আল্লাহর পরিক্ষা ও নাবির সুন্নাত কোরবানী
মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তাআলা তিনার প্রতেকটি বান্দা বান্দিকে কোনো না কোনো বিপদ বা কোনো ক্ষতির মাধ্য়ম দ্বারা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা নেন। এর দ্বারা আল্লাহ তাআলা সবর বা ধৈর্যধারনের ক্ষমতা পরীক্ষা করেন - বান্দা তাঁর মালিকের কাছে কি আবেদন জানাচ্ছে এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করে কিনা? মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআন মাজিদের মধ্য়ে ইরশাদ করছেন-
وَلَنَبْلُوَنَّكُم بِشَىْءٍۢ مِّنَ ٱلْخَوْفِ وَٱلْجُوعِ وَنَقْصٍۢ مِّنَ ٱلْأَمْوَٰلِ وَٱلْأَنفُسِ وَٱلثَّمَرَٰتِ ۗ وَبَشِّرِ ٱلصَّـٰبِرِينَ
“এবং নিশ্চয় আমি তোমাদেরকে ভয়, ক্ষুদা, ধন, প্রাণ এবং ফল ফসলের দ্বারা পরিক্ষা করব এবং এই সমস্ত ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ প্রদান করা।” সুরাহ বাকারাহ – 155
পরিক্ষা মূলত দুই ধরনের প্রথমত উন্নতি ও মঙ্গলের দ্বারা, দৃতীয়ত অবনিত ও অমঙ্গলের দ্বারা। তথা রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তাআলা নাবী ও রাসুল এবং সমস্ত সাধারণ মানুষদেরকেউ পরিক্ষা করেন। কোরবানী মুসলিমদের জন্য মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তাআলাহর নৈকট্য লাভের প্রত্য়সা মূলক একটি মহৎ ইবাদত। ইসলামে কোরবানির অর্থ হলো, আল্লাহ তায়ালার সন্তষ্টি ও নৈকট্য অর্জনের জন্য শরীয়তের নির্দেশিত শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত কোন প্রিয় বস্তু তথা পালিত পশু আল্লাহ তায়ালার দরবারে পেশ করা।
ঈদুল আযহায় পশু কোরবানি করার প্রথার সাথে হজরত ইব্রাহিম (আ.) এবং তাঁর পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.)- এর গল্পের উল্লেখযোগ্য সম্পর্ক রয়েছে। এই ঘটনাটি পবিত্র কোরানে লিপিবদ্ধ আছে এবং এটি ইব্রাহিমের স্বপ্নের গল্প বলে যেখানে তিনি নিজে তাঁর পুত্রকে কোরবানি দিতে দেখেছিলেন। ইসমাইল যখন তাঁর আব্বার সাথে চলাফেরা করার জন্য যথেষ্ট বৃদ্ধ হয়ে ওঠে, তখন ইব্রাহিম (আ.) তাঁর সাথে তাঁর স্বপ্নের কথা জানায় এবং তাঁর মতামত জানতে চায়। ইসমাইল উত্তর দিয়েছিলেন যে তাঁকে যেভাবে আদেশ করা হয়েছিল সেভাবেই করা উচিত এবং তিনি ঈশ্বরের ইচ্ছার উপর আস্থা রেখে ধৈর্য্য ধরে থাকবেন। যখনইব্রাহিম (আ.) এবং ইসমাইল কোরবানি করেছিলেন, তখন আল্লাহ ইব্রাহিমকে ডেকেছিলেন এবং তাঁর বিশ্বস্ততা স্বীকার করেছিলেন। আল্লাহ তাঁকে তাঁর ধার্মিকতার জন্য পুরস্কৃত করেছিলেন এবং তাঁর ভক্তির একটি সুস্পষ্ট পরীক্ষা প্রদান করেছিলেন। ইভেন্টটি আল্লাহর প্রতি বশ্যতা ও আনুগত্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে এবং এটি মুসলমানদের তাদের জীবনে বিশ্বাস, আস্থা এবং ত্যাগের গুরুত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সম্পূর্ণ গল্পটি নিম্নে তাত্তাবধন রয়েছে!
কোরবানীর ইতিহাস
এই কোরবানী প্রন্থাটি হযরত আদাম আলাইহি সালাম এর যুগ থেকে চলিতমান হয়ে রয়েছে। প্রথমত আদাম আলাইহি সালামের দুই পত্র যখন বিয়ের আলোচনায় ঐকত্ত্য় মতামত না হওয়ার কারনে ঝগড়া এর ফলে আল্লাহর নির্দেশত কোরবানী হুকুমে আদম আলাইহি সালাম তিনার দুই পত্রকে কোরবানী করার নির্দেশদেন যথাযত ভাবে হাবিলের কোরবানী কবুল করেন আল্লাহ। (সুরা মায়েদা, আয়াত নং ২৭- ৩১)। পরবর্তি সকল নবীদের শরীয়তেই কোরবানির বিধান ছিল। তবে প্রত্যেক নবীদের সময়ে কোরবানির পন্থা ভিন্ন ছিল। ( সুরা হজ্জ, আয়াত ২২/৩৪)
অবশেষে কেয়ামত পর্যন্ত সকল জাতির জন্য একই বিধান চলমান রয়েছে, যা বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর মাধ্যমে প্রাপ্ত শরীয়ত অর্থাৎ কুরআন সুন্নাহর বিধান। এই সময়ে আমাদের উপর যে কোরবানির পদ্ধতি চলমান তা হযরত ইবরাহিম আঃ এর শরীয়ত থেকে এসেছে। যেমনটি বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলআইহি ওয়া সাল্লামের হাদিস থেকে জানতে পারি যে, সাহাবারা প্রশ্ন করেছিলেন কোরবানি কি? ইয়া রাসুলুল্লাহ? তখন আল্লাহর রাসুল সাঃ উত্তর দিলেন ইহা তোমাদের পিতা ইবরাহিম (আঃ) এর সুন্নাত। (মিশকাত, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমাদ)।
কোরবানির তাৎপর্য্য বা গুরত্ব কোরবানী হলো মুসলিম জাতীর একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ওয়াজিব আমল। ওয়াজিব সেই সমস্ত মুমিন মসলমানদের প্রতি যাদের কাছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত যাকাতের নেসাব পরিমান সম্পদ থাকবে তার জন্য একটি পশু কোরবানি করা ওয়াজিব। আমরা যে কোরবানি করি তা যে মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দান করেছেন তাঁর খলিলুল্লাহ হযরত ইবরাহিম (আঃ) এবং তদ্বয়ি পুত্র ইসমাইল আঃ এর মাঝে সংঘটিত কোরবানির পরিক্ষা থেকে তা যথাযত ভাবে বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে পবিত্র আল কোরআনে। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর এবং পশু কোরবানি কর। (সুরা কাউসার আয়াত ২) হাদিসে বর্ণিত রয়েছে, হে লোক সকল প্রত্যেক( সামর্থ্যবান) পরিবারের উপর কোরবানি দেয়া অপরিহার্য্য। (সুনান ইবনে মাজাহ হাদিস নং ৩১২৫)।
হযরত আবু হুরায়রা( রাঃ) থেকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যাক্তি সামর্থ্য থাকা সত্তেবও কোরবানি করেনা সে যেন আমাদের ইদগাহে না আসে। (মুসনাদে আহমাদ, ইবনে মাজাহ হাদিস নং ৩১২৩)।
আমরা মসলিম জাতী যে কোরবানী করি অর্থাৎ পশু বা প্রণী জবাহ করি তার রক্ত এবং গোশত মহান রব্বুল আলামিনের নিকটে পৌছায় কী তার সমন্ধে আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে আল্লাহ ইরশাদ করেন, আল্লাহর নিকট এসব পশুর রক্ত ও গোশত পৌছায় না, তাঁর নিকট পৌছে তোমাদের তাকওয়া (সুরা হাজ্জ, আয়াত ৩৭)।
আল্লাহর পরীক্ষা
সুতরাং, আল্লাহ তায়ালা আমাদের বলেন যে হযরতইবরাহিম (আঃ) একটি ধৈর্যশীল ছেলে সম্পর্কে কিছু ভাল খবর দেওয়া হয়েছে. পুত্র তাঁর পিতার সাথে চলতে সক্ষম হওয়ার সাথে সাথে ইব্রাহিম (আ.) উল্লেখ করেছিলেন যে তিনি একটি স্বপ্ন দেখেছিলেন যেখানে তাঁকে তাঁর পুত্রকে কুরবানী দিতে হবে। তিনি তাঁর ছেলে হজরত ইসমাইলকে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি এ বিষয়ে কী ভাবছেন এবং ইসমাইল উত্তর দিলেন যে, আল্লাহ যা আদেশ করেছেন তাঁকে তা করতে হবে এবং তিনি ধৈর্য ধরবেন। তারা উভয়েই সম্মত হন এবংইব্রাহিম (আ.) ইসমাইলকে জবাই করার জন্য শুইয়ে দেন। অতঃপর আল্লাহ ইব্রাহিমকে ডেকে বললেন যে তিনি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন এবং তাঁর স্বপ্নকে সত্য করেছেন। তাদের একটি বড় কোরবানির পশু দেওয়া হয় এবং তাদের স্মরণে কুরবানী অব্যাহত রাখা হয়।
ইব্রাহীমের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। এভাবেই আল্লাহ সৎকর্মশীলদের পুরস্কৃত করেন। আল্লাহ আসলে তাঁর ছেলেকে কোরবানি দিতে চাননি। উদ্দেশ্য ছিল পিতা-পুত্র উভয়কেই পরীক্ষা করা।ইব্রাহিম (আ.) যখন তাঁর ছেলেকে কোরবানি করার স্বপ্ন দেখেন, তখন তিনি তাঁর স্ত্রী হাজেরাকে তাদের ছেলেকে প্রস্তুত করতে এবং তাঁকে সুন্দরভাবে সাজাতে বলেছিলেন। তিনি তাঁকে কোথাও নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। তবে শয়তান হাজেরা ও ইসমাঈলকেও ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। ঐতিহাসিকরা বলেন যে শয়তান ইব্রাহিমকে তিনবার বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু প্রতিবারই সে তাকে তাড়ানোর জন্য সাতটি পাথর নিক্ষেপ করেছিল। বার্ষিক হজ যাত্রার সময় এই ঘটনাটি এখনও স্মরণ করা হয়।
ইব্রাহিম (আ.) তাঁর ছেলেকে তাঁর স্বপ্নের কথা বললেন এবং তাঁর মতামত জানতে চাইলেন। ছেলেটি উত্তর দিল, "বাবা, আপনি যদি তাই করেন তাহলে আমি ধৈর্য ধরব।" (সূরা সাফফাত: 102) পিতা ও পুত্রের আলোচনা এবং পুত্র রাজি হওয়ার পর,ইব্রাহিম (আ.) তাঁর কলিজা একটি টুকরো আল্লাহর উদ্দেশ্যে কোরবানি হিসাবে রেখে যান। অতঃপর পিতা-পুত্র উভয়ে একমত হলে হজরতইব্রাহিম (আ.) তাঁর পুত্রকে শুইয়ে দেন। ছেলে এমনকি তাঁর বাবাকে বলি দেওয়ার আগে তাঁর চোখ বন্ধ করতে বলেছিল, যাতে সে খুব বেশি উদ্বিগ্ন না হয় এবং প্রক্রিয়াটিকে বিরক্ত না করে। ইব্রাহিম, যিনি ঈশ্বরের প্রতি তাঁর ভক্তির জন্য পরিচিত ছিলেন, তিনি এগিয়ে গিয়ে তাঁর ছেলের ঘাড়ে ছুরিকাঘাত করেছিলেন, যা বিশ্বকে হতবাক করেছিল। এটি অবশ্যই একটি অনন্য ঘটনা ছিল এবং এটি আবার ঘটবে কিনা কে জানে। সুতরাং, পুরানো মিনা মরুভূমিতে এমন ঘটনা ঘটেছিল। ইমাম সুদ্দি (র.) কথা বলেছেন কিভাবে আল্লাহ হজরত ইব্রাহিম (আ.)-কে তাঁর ছেলেকে কোরবানি করতে বলেছিলেন এবং তাঁকে এটি করার জন্য একটি ছুরি দিয়েছিলেন। কিন্তু যখনইব্রাহিম (আ.) (আ.) ছুরি ব্যবহার করার চেষ্টা করেছিলেন, তখন তা কাজ করেনি।
এমন এক সময়ে যখন সমগ্র বিশ্ব স্তম্ভিত এবং বিস্মিত হয়ে পড়েছিল, এমন একটি মুহূর্ত আসে যখন আল্লাহ, সর্বশক্তিমান, তাঁর গোপন রহস্য উন্মোচন করার সিদ্ধান্ত নেন। ফেরেশতা জিবরাঈল (আঃ) এর মাধ্যমে, তিনিইবরাহিম (আঃ)-এর পুত্র ইসমাঈলকে উদ্ধারের জন্য জান্নাত থেকে একটি অলৌকিক মেষশাবক প্রেরণ করেছিলেন। এই ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপে, ইব্রাহিমের অজান্তেই ভেড়ার বাচ্চাটি আল্লাহ নিজেই কোরবানি করেছিলেন।
এই প্রত্যাদেশটি ইব্রাহিমের অটল বিশ্বাস এবং তাঁর প্রভুর প্রতি আস্থার প্রমাণ হিসেবে কাজ করেছিল। আল্লাহ ইব্রাহিমের প্রশংসা করে বললেন, "হে ইব্রাহিম, তুমি স্বপ্নের সত্যতা প্রমাণ করেছ এবং অবিশ্বাস্য ভক্তি দেখিয়েছ। এভাবেই আমি তাদের পুরস্কৃত করি যারা ধার্মিক ও অবিচল থাকে। প্রকৃতপক্ষে, এটি ছিল তোমার বিশ্বাস ও আনুগত্যের স্পষ্ট পরীক্ষা। এবং আপনার ব্যতিক্রমী আত্মত্যাগের ফলস্বরূপ, আমি আপনাকে প্রচুর আশীর্বাদ দান করেছি এবং আপনাকে যে কোনও বোঝা থেকে মুক্ত করেছি।" 104 থেকে 107 আয়াত পর্যন্ত সূরা সাফ্ফাত (র্যাঙ্কের অধ্যায়) তে পাওয়া এই গভীর আয়াতগুলি, ঘটনাগুলির উল্লেখযোগ্য মোড়কে হাইলাইট করে যা উন্মোচিত হয়েছে, পরীক্ষার মুখে ন্যায়পরায়ণতা এবং অটল বিশ্বাসের জন্য ঐশ্বরিক স্বীকৃতি এবং প্রশংসার উপর জোর দেয়।
REFERENCE:
https://www.icsbook.info/read-full-book/327