ইসলাম এবং দাম্পত্য সম্পর্ক: ভালোবাসা, দায়িত্ব ও আধ্যাত্মিকতা
ইসলাম দাম্পত্য সম্পর্ককে শুধু সামাজিক বন্ধন হিসেবে দেখেন না; বরং এটিকে আল্লাহর অমূল্য দান ও আধ্যাত্মিক বন্ধন হিসেবেই বিবেচনা করেন। কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের জন্য শান্তি এবং “মাওদ্দা” (ভালোবাসা) ও “রহমা” (মমতা) দ্বারা বন্ধনীয়। অর্থাৎ দাম্পত্য সম্পর্কের মূল উদ্দেশ্য হল পরস্পরের মধ্যে আন্তরিক ভালোবাসা ও দয়া প্রতিষ্ঠা করা। নবী করীম (সা.)-এর বাণীতে প্রমাণিত, “বন্দেগী সম্পূর্ণতার সেরা লক্ষণ হলো দাম্পত্য জীবন” – কারণ বিয়ে করলে মানুষ তার বিশ্বাসের অর্ধেক পূর্ণ করে।
দাম্পত্য সম্পর্ককে ইসলামে অতি পবিত্র ও গুরত্বপূর্ণ একটি বন্ধন হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এটি আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে দাম্পত্য বন্ধনে শানিত ঘনিষ্ঠতা ও বোঝাপড়ার নিদর্শন। পবিত্র কুরআনেও স্বামী-স্ত্রীকে পরস্পরের “লিবাস” বা পোশাকসম (সহায়-সহজ) হিসেবে বর্ণনা করে বলা হয়েছে, “তোমাদের সঙ্গিনীরা তোমাদের জন্য পোশাক, যেমন তোমরাও তাদের জন্য পোশাক”। এই উপমা দ্বারা বোঝানো হয়েছে, বিবাহিত জীবন একে অপরের জন্য নিরাপত্তা ও সান্ত্বনার আবরণ; যেখানে পরস্পরকে সম্মান, সুরক্ষা ও স্নেহের আবরণ দিয়ে বেষ্টন করে রাখা হয়। ইসলাম দাম্পত্যকে শুধু যৌন চাহিদার পরিপূরণ নয়, বরং পরস্পরের শারীরিক–মানসিক সেবা এবং নৈতিক দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে পারস্পরিক সম্প্রীতি গড়ে তোলার মাধ্যম হিসেবে দেখে।
ভালোবাসা ও মমতা
বৈবাহিক সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হলো আন্তরিক ভালোবাসা ও মমতা। পবিত্র কুরআন স্পষ্টভাবে নির্দেশ দেয় যে, স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের মধ্যে “মাওদ্দা” ও “রহমা” (ভালোবাসা ও করুণা) সৃষ্টি করার মাধ্যমে একে অপরের প্রতি শান্তি এবং আনন্দের মূল। আল্লাহ বলেন, “অতঃপর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও করুণা সৃষ্টি করেছেন”। এই আয়াতের আলোকে বোঝা যায়, একজন মুসলিম স্বামী ও স্ত্রী যেন আল্লাহর এই অনুগ্রহকে যথাযথভাবে অনুভব করে, পরস্পরের মন জয় করে।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “মুমিনদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সে, যে তার স্ত্রীদের জন্য শ্রেষ্ঠ”। অর্থাৎ দাম্পত্য জীবনে যে দম্পতি একে অপরের প্রতি শ্রেষ্ঠ আচরণ করে, ভালোবাসা প্রদর্শন করে, তাদের মধ্যেই প্রকৃত ঈমানের পূর্ণতা লক্ষ্য করা যায়। নবীজির এই বাক্যে স্বামী-স্ত্রীর প্রতি পরস্পরের দয়াশীল ও সহানুভূতিশীল আচরণকে একনিষ্ঠভাবে তুলে ধরা হয়েছে। তাই ইসলামী বিবাহে শুধু পারস্পরিক দায়িত্ব নয়, আন্তরিক ভালোবাসাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
স্বামী-স্ত্রীদের মধ্যে অনুভূতির সেতু রক্ষা করতে পারস্পরিক ভালো কথা, টোকাটকি, সেবনমর্যাদা অবলম্বন অত্যাবশ্যক। একাডেমিক গবেষণার মাধ্যমে দেখা গেছে আধুনিক দম্পতিদের মধ্যে প্রায়ই “আবেগিক বিচ্ছিন্নতা” দেখা যায়: দৈনন্দিন দায়-দায়িত্ব, কাজের চাপ ইত্যাদির ফলে স্বামী-স্ত্রী আবেগিক দিক থেকে দূরে সরে আসেন। ইসলাম এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় উভয় পক্ষকে পরস্পরের জন্য সময় দেওয়ার, খোলাখুলি মন খুলে কথা বলার ও অংশীদারিত্বের গুরুত্ব স্মরণ করিয়ে দেয়। আধুনিক গবেষণায় পরামর্শ দেওয়া হয়: যৌথ অবসর, গোপন কথা বিনিময় করে আন্তরিক সংযোগ গঠন করতে হবে। মহান আল্লাহর নির্দেশনায়, বিবাহ শুধুমাত্র বসবাস নয়, বরং আন্তরিক আবেগ ও স্পর্শকাতর অনুভূতিতে উদ্ভাসিত হওয়া উচিত।
দায়িত্ব ও অধিকার
ইসলামে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অধিকার-দায়িত্ব সম্পর্কিত সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে। কুরআনে আল্লাহ তাআলা কর্মদক্ষ পুরুষদের আহ্বান করে বলেন, “পুরুষগণ নারীদের উপর রক্ষক-পরিচর্যাকারী; কারণ আল্লাহ তাদেরকে অন্যদের চেয়ে কিছু বেশি বরকত দিয়েছে এবং উনারা তাদের অর্থ দিয়েই (মহিলাদের) রক্ষণ করেন”। অর্থাৎ ইসলামী বিধিতে স্বামীকে স্ত্রীর খাদ্য, বাসস্থান, জামাকাপড়সহ মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এই দায়িত্ব পালনে বহিরাগত আর্থিক অবদানহীন স্ত্রীকেও স্বামীর সম্পত্তি থেকে পূর্ণ ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করতে হবে।
একই সঙ্গে ইসলাম দাম্পত্যে সম্প্রীতির জন্য ভদ্র আচরণ ও সদাচরণ জোরালো করে। কুরআনে স্বামীকে নির্দেশ আছে, “তাদের সঙ্গে ভদ্রভাবে বসবাস কর (৪:১৯)”। নবীজির হাদীসে পুরুষদের ভয় করে সতর্ক করা হয়েছে, “নারীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর! নিশ্চয়ই তোমরা তাদেরকে আল্লাহর নিরাপত্তায় গ্রহণ করেছ, তোমাদের সঙ্গম করাও আল্লাহর আয়াতের মাধ্যমে তোমাদের হারাম করা হয়েছে… তোমাদের স্ত্রীর ওপর তোমাদের অধিকার আছে, এবং তাদের তোমার ওপর অধিকার আছে”। এ বাণীতে স্পষ্ট যে, স্বামী-স্ত্রী পারস্পরিক অধিকার ও দায়িত্ব সমানভাবে নিতে হবে; একে অপরকে উদারতা, সম্মান ও দায়িত্বের অনুভূতি দিয়ে সেবা করতে হবে।
স্ত্রীর দায়িত্বও ইসলামে গুরুত্ব পেয়েছে। তিনি স্বামীর অভাবে দায়িত্বপূর্ণ সার্বক্ষণিকতা বজায় রাখতে, স্বামীকে সম্মান রেখে সংসার পরিচালনায় সহায়তা করতে উৎসাহিত হয়েছেন। এই পরস্পর নির্ভরশীল নীতিমালা অনুসারে, স্বামীর অর্থনৈতিক ও মানসিক দায়িত্ব পালন এবং স্ত্রীর তার স্বামীর সম্মান-গোপনীয়তা রক্ষা উভয়েই দাম্পত্য জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আধুনিক যুগে দাম্পত্য সম্পর্কের সমস্যা যেমন দায়িত্ব ও কর্তব্যের অবহেলা বা অসম বণ্টন – ইসলাম সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে উভয় পক্ষকে শৃঙ্খলাবদ্ধ ও পরস্পরকে সহায়তার আহ্বান জানায়।
আধ্যাত্মিক বন্ধন ও উন্নতি
ইসলামে দাম্পত্য সম্পর্ককে একটি আধ্যাত্মিক যাত্রা হিসেবেও দেখা হয়। দম্পতি আল্লাহর প্রতি দায়বদ্ধতা সঙ্গে নেয়ার মাধ্যমে পরস্পরকে ধর্মচর্চায় উৎসাহিত করে, সন্তানদের সৎকর্মে শিক্ষিত করে। কুরআনে সম্মুখপটে বলা আছে, “হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের কাছে আমাদের স্ত্রী ও সন্তানদের এমন আয়েশ-শান্তি দান কর, যে আমাদের চোখের জ্যোতি হবে”। অর্থাৎ দাম্পতি ও তাদের সন্তানকে যেন আল্লাহর বরকতপ্রাপ্ত আনন্দ এবং নৈতিক উন্নতির অধিকারী করা হয়।
বিবাহ কেবল দৈহিক সঙ্গম নয়, বরং আধ্যাত্মিক বন্ধন ও সুষম চরিত্র নির্মাণের মাধ্যম। নবীজির প্রেরণায় স্ত্রী-স্বামী পরস্পরকে ইবাদত ও নেক আমল থেকে আলাদা রাখায় ভুলপ্রয়াস পূর্ণ সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, “যে স্বামী শপথ করে যে স্ত্রীর বালতি বা তার সামনে কল দেব, এবং সেই স্ত্রী তা অস্বীকার করে, তখন সকালে ফেরেশতারা তাকে লাঞ্ছিত করে”। (এমন বাণী অত্যন্ত শক্তিশালীভাবেও শোনা গেছে; তবে প্রধান সংকেত, যে বিবাহিত যুগল পরস্পরকে ইসলামী কর্তব্য পালনে উৎসাহ দিতে থাকবে, শারীরিক সম্পর্ককে আল্লাহর নিষিদ্ধ থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে গ্রহণ করবে।)
ইসলাম সবসময় স্মরণ করায়: বিবাহের মূল উদ্দেশ্য হল আত্মিক পরিপূর্ণতা এবং পরকালীন মুক্তির লক্ষ্য অর্জন। নবীজির হাদীস অনুযায়ী, বিয়ের চারটি উদ্দেশ্যের মধ্যে সেরা হল ভদ্রচরিত্র নারী (সংক্রান্ত দাম্পত্যের ধর্মীয় প্রভাব) নির্বাচন। এ হাদীসে বলা হয়, নারীর বিবাহিত হওয়ার কারণ হতে পারে সৌন্দর্য, সম্পদ, সামাজিক মর্যাদা; কিন্তু সবচেয়ে উত্তম দাম্পত্য ঐ নারী নির্বাচন, যার দ্বীন দৃঢ়। অর্থাৎ ইসলামী মূল্যবোধে সাফল্যমণ্ডিত দাম্পত্যের মাপকাঠি হল পারস্পরিক দ্বীনাত্মক বন্ধন।
বর্তমান সময়ে পারিবারিক জীবন নানান আধুনিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। ভোগবাদী মনোভাব ও বস্তুবাদ দাম্পত্য সম্পর্ককে দুর্বল করে তুলতে পারে। অনেক দম্পতি অহেতুক উপসর্গের কারণে দূরত্ব তৈরি করে ফেলেন, বা নিজের ক্যারিয়ারকেন্দ্রিকতার চাপে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে ব্যর্থ হন। ইসলাম এমন পরিস্থিতিতে সম্প্রীতি বজায় রাখতে দায়িত্ব ও বিশ্বাসের ওপর জোর দেয়। আল্লাহ অভিভূত স্রষ্টা, তিনি মানুষকে উপদেশ দিয়েছেন যৌথ জীবনকে আল্লাহর সন্তুষ্টির দিকে পরিচালিত করার জন্য। মানসিক ও আধ্যাত্মিক বন্ধন দৃঢ় করতে দাম্পত্যে নিয়মিত আল্লাহর স্মরণ ও দোয়া অপরিহার্য।
উপসংহার
ইসলামে দাম্পত্য একটি পূর্ণাঙ্গ দ্বীনের অংশ, যেখানে ভালোবাসা, কর্তব্য এবং আধ্যাত্মিকতা একযোগে বেষ্টিত থাকে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আন্তরিক ভালোবাসা ও মমতা, উদারতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন, এবং আল্লাহর পথে একসঙ্গে চলার মধ্য দিয়েই দাম্পত্য সম্পর্ক দৃঢ় এবং পবিত্র হয়। আধুনিক জীবনের চ্যালেঞ্জ যেমন আবেগগত বিচ্ছিন্নতা, দায়িত্বহীনতা ও বস্তুবাদ ইত্যাদিকে মোকাবেলায় ইসলামী মূল্যবোধগুলি অপরিহার্য গাইডলাইন হিসেবে কাজ করে। কুরআনে আল্লাহ তাআলা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে পরস্পরের প্রতি ভ্রাতৃত্ব ও দয়ার বন্ধন বলে উল্লেখ করেছেন, যা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় দাম্পত্যের মর্যাদা ও গুরুত্ব। তাই মুসলিম দম্পতি কর্তৃক পরস্পরের প্রতি দয়া, সম্মান ও দ্বীনি ত্যাগের চর্চা যখন জীবনের মূল ভিত্তি হবে, তখনই স্বামী-স্ত্রীর জীবন হবে সুখময় ও সমৃদ্ধ।
তৌসিফ রেজা বর্তমানে কেরালার দারুল হুদা ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর স্তরের গবেষক। সমসাময়িক ইসলামি চিন্তাধারা, ইতিহাস ও সমাজ-সংস্কৃতি নিয়ে তার গভীর আগ্রহ রয়েছে। সে নিয়মিতভাবে বিভিন্ন সাময়িকী ও পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখে থাকে, যেখানে ধর্ম, সাহিত্য ও সমাজের জটিল প্রশ্নগুলোকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করে।