হায়দরাবাদের স্মরণীয় সফর: চতুর্থ উসওয়াতুন্নবী আন্তর্জাতিক একাডেমিক সম্মেলনের অভিজ্ঞতা

পরিচিতি ও যাত্রার প্রস্তুতি

একটি ভ্রমণ তখনই স্মরণীয় হয়ে ওঠে যখন তাতে শুধু স্থান পরিবর্তন নয়, বরং জ্ঞানার্জন, বন্ধুত্ব এবং আত্মশুদ্ধির অনন্য অভিজ্ঞতা যুক্ত হয়। আমাদের হায়দরাবাদ সফরও ছিল তেমনই এক ভ্রমণ। এই সফরে অংশগ্রহণ করেছিলেন আমি—মোহাম্মদ কামরান, সঙ্গে ছিলেন আমার প্রিয় সহপাঠী ও বন্ধু সফিউল ইসলাম, মেহেদি হাসান, রহিম শেখ, মুহাম্মদ শেখ, মোঃ শাহজাহান এবং মুবারক শেখ। আমরা সকলে একসাথে যেন একটি ছোট পরিবারে রূপ নিয়েছিলাম।

১৪ই সেপ্টেম্বর ২০২৫ ভোরে, ফজরের নামাজ ও দোয়া শেষে, আমরা যাত্রার জন্য প্রস্তুত হলাম। সকাল ৬টায় মুরারাই স্টেশন থেকে ট্রেনে ওঠার মুহূর্তে সবার চোখে ছিল উচ্ছ্বাস আর হাসি। একদিকে সামনে অপেক্ষমাণ দীর্ঘ ভ্রমণ, অন্যদিকে প্রথমবারের মতো বড় পরিসরে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণের আনন্দ—এই দুই অনুভূতির মিশ্রণে মনটা ভরে উঠছিল।

যাত্রার আগে আমাদের প্রস্তুতিও ছিল বেশ যত্নশীল। আমি নিজে আমার গবেষণাপত্র “Melodies of Love: Imam Ahmad Raza Khan’s Na‘t Poetry and the Devotional Sīrah Milieu of Bareilly” একাধিকবার ঝালিয়ে নিয়েছিলাম। অন্যরাও তাঁদের নোটস ও প্রবন্ধ যাচাই করছিলেন। পরিবার ও শিক্ষকদের আশীর্বাদ এবং দোয়া আমাদের হৃদয়ে শক্তি যোগাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল এই সফর কেবল একটি ভ্রমণ নয়, বরং আধ্যাত্মিকতার পথে এক বিশেষ পদযাত্রা।

আল্লাহ তায়ালা বলেন:

 “وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا

“আর যারা আমাদের পথে প্রচেষ্টা করে, আমরা তাদের পথকে সহজ করে দেই।”

(সূরা আল-আনকাবুত ২৯:৬৯)

এই আয়াতটি আমাদের মনে করিয়ে দিল, প্রতিটি কষ্ট, প্রতিটি যাত্রা আসলে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের এক সোপান। সেই বিশ্বাস নিয়েই আমরা আমাদের যাত্রা শুরু করি।

ট্রেন যাত্রা: মুরারাই থেকে হাওড়া

১৪ই সেপ্টেম্বর ভোরবেলা মুরারাই স্টেশনে পৌঁছে আমরা সবাই ট্রেনের অপেক্ষায় ছিলাম। সকাল ৬টা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই ট্রেন প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করে। সবার চোখে-মুখে ছিল উচ্ছ্বাস, আর মনে হচ্ছিল নতুন কিছুর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি। ট্রেনে ওঠার পরই শুরু হলো আমাদের মূল ভ্রমণ।

জানালার বাইরে দৃষ্টি মেলতেই চোখে পড়ল গ্রামের সবুজ মাঠ, আঁকাবাঁকা পথ আর ঝকঝকে নদীর ধারা। সূর্যের আলোয় ঝলমল করা ধানক্ষেত যেন প্রকৃতির পক্ষ থেকে আমাদের জন্য ছিল এক বিশেষ উপহার। আমরা বারবার মোবাইল বের করে ছবি তুলছিলাম, তবে ক্যামেরার বাইরেও যে দৃশ্যগুলো চোখে আর মনে গেঁথে যাচ্ছিল, তা ছিল আরও বেশি প্রাণবন্ত।

ভ্রমণের সবচেয়ে আনন্দদায়ক দিক ছিল আমাদের পরস্পরের সান্নিধ্য। হালকা গল্প, মাঝেমধ্যে হাসির ঝলক, আবার কারও কারও সিরিয়াস আলোচনা—সব মিলিয়ে ট্রেনের ভেতরটা যেন এক ক্ষুদ্র শ্রেণিকক্ষে পরিণত হয়েছিল। এ সময় আমরা সম্মেলন নিয়ে ভাবছিলাম, আবার কখনো প্রিয় শিক্ষকদের কথা স্মরণ করছিলাম।

রাসুলুল্লাহ ইরশাদ করেছেন:

 “طلب العلم فريضة على كل مسلم

“জ্ঞান অর্জন করা প্রতিটি মুসলিমের জন্য ফরজ।”

(আবু দাউদ, হাদিস ৩৭৪১)

এই হাদিস আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছিল যে আমাদের যাত্রা নিছক আনন্দের জন্য নয়, বরং জ্ঞানার্জনের মহৎ উদ্দেশ্যে। তাই ভ্রমণের প্রতিটি মুহূর্তেই আমরা যেন এক বিশেষ ইবাদতের স্বাদ অনুভব করছিলাম।

হাওড়া থেকে সেকেন্দ্রাবাদগামী ট্রেন

হাওড়ায় পৌঁছানোর পর বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতেই আমরা সেকেন্দ্রাবাদের উদ্দেশ্যে ট্রেনে উঠি। লম্বা এই যাত্রার কথা ভেবে শুরুতে মনে একটু শঙ্কা জাগলেও, আলহামদুলিল্লাহ, আমরা সিট পেয়েছিলাম। তাই পুরো ভ্রমণটাই আরামদায়ক ও আনন্দঘন হয়ে উঠেছিল। অনেক সময় দীর্ঘ ট্রেনযাত্রায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় বা ভিড়ের মধ্যে কষ্ট করতে হয়, কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে সেটি ঘটেনি। তাই সবাই খুব স্বাচ্ছন্দ্যে বসে যাত্রা উপভোগ করতে পেরেছিলাম।

রাতভর আমাদের ট্রেন ভ্রমণ যেন ছিল এক অমূল্য স্মৃতি। কখনো আমরা হালকা গল্পে মেতে উঠেছি, কখনো আবার উচ্ছ্বাসে হেসেছি। মাঝেমধ্যে কারও ব্যাগ থেকে বের হয়েছে চিপস, বিস্কুট কিংবা ফল—সবাই মিলে ভাগাভাগি করে খাওয়ার আনন্দ ছিল অন্যরকম। কেউ গান ধরেছে, কেউ আবার ছোট্ট কোনও খেলা শুরু করে দিয়েছে। এভাবেই হাসি-ঠাট্টা, খাওয়া-দাওয়া আর খেলার ছলে রাতটা কেটে গেল খুব সহজেই।

যাত্রার মাঝেমধ্যেই আমরা থেমে গিয়ে আসল উদ্দেশ্যের কথাও মনে করেছি। সম্মেলনে কেমন উপস্থাপনা হবে, কোন কোন শিক্ষকের সাথে দেখা হবে—এসব নিয়েও আলোচনা চলেছে। আধ্যাত্মিক চিন্তা ও ভবিষ্যতের স্বপ্ন আমাদের হৃদয় ভরিয়ে দিচ্ছিল।

অবশেষে ১৬ই সেপ্টেম্বর ভোরে যখন সেকেন্দ্রাবাদ স্টেশনে ট্রেন থামল, আমরা মনে করলাম—দীর্ঘ যাত্রা সত্ত্বেও আল্লাহ তায়ালা আমাদের ভ্রমণকে সুখকর ও ফলপ্রসূ করেছেন। এটি নিঃসন্দেহে তাঁর এক অনন্য নিয়ামত।

হায়দরাবাদ দর্শন: প্রথম দিন

সকাল বেলায় ঘুম থেকে উঠেই আমরা হায়দরাবাদের প্রথম দিনের যাত্রা শুরু করি। প্রথম গন্তব্য ছিল বিখ্যাত হুসেইন সাগর লেক। ট্রেনের ক্লান্তি যেন মুহূর্তেই দূর হয়ে গেল বিশাল জলরাশির দৃশ্য দেখে। হাওয়া মুখে এসে লাগছিল, চারপাশের নীরবতা আর মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা সুবিশাল বুদ্ধমূর্তি এক অপূর্ব পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। আমরা অনেকক্ষণ ধরে ছবি তুললাম, হাঁটাহাঁটি করলাম আর প্রকৃতির সেই শান্ত সৌন্দর্য উপভোগ করলাম।

এরপর আমাদের পথ হলো ঐতিহাসিক কুতুব শাহি সমাধির দিকে। প্রাচীন স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন দেখে আমরা মুগ্ধ হয়ে গেলাম। বড় বড় গম্বুজ, খিলান আর পাথরের দালান আমাদেরকে শত শত বছর আগের ইতিহাসে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। এখানে দাঁড়িয়ে আমরা অনুভব করছিলাম, ইসলামি স্থাপত্য কতখানি সমৃদ্ধ এবং শৈল্পিক হতে পারে।

দিনের শেষ ভ্রমণ ছিল চারমিনার। দূর থেকে চারটি মিনার নজরে আসতেই উত্তেজনা বেড়ে গেল। কাছে গিয়ে যখন আমরা এর সৌন্দর্য দেখলাম, তখন সত্যিই মনে হলো এটি হায়দরাবাদের প্রাণ। চারপাশে ব্যস্ত বাজার, দোকানের ভিড়, মানুষের কোলাহল — সব মিলে চারমিনার যেন জীবন্ত ইতিহাসের প্রতীক। আমরা বাজার ঘুরে দেখলাম, কিছু স্মারক জিনিসও কিনলাম।

এই ভ্রমণের প্রতিটি মুহূর্তে আমাদের অন্তর থেকে বেরিয়ে আসছিল, “الحمد لله” — আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ, যিনি আমাদের এমন সুন্দর জায়গা দেখার সুযোগ দিয়েছেন।

অন্যান্য দর্শনীয় স্থান

হায়দরাবাদের ভ্রমণে আমাদের অন্যতম আকর্ষণ ছিল সালার জং মিউজিয়াম। এটি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা হিসেবে পরিচিত। ভেতরে প্রবেশ করেই আমরা যেন ইতিহাস ও শিল্পের ভাণ্ডারে ঢুকে পড়লাম। চিত্রকলা, ভাস্কর্য, প্রাচীন আসবাব, বিরল পাণ্ডুলিপি এবং অস্ত্রশস্ত্র দেখে আমরা বিস্মিত হলাম। বিশেষ করে প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শনগুলো আমাদের মনে করিয়ে দিল মানুষের জ্ঞান ও শিল্পচর্চার দীর্ঘ যাত্রার কথা। এখানে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত ছিল শেখার ও ইতিহাসকে অনুভব করার এক অনন্য সুযোগ।

এরপর আমরা গেলাম মক্কা মসজিদে। এটি ভারতের অন্যতম বৃহৎ ও প্রাচীন মসজিদ। বিশাল আঙ্গিনা, উঁচু মিনার আর পাথরের দেয়াল যেন গাম্ভীর্যের বার্তা দিচ্ছিল। ভেতরে প্রবেশ করলে এক ধরনের শান্তি ও নীরবতা আমাদের হৃদয়কে ছুঁয়ে গেল। আমরা নামাজ আদায় করলাম এবং মনে মনে দোয়া করলাম—আল্লাহ যেন আমাদের ভ্রমণকে বরকতময় করেন।

শেষে আমরা ঘুরলাম ঐতিহাসিক গোলকোন্ডা ফোর্ট। দুর্গের উঁচু প্রাচীর বেয়ে উঠতে উঠতে আমরা কল্পনা করছিলাম অতীতের রাজাদের শৌর্যগাথা। উপরে পৌঁছে পুরো হায়দরাবাদ শহরকে এক নজরে দেখা গেল। সেই দৃশ্য সত্যিই ছিল মনোমুগ্ধকর এবং ইতিহাসের জীবন্ত স্পর্শের মতো।

সম্মেলনের দিন: ১৭ই সেপ্টেম্বর

১৭ই সেপ্টেম্বরের সকালটি ছিল ভিন্ন এক অভিজ্ঞতার দিন। আমরা অংশগ্রহণ করলাম “4th Uswatunnabi International Academic Conference”-এ, যা ভারতের হায়দরাবাদ শহরের Maulana Azad National Urdu University (MANUU) ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। পুরো ক্যাম্পাস সেদিন আলোকিত ও প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল। দেশ-বিদেশ থেকে আগত অতিথি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং আলেম-ওলামাদের পদচারণায় পরিবেশ ছিল একেবারে বর্ণিল ও জ্ঞানচর্চার আবহে ভরপুর।

সেদিন আমি আমার প্রবন্ধ উপস্থাপন করি, শিরোনাম ছিল:

“Melodies of Love: Imam Ahmad Raza Khan’s Na‘t Poetry and the Devotional Sīrah Milieu of Bareilly.”

উপস্থাপনার সময় আমার হৃদয় ভরে উঠেছিল এক বিশেষ আবেগে। নবীজির প্রেমভরা কবিতা ও তার আধ্যাত্মিক প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে মনে হচ্ছিল আমি যেন ইতিহাস ও আধ্যাত্মিকতার সেতুবন্ধনে দাঁড়িয়ে আছি।

প্রবন্ধ শোনার সময় শ্রোতাদের মনোযোগ, তাদের হাসি, মাথা নেড়ে সমর্থন জানানো, এবং শেষে করা প্রশ্নগুলো আমাদের অনুপ্রাণিত করেছিল। মনে হচ্ছিল আমাদের প্রচেষ্টা সফল হয়েছে।

রাসূলুল্লাহ বলেছেন:

 “من سلك طريقا يلتمس فيه علما سهل الله له به طريقا إلى الجنة

“যিনি জ্ঞান অর্জনের পথ অনুসরণ করেন, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন।

(সাহিহ মুসলিম, হাদিস ২৬৫৯)

এই হাদিসটি যেন সেই মুহূর্তে আমাদের বাস্তবে উপলব্ধি করাল—আমাদের এই সফর শুধু একাডেমিক সাফল্যের নয়, বরং আধ্যাত্মিক উন্নতিরও এক মূল্যবান ধাপ।

সমাপ্তি

সেকেন্দ্রাবাদ থেকে ফেরার পথে আমাদের মনে হচ্ছিল—এই সফর কেবলমাত্র একটি ভ্রমণ নয়। এটি ছিল জ্ঞান, বন্ধুত্ব, আধ্যাত্মিকতা এবং অভিজ্ঞতার এক অমূল্য ভাণ্ডার। প্রতিটি মুহূর্তে আমরা শুধু স্থান পরিবর্তন করিনি, বরং নিজেদের ভেতর নতুন অনুভূতি ও উপলব্ধি অর্জন করেছি। হায়দরাবাদের ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো আমাদের ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত করেছে, সম্মেলনের আলোচনা আমাদের চিন্তার জগৎ প্রসারিত করেছে, আর সফরের হাসি-আড্ডা আমাদের বন্ধুত্বকে আরও দৃঢ় করেছে। 

সবচেয়ে বড় কথা, এই সফর আমাদের শিখিয়েছে—ভ্রমণ মানে কেবল ঘুরে দেখা নয়; এটি আত্মাকে সমৃদ্ধ করার, নতুন জ্ঞান আহরণের এবং আল্লাহর সৃষ্টির সৌন্দর্য উপলব্ধি করার এক মাধ্যম।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter