিকতা সবাইকে মুগ্ধ করেছিল।

মৃত্যু 

২০২৫ সালের 5 ফেব্রুয়ারি, রাত ১০:৫০ মিনিটে রামপুরহাট হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী, তাঁকে পশ্চিম বাংলার দারুল হুদা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান মসজিদের সামনে দাফন করা হয়।

তাঁর জানাজায় প্রায় ৮০০০ লোক উপস্থিত ছিলেন। শিক্ষাবিদ ও বিশিষ্টজনেরা শোকবার্তায় বলেন, "আমরা আজ আমাদের আরেকজন পথপ্রদর্শককে হারালাম।" তাঁর এই মৃত্যু মুসলিম সমাজের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে থাকবে।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter