আবারও ঐতিহাসিক ছাত্র আন্দোলনের প্রত্যক্ষদর্শী বাংলাদেশ
কোটা সংস্কারের দাবিতে সারা বাংলাদেশে কয়েক হাজার শিক্ষার্থীর নেতৃত্বে ব্যাপক বিক্ষোভের ধারাবাহিকতা দেখা দিচ্ছে। তবে ক্ষমতাসীন সরকারের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সঙ্গে সংঘর্ষে তা সহিংস রূপ নেয়। প্রশাসনিক চাপ এবং আন্তর্জাতিক আগ্রহের অভাবের কারণে মূলধারা সংবাদ মাধ্যমে কভারেজ খুবই কম। এই প্রবন্ধে উক্ত ছাত্র প্রতিবাদ তার কারণ এবং প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করা হবে। দুই বিরোধী দলের সংঘর্ষের কারণে সূত্র অনুসারে প্রায় এখন শতাধিক ছাত্র আহত এবং প্রায় পাঁচ জন শিক্ষার্থী নিহত।
অনেকের মতে ১৯৫১ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির পর এমন বৃহৎ ছাত্র প্রতিবাদ প্রথমবারের মত দেখা যাচ্ছে যখন তত্কালীন সরকারের জোরপূর্বক উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে ছাত্ররা তাদের বাংলা মাতৃভাষার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মত্যাগ করেছিল। দিনটি এখন জাতিসংঘ কর্তৃক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
কোটা নীতি এবং ছাত্র প্রতিবাদ
প্রতিবাদী ছাত্র-ছাত্রীদের দাবি কোটা নয়, মেধা হোক চাকরি ক্ষেত্রের প্রধান স্থিতিমাপ যেহেতু বাংলাদেশের কোটা নীতি অনুসারে শুধুমাত্র ৪৪ শতাংশ চাকরি মেধা ভিত্তিক এবং অবশিষ্ট অর্ধেকেরও বেশি ৫৬ শতাংশ বিশেষ শ্রেণির জন্য সংরক্ষিত। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য ৩০ শতাংশ, মহিলাদের জন্য ১০ শতাংশ, জেলা কোটা ১০ শতাংশ, জাতিগত সংখ্যালঘুদের জন্য ৫ শতাংশ এবং শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য ১ শতাংশ।
তবে এই ছাত্র আন্দোলন সম্পন্ন কোটা নীতি পরিবর্তনের জন্য নয় বরং কিছু সংস্করণমূলক উদ্দেশ্য নিয়ে পরিচালিত। তাদের প্রধান দাবি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য অতিরিক্ত সংরক্ষণ বন্ধ করা হোক যার কারণে আসল মেধা দেশের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে।
কেন এবং কখন থেকে
গত প্রথম জুলাইয়ে বাংলাদেশের হাইকোর্ট ১৯৭১ সালে দেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী যোদ্ধাদের সন্তান-সন্ততিদের জন্য সরকারি উচ্চ পরিষেবায় এক-তৃতীয়াংশ পদ সংরক্ষিত চাকরির কোটা পুনর্বহাল করার সাথে সাথে প্রতিবাদী ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ শুরু হয়।
তবে, ছাত্র লীগ, ক্ষমতাসীন সরকারী আওয়ামী লীগের ছাত্ররা, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিবাদী ছাত্রদলের সামনাসামনি হলে বিক্ষোভ সহিংস হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি এখন এমন যে দুটি ছাত্র দলের মধ্যে গৃহযুদ্ধের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। দাঙ্গা পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে, যদিও তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দমন করার অভিযোগ উঠেছে। ছাত্র ও পুলিশ বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনাও দেখা যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি মন্তব্য ছাত্রদের ক্ষুব্ধ করেছে এবং তাদের ক্ষোভের স্ফুলিঙ্গ আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য এবং ছাত্রগোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়া
শেখ হাসিনা বলে বসেন, "মুক্তিযুদ্ধ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরা কোটা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিরা কোটা পাবে? তা তো আমরা দিতে পারি না।"
আসলে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে 'রাজাকার' একটি অবমাননাকর ব্যবহার যা দেশদ্রোহীদের বোঝায় যারা ৭১-এর মুক্তি সংগ্রামে পাকিস্তানের সমর্থন করে এবং নিরীহ বাঙালিদের উপর অত্যাচার চালায়।
যদিও সংরক্ষণ বিরোধী আন্দোলনকারীদের সম্পর্কে প্রকাশ্যভাবে নাও হয়, প্রধানমন্ত্রীর 'রাজাকার' শব্দ প্রয়োগ ছাত্রগোষ্ঠী তাদের অপমান হিসেবে নিয়েছে। হয়তো এই শব্দের মাধ্যমে বর্তমান আন্দোলনকে বাংলাদেশী হীতের বিপক্ষ মার্কা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে।
প্রতিবাদী ছাত্রদল এর প্রতিক্রিয়ায় বিক্ষোভ আরও জোরালো করে এবং এটাকেই স্লোগান বানিয়ে বেদনামূলক আহ্বান শুরু করে: 'আমি কে, তুমি কে - রাজাকার রাজাকার', 'চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার'।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন কলেজ ও উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংরক্ষণ বিরোধী প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকের কথায় ৫১-এর আন্দোলন তো শুনেছি, এবার ২৪-এর ছাত্র আন্দোলন স্বচক্ষে দেখছি। বিভিন্ন কলা সাহিত্য, সংগীত এবং নাটকে সারা দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলন উপস্থাপনা পাচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে সরকারি অনুশোচনায় দেশীয় প্রধান গণমাধ্যম পিছিয়ে থাকলেও, বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে এই ছাত্র প্রতিবাদ যথেষ্ট মনোযোগ পেয়েছে। পরে পরে অন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের অভিযান বড় হেডলাইন বানিয়েছে।
বাংলা ভাষার সাহিত্য সংযোগ
বাংলা ভাষার সাহিত্য সৌন্দর্য সাধারণ জীবনে বেশি প্রদর্শিত। মাঠে, বাড়িতে, ঘাটে এবং দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন স্তরে বাংলা সাহিত্য নিজেকে নতুন রূপে প্রকাশ করে যা সম্ভবত ভাষার ক্ষেত্রে সম্ভব নয়।
অনুরুপ, বর্তমান কোটা-বিরোধী প্রতিবাদ ক্ষেত্রেও স্লোগান এবং গানের মত সাহিত্যিক উপকরণে তৈরি অনেক নতুন প্রতিরোধী কণ্ঠও দেখা যায়। বহু প্রদর্শন মঞ্চে বিভিন্ন কবিদের প্রতিরোধ ডাক শোনা যাচ্ছে বিশেষ করে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের।
জাতীয় কবি নজরুলের বিভিন্ন কবিতার স্তবকগুলো ব্যাপকভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে যেমন-
তোমার ঐ লৌহকপাট,
ভেঙ্গে ফেল কর রে লোপাট,
রক্ত-জমাট শিকল পূজার পাষাণ-বেদী।
ওরে ও তরুণ ঈশান,
বাজা তোর প্রলয় বিষাণ
চটি নিশান উড়ুক প্রাচির প্রাচীর ভেদি।