স্বপ্নের শহর মুম্বাই দর্শনে

মুম্বাই শহরের নাম কেই বা শুনেনি। কিন্তু অনেকেরই দেখা নয়।  এবছর আমাদের বিদ্যালয়-ভ্রমণের গন্তব্যস্থল ছিল এই বিশ্ব শহর মুম্বাই যা  ইতিহাসে বোম্বে ও অর্থবিদ্যায় ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী নামে পরিচিত। এক সপ্তাহ অতিবাহিত করার পরেও মনে হচ্ছে মুম্বাই যেন সত্যিই স্বপ্ন নগরী। আমাদের যাত্রা ফেব্রুয়ারী ৫ তারিখ আরম্ভ হয় এবং ১১ তারিখ সমাপ্ত। ছোট থেকে শুধু নাম শুনে এসেছিলাম, এবার সচক্ষে দর্শনও হয়ে গেল।  আর স্বপ্ন নয়; এবার বাস্তব। এবার তার পরিদর্শনের অবসর। কিন্তু, অধ্যায়ণের পর জ্ঞান হয়, আর প্রতক্ষের পর অভিজ্ঞতা। ইংরেজি ভাষায়: ইউ নোও ইট বেটার হোয়েন ইউ এক্সপিরিয়েন্স ইট।      

 

ভ্রমণ আরম্ভ

ঠিক দুপুর ২টার পর আমরা ডিগ্রি ফাইনাল ইয়ারের ৪৩ জন ছাত্র ও অগ্রগ্রামী হিসেবে ৩ জন শিক্ষকসহ জুসটুজু ভ্রমনের জন্য পারি দিই।  সম্ভব সকল সরঞ্জাম আগেই প্রস্তুত করা হয়েছিল। পুরো ছাত্রদলকে চার ভাগে বিভক্ত করে তাদের সর্দারও নিযুক্ত করা হয়। ২০ মিনিটের মধ্যে কাছের স্টেশন পরপ্পানাঙ্গাডি পৌঁছায়।  এখান থেকে লোকাল ট্রেনের মাধ্যমে কালিকট রেলওয়ে স্টেশন গিয়ে আমরা মুম্বাইয়ের উদ্দেশ্যে নেত্রবতী এক্সপ্রেস ধরবো। সময় সন্ধ্যা ৬টা।  

   তার আগে স্টেশন পার্শে এক মসজিদে আসর এবং পরে মাগরিব নামায আদায় করে নিলাম। রাত্রি আহারের জন্য আগেই একটি হোটেলে পার্সেল অর্ডার দেওয়া ছিল। চার দিন আগে টিকিট কাটা, বেশিরভাগ কনফার্ম হয়নি। ঠেসাঠেসিতে চাপলাম জেনারেল কোচে। কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে বসবার স্বস্তি পায়।

ঠিক তার পরের দিন দুপুরের সময় আমরা পানভেল নামে মহারাষ্ট্রের এক স্টেশনে নামি। এখানে আমাদের মধ্যাহ্ন আহারের কথা ছিল, কিন্তু হল না। বেশ কিছু সময় মুম্বাইয়ের বিশেষ লোকাল ট্রেন ধরে প্রথমে থানে ভাইয়া কল্যাণ স্টেশন পৌছায়। থানেতে এক স্ট্যাটাস রাখি: মনে পড়ে ইতিহাস বয়ের লাইন - মুম্বাই থেকে থানে ভারতে প্রথম রেল যাত্রা হয়। দুপুরের খাবার কল্যাণে খায় সন্ধ্যা পাঁচটার পর।

মহারাষ্ট্র প্রবেশ করতে করতে আমার সীমিত জ্ঞান ভান্ডারে প্রতিষ্ঠিত এক ধারণা বদলে যায়। ভাবতাম যে ঝাড়খণ্ডই শুধু পাহাড়-পর্বত, নদ-নদী জঙ্গলমহলে ভরা। কিন্তু, কেরালা এবং এখন মুম্বাই ভ্রমণে এই প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য আরও চিরহরিৎ মনে হচ্ছে। বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টার সৃষ্টি পৃথিবী খুব বৈচিত্র্যপূর্ণ। সময় সময় চলন্ত ট্রেন সুরঙ্গ পথ দিয়ে লম্বা পাহাড় ভেদ করে তো আবার হরিৎ গাছের সারির মধ্যে দিয়ে তো কখনো বিস্তীর্ণ জলাশয়ের উপর ফেলা লৌহ-কপাটের ব্রিজ রাস্তায় ছুটে যাচ্ছে। প্রকৃতি-মানব সমন্বয় না সংঘর্ষ!?

 

ভিওয়ান্ডির হাদিয়া দপ্তরে

রাত ৯টার নাগাদ আমরা সিএসই (CSE) হাদিয়া সাব-সেন্টার পৌছায়। দারুল হৃদার স্নাতকোত্তর ছাত্র সংগঠন হাদিয়া। সামাজিক শ্রেষ্ঠত্ব কেন্দ্র বা সেন্টার ফর সোসিয়াল এক্সেলেন্স হল অর্থাৎ সিএসই হল কেরোলের পনাককাড়ে অবস্থিত হাদিয়া দপ্তর। দপ্তর থেকে উন্থিত পরিকল্পনা ২০৩০ মধ্যে দেশের বিভিন্ন মহানগরীতে উপকেন্দ্র গড়ে তোলা যাতে সামাজিক স্তরে উন্নতির কর্মকলাম আরও সহজ হয়। মহারাষ্ট্রের ভিওয়ান্ডতে সেই স্বনের প্রথম পরিণাম। এখানে প্রথম রাতের খাবার উমাইর-উবাইদ উস্তাদের তরফ থেকে ছিল।

   পরের দিন ভিওয়ান্ডি আমাদের কর্মসূচিতে ভর্তি ছিল। পূর্বেই সাব্যস্ত, ফজর নামায পর কুরআন তিলাওয়াত এবং ছোট একটি তাযকিইয়া মজলিস হয়। শুনেছিলাম ভিওয়ান্ডি অঞ্চলে ভালো বড়ো এক স্টেডিয়াম আছে। বের হলাম তারই দর্শনে - এক সিট বাঁধা গোলাকার মাঠে ভিন্ন ক্রীড়ার ভিন্ন দল। ওপরে বৃদ্ধ বয়স্করাও কসরতের বিভিন্ন রীতি পালন করছে। পার্শে পার্ক-স্বরুপ সজ্জিত এক চৌহদ্দে হিজাবী মহিলা দলও প্রভাত হাওয়ায় মন ও দেহ বলের অনুশীলন করছে। মুম্বাইয়ের ভিওয়ান্ডি এলাকা মুসলিম অধ্যাসিত এবং ইসলামী আচরণ বহিঃপ্রকাশে বিশেষিত। বাচ্চারা টুপি পরে বিদ্যালয়ের দিকে… ভিভিন্ন ধর্মীয় সেবায় যুক্ত সংগঠনের দেওয়াল দেওয়ালে কর্মের রং… মহিলারা হিজাব বস্ত্রে বাইরে - স্কুলে, বাজারে… ক্ষণ ক্ষণে আকাশচুম্বী মসজিদ-মাজারের মিনার - কোনোটা সুন্নির তো কোনোটা শিয়ার, শিফা দাওয়াখানা, রিযক হোটেল… ইমরান হজ অ্যান্ড উমরাহ ট্রাভেলস… আনসারী/আলী রোড…ইত্যাদি। অঞ্চলের প্রায় প্রত্যেক ঘরে ঘান্ধির হস্ত চরখার পরিবর্তে আধুনিক মেশিন লুম কারখানা। এখনকার বস্ত্র নাকি বিদেশেও রপ্তানি হয়। তবে এক চিন্তুকের দুশ্চিন্তা: কিন্তু সব মুসলিমের নয়; বেশিরভাগ ব্যাবসা অন্য সম্প্রদায়ের নিয়ন্ত্রণে।

   স্টেডিয়াম থেকে এসে তাড়াতাড়ি স্নান করে নিলাম - মুম্বাই স্পেশাল কিমা ওয়াড়া-পাউ। নাস্তার ব্যাবস্থা ছিল ইফতিখার উস্তাদের বাড়িতে। তিনি সিএইচএস বিল্ডিংয়ের ছাত্রদের যথা সেকেন্ডারী পড়ুয়াদের পড়ান। মুম্বাই তিনার বাড়ি তাই তিনি ভ্রমণের তিন শিক্ষকের এক। আর দুজন শিক্ষক যথাক্রমে মুহাম্মদ আলী উস্তাদ এবং আমাদের ক্লাস টিচার আশরাফ আলিমী উস্তাদ। নাস্তার পর সাম্প্রতিক ইন্তেকাল হন উস্তাদের আব্বার কবর যিয়ারতে গেলাম। তারপর দুপুর প্রযন্ত সেখানকারই ব্রদারি রেস্টুরেন্টের সেমিনার হলে স্থানীয় দুজন শিক্ষাবিদের আলোচনায় আমাদের ক্যাম্প-বিশেষ সেশনগুলি চলে। খাবারের নিমন্ত্রণ ছিল ঘুফরানের ভাড়ার ফ্ল্যাটে। সন্ধ্যার সময় ভিওয়ান্ডির মসজিদ নিয়ন্ত্রনে চলিত শিক্ষা ব্যাবস্থার ওপর আমাদের একটি ফিল্ড সার্ভে ছিল। আমি, দিলশাদ ও রাজিক মাহবুবে সুবহানী সুন্নি শাফী মসজিদে যায়। রাত্রির আহারও এক হুদাবি প্রিয়ের বাড়িতে হয়।

 

মালাঙ্গ আরোহণ

পরের দিন যথা ৮ জানুয়ারি ভিওয়ান্ডি বিদায় দিয়ে হাজী মালাংয়ের উদ্দেশ্যে বের হয়। সাজাদুল খালু আগেই বলেছে: প্রায় দু'হাজার সিড়ি! চাপতে পারবিনা। অন্য এক খালাতো বোনের বর সাদ্দাম ভাই ও মুবারাক খালু অভিমান করে যাচ্ছেন যে মুম্বাই এলাম তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলনা। আব্বা সবাইকে জানিয়ে দিয়েছেন যে আমি আসছি। পরে আমিও খবর দিয়েছিলাম। গ্রামের বন্ধু সামাদ খুব তোষামোদ করছিল। আসলে আমরা অস্থায়ী ভ্রমণদল - কখনো এখানে তো আধঘন্টা পর ওখানে -  বলে কাউকে ডাকতে পারিনি। আবার আমি ক্লাস ট্যুরের এক অঙ্গ বলে নিজেও যেতে পারিনা। কল্যাণ থেকে বাস ধরে আধঘন্টার মধ্যে আমরা মালাঙ্গ গড়ের উপোতক্যায়।

তিন হাজারের বেশি ফিট উঁচু আরোহণ এবং পরে অবতরণে দুপুর পেরিয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেল। গন্তব্যস্থলে উপনীত হওয়ার আগে কত বার যে বসেছি! রাস্তার দুপাশে আরোহীদের জান ও শরীর শীতল করার জন্য বিভিন্ন সরস আহারের দোকান। পাহাড়ের ওপর উদ্ভাসিত হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির সমন্বয় - অনেকের কাছে সমন্বয় নামে ধর্মের অবক্ষয়।

  পাহাড় শীর্ষে অবস্থান হাজী আব্দুর রহমান ওরফে হাজী মালাঙ্গ (রহ:) ও তাঁর সহচরদের সমাধিক্ষেত্র। আশেপাশে উনার পাঁচ জন নিকট শিষ্যের মাযারকে পাঁচ-পীর বলা হয়।  প্রধান মাযারে গুরু হাজী মালাঙ্গ এবং হযরতের হস্তে ইসলাম গ্রহণকারী রাজা নালার কন্যা মা ফাতিমার কবর। বলা হয় হযরত আরববাসী; ভারতবর্ষে ইসলামের বাতি নিয়ে দেশের ব্যাধি নিরাময় করতে প্রবেশ করেন। আজকেরও দুপুরের খাবারও সন্ধ্যার সময় কল্যাণ বাজারে হয়। তারপর পারি দিই ডোংরিতে কুওয়াতুল ইসলাম আরাবিক কলেজের উদ্দেশ্যে।

 

স্বল্পের শক্তি

ডোংরির রাস্তা ভিওয়ান্ডির থেকে কম নয়। ভাষায়, ব্যাবহারে, রাস্তায়, দোকানে ইসলামী বহিঃপ্রকাশের রং স্পষ্ট। শিয়াদের আধিপত্য বেশি। কিন্তু, সেখানকার থেকে এখানে মুসলিম পরিস্থিতি বেশি সচ্ছল, যেহুতু ডোংরি মুম্বাই মুখ্য শহরের অংশ। পার্শে এমনও চিত্র দেখলাম যা খুবই হৃদয়বিদারক - ফুটপাথে অনেকের বসবাস।

কুওয়াতুল ইসলাম দারুল হুদার অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠান। ছোট এক দুই তলার ফ্ল্যাটে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্র থাকে। প্রথম তলায় একই কক্ষে ক্লাস, লাইব্রেরী, কম্পিউটার ল্যাব, সাময়িক মসজিদ এবং রাত্রে বেডরুম। নিচ তলায় রান্নাঘর এবং ডাইনিং রুম। এখানেই আমদের খাবারের ব্যাবস্থা ছিল - নাস্তায় কিমা পাউ, লঞ্চে বিরিয়ানি এবং রাতের খাবারে আরও বিশেষ। আমাদের শুয়ার ব্যাবস্থা হয়েছিল পাশের একটি শাফী মসজিদে।

   ৯-১০ জানুয়ারি যথা ক্যাম্পের পঞ্চম এবং ষষ্ঠ দিন আসলে ছিল মুম্বাই ভ্রমণের দিন। এক ভাড়ার বাসে সারাটা দিন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় আমাদের সফর চলতে থাকে। গেট অফ ইন্ডিয়া থেকে শুরু করে গান্ধী সংঘ্রালয়, হাজী আলী দরগাহ, মাহিমি দরগাহ এবং শেষে জুহু বীচ পর্যন্ত। ফটো-সেলফি ও হাসি-মজাকের মাধ্যমে আমাদের দিন কেটে যায়। অনক দিনকার আকাঙ্ক্ষা সমুদ্র সৈকতে বোটিংও এবার পরিপূর্ণ হয়। একেবারে ঈশার আগে আমাদের ডেরায় মসজিদে ফিরে আসি। পরের দিনও এরকমই চরম অনন্দে কাটে। সারাটা দিন জল প্রমোদে চলে যায়। ১১ তারিখ লকমানিয়া তিলক টার্মিনাস থেকে কুচুভেলি এক্সপ্রেসে আমাদের প্রত্যাগমন সফর শুরু হয়।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter