সুশ্রায়ী বিশ্বের জন্য ইসলামিক মূল্যবোধ: পরিবেশগত নীতি ও কর্মের কালজয়ী নির্দেশিকা
পূর্বকথা
“তুমি ব্যাতীত এই পরিবেশ টিকে যাবে, তবে পরিবেশ ব্যাতীত তুমি টিকতে পারবে না।”
প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী ৫ই জুন ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ হিসেবে উৎযাপিত হয়। কিন্তু কী এই পরিবেশ? পরিবেশকে ইংরেজি ভাষায় Environment বলা হয়। যেই শব্দের উৎপত্তি হল ফরাসি শব্দ Environer / Environner থেকে যার অর্থ হল "প্রতিবেশী"। অতএব আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে; যেমন- আকাশ-বাতাস, জল, স্থল, বায়ু, জীবজন্তু, পশুপাখি, উদ্ভিদপ্রাণী, গাছপালা, নদীনালা, সাগর-মহাসাগর, পাহাড়পর্বত, মরুভূমি, হ্রদ, পুকুর, স্কুলকলেজ, হাসপাতাল ইত্যাদি উপাদান নিয়ে গঠিত হয় এক সুষ্ঠ পরিবেশ। বিশেষ করে জল, স্থল, বায়ু এই তিনটি পরিবেশের নিতান্ত অপরিহার্য উপাদান। আর এগুলো সবই মহান আল্লাহর অপূর্ব নেয়ামত। পরিবেশের এই উপাদানগুলির সহিত মানব জীবনের সম্পর্ক অতি নিবিড়। কেননা কেবলমাত্র সুস্থ পরিবেশেই সুস্থ জীবনযাপন সম্ভব। কিন্তু আজ এই সকল উপাদানই দূষিত।
সুতরাং, মানুষ আজ বুছতে পেরেছে যে, পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী কেবল মানুষই। অতএব আত্ম-বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার সমস্ত ব্যবস্থাই তাদেরই গ্রহন করতে হবে। তাই আমরা আজ এই দূষিত পরিবেশকে রক্ষার নিমিত্তে নানাবিধ উদ্যোগ নিয়েছি। উদাহরণস্বরুপ, বিশ্ব পরিবেশ দিবস, পৃথিবী দিবস, বনমহাউৎসব ইত্যাদি ইত্যাদি। এর মধ্যে সারা বিশ্বে একটি ব্যাপক জনপ্রিয় অনুষ্ঠান হল "বিশ্ব পরিবেশ দিবস" বা "ইকো দিবস" যা প্রতি বছর ৫ই জুন পালিত হয়। এটি সর্বপ্রথম ৫ই জুন ১৯৭২ সালে “Only One Earth” (একটিই মাত্র পৃথিবী) থিমে সুইডেনের স্টকহোমে উদযাপিত করা হয় যার নেতৃত্বে ছিল জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (UNEP)। এই অনুষ্ঠানে বহু দেশ এমনকি ভারতও উপস্থিত ছিল। সেই থেকে এটি প্রতি বছর ৫ই জুন বিশ্বব্যাপি উদযাপিত হতেই থাকছে। এই বছর অর্থাৎ ২০২৫শে এই ৫২তম বিশ্ব পরিবেশ দিবস হিসেবে রিপাবলিক অফ কোরিয়ার নেতৃত্বে পালিত হচ্ছে। যার মূল থিম “Ending Plastic Pollution” প্লাস্টিক দূষন সমাপ্তি করো রাখা হয়েছে। থিমটি রাখার মূল কারণ....
পরিবেশকে রক্ষার নিমিত্তে অন্যতম আরও একটি উদ্যোগ হল বনমহোৎসব যেটি সর্বপ্রথম ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে পালিত করা হয়। সরকারি আনুকুল্যে ও সহযোগিতায় আজ তা সাধারণের উৎসবে পরিণত হয়েছে। এই উপলক্ষে বিমামুল্যে নানারকম বৃক্ষের চারা বিতরণ করা হয়। তাছাড়া সরকার নতুন নতুন বনাঞ্চল সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়েছেন। সমাজভিত্তিক বন সৃজন প্রকল্প যথেষ্ট কার্যকরী হয়েছে। কোনো কোনো স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানও বৃক্ষ রোপণের কাজে এগিয়ে এসেছে।
অর্থাৎ বোঝা গেল যে, পরিবেশকে সংরক্ষনের নিমিত্তে এমনই নানাবিধ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে ও হচ্ছে কিন্তু এই সকল কিছুই কেবলমাত্র কয়েকবৎসর বা কয়েকদশক থেকে আরম্ভ হয়েছে অথচ ইসলাম এই পরিবেশেকে সংরক্ষনের প্রসঙ্গে আজ থেকে চৌদ্দশত বৎসর পূর্বেই সবিশেষ বৃত্তান্ত দিয়েছিল। যেহেতু ইসলাম একটি সার্বজনীন ধর্ম। এতে রয়েছে মানবজীবনের পূর্ণাঙ্গ চলার পাথেয়। ইসলামে যেমন ইবাদতের বেশ তাৎপর্য রয়েছে, তেমনি রয়েছে পরিবেশেরও গুরুত্ব। কোন পরিবেশে বসবাস করলে মানুষের সুবিধা হবে বা মানুষ সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে পারবে, ইসলাম তা সুনিশ্চিত করেছে। যেমনকি সৈয়দ আলতাভী (রঃ) বলেন, আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের মধ্যে পাঁচ শতবারেরও অধিক পরিবেশ সংরক্ষন এবং দূষনমুক্ত করার জন্য উৎসাহিত করেছেন। তাই পর্যাবেক্ষণের মাধ্যমে এই নিবন্ধটিতে ইসলাম পরিবেশ রক্ষা প্রসঙ্গে কী বলেছে ও কীভাবে দূষনমুক্ত করতে মূখ্য ভূমিকা পালন করছে তা তুলে ধরা হয়েছে ।
ভূমিকা
অদ্য মনে হচ্ছে যেন বিশ্ব জগৎ জলজ্যান্ত অগ্নির ন্যায় উত্তপ্ত হয়ে জলছে। উন্মাদ পাগলের মত উৎপাত করছে। যার উল্লেখযোগ্য কারনগুলি হল বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, বন উজাড়, জলদূষন, বায়ুদূষন, স্থলদূষন, শব্দদূষন, প্রাকৃতিক সম্পদ হ্রাস, বর্জ্য নিষ্কাশন, জলবায়ু পরিবর্তন, জীব বৈচিত্র্যের বিপন্ন, সমুদ্রের অম্লীকরণ, ওজোন স্তর হ্রাস, অ্যাসিড বৃষ্টি ইত্যাদি ইত্যাদি। এরইহেতু, পরিবেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিঘ্নিত হচ্ছে এবং ফলাফলে অনেক পরিবেশগত সংকটের সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
কিন্তু এই সকল কিছুর জন্য দায়ী কে? এর উত্তর আমরা মহাগ্রন্থ কুরআন থেকেই পেয়ে থাকি। আল্লাহ তায়ালা বলছেন, ‘মানুষের কৃতকর্মের ফলেই সমুদ্র ও স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে’ (সূরা আর রুম : ৪১)। আর এটিই তো প্রকৃতপক্ষে সত্য, আমাদের নিত্য কাজকর্মের দরুণ তো এমনটি হয়েছে। আমরা আজ নিজেদের চাহিদা মেটাতে বনজঙ্গলকে উজাড় করে দিচ্ছি ও গড়ে তুলছি আত্মঘাতী সভ্যতা, জমিক্ষেতে অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার, কীটনাশক দ্রব্যাদির প্রয়োগ করছি, কলকারখানার নোংরা জল নদীনালায় ফেলছি, বাজিপটকা বিস্ফোরন করছি, যানবাহন চালিয়ে ক্ষতিকারক গ্যাস NOx, কার্বন নির্গমন করছি, ফ্রিজ/রেফ্রিজারেটর ও এয়ার কন্ডিশন (AC) ব্যবহারের ফলে ক্লোরোফ্লরোকার্বন (CFC) অতিমাত্রায় বেড়ে চলেছে যেটি ওজোন স্তরের ক্ষতির জন্য দায়ী। এমনকি এইসব কৃতকর্মের ফলে আমরা আজ নানা রোগে জর্জরিত হচ্ছি যেমন- যক্ষা, হাপানি, শ্বাসরোগ, ক্যানসার, বিভিন্ন চর্মরোগ, ইমফ্লুয়েঞ্জা, কলেরা, জন্ডিস, রক্তচাপ বৃদ্ধি, হৃদরোগ প্রভৃতি। যত্রতত্র অম্ল বৃষ্টি বর্ষিত হচ্ছে ও জমির উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে, মৎস ও জলচর প্রাণীরা মারা যাচ্ছে, আবহাওয়া পরিবর্তন হচ্ছে, নানাবিধ পশুপাখি, জীবজন্তুরা লুপ্ত পাচ্ছে, জীব বৈচিত্র্যের ক্ষতি হতেই চলেছে ইত্যাদি।
এমনকি পূর্বে যেমনটা গ্রাম-শহরের সমস্ত চায়ের দোকানে মাটির পাত্র ব্যবহার করা হত, প্রায় বাড়িতে মাটির পাত্রে ভাত কিংবা নানা শাক-সব্জী রান্না করা হত, বিয়ের অনুষ্ঠানে শালপাতা নয় তো কলা বা পদ্ম পাতা ব্যবহার করা হত, ব্রাশ হিসাবে গাছের জাল-পালা ব্যবহার করা হত, মাটির কলসীতে পানি পান করা হত, ক্যারীব্যাগ হিসেবে পাটের অথবা চামড়ার তৈরি থলে ব্যবহার করা হত, হাত পাখার মত গাছের শাখপাত থেকে তৈরি নানাবিধ শৌখিন ব্যবহার করা হত তেমনটা আজ দেখা যায় না। কিন্তু কোথায় সেই পরিবেশ বান্ধব দ্রব্যাদিগুলি? সকলেই তো আজ আমরা পাশ্চাত্যের সেই আধুনিকতার বিজ্ঞানে গ্রাস হয়ে পড়েছি। ফলস্বরুপ, বিলুপ্তির পথে দৌরাচ্ছে দেশীয় শিল্পগুলি, হারিয়ে যাচ্ছে মোদের দেশীয় সংস্কতীর পরিচয়ও। আর সত্যিই এটি একটি দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা।
সুশ্রায়ী বিশ্বের জন্য ইসলামিক মূল্যবোধ
.........প্রথমত, এই প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তায়ালা কোরআনে ঘোষনা করছেন যে, "আর আমি পৃথিবীকে বিস্তৃত করেছি এবং তাতে পর্বতমালা স্থাপন করেছি এবং তাতে সর্বপ্রকার সুষম বস্তু উৎপন্ন করেছি" (১৫:১৯) অর্থাৎ, আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীতে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় ও জীব জগতের অস্তিত্ব রক্ষায় সৃষ্টি করেছেন গাছপালা ও পর্বতমালা। এবং অন্যত্রে আরও বলছেন যে, "তিনিই (আল্লাহ) তোমাদের জন্য পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা সমস্তই সৃষ্টি করেছেন ..." (সূরা বাকারা:২৯) অতঃপর তিনি মানুষ্যজাতিকে সতর্ক করে যেন বলছেন, ‘তোমরা নিজেদের ধ্বংস নিজেরা ডেকে এনো না।’ (সুরা বাকারা: ১৯৫) অন্যত্রে তিনি বলছেন, “…দুনিয়াতে বিপর্যয় ছড়ানোর চেষ্টা করোনা, নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের পছন্দ করেন না”। (সুরা কাসাস-৭৭) তিনি আবারও বলছেন, “যখন সে ফিরে যায় তখন সে পৃথিবীতে তার সমস্ত প্রচেষ্টা-সাধনা নিয়োজিত করে বিপর্যয় বা অশান্তি সৃষ্টি এবং শস্যক্ষেত ও জীবজন্তু বিনাশ করার কাজে। অথচ আল্লাহ বিপর্যয় মোটেই পছন্দ করেন না”। (সূরা বাকারা : ২০৫)। সুতরাং, উপরোক্ত আয়াতগুলিতে এটিই বলা হচ্ছে যে, মানবকূলের জন্যই এই বসুন্ধরা অর্থাৎ তোমরা তাতে কোনো বিপর্যয় ছড়ায়ো না বরং পরিবেশকে ধ্বংশ করা হতে বিরত থাকো এবং তাকে সংরক্ষন করো।