ওয়াকাফ সংশোধনী বিল: মুসলিম অধিকারের উপর আঘাত নাকি সরকারি ষড়যন্ত্র?
সূচনা:
ওয়াকাফ মুসলিম সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, যা সমাজের কল্যাণে দানকৃত সম্পদ পরিচালনা করে। এই সম্পদের উপর শুধুমাত্র মুসলমানদের অধিকার থাকে এবং এটি ধর্মীয়, সামাজিক ও শিক্ষাগত উন্নতির জন্য ব্যবহৃত হয়। ভারতবর্ষে ওয়াকাফ বোর্ডগুলি কেন্দ্রীয় ওয়াকাফ কাউন্সিলের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। ৪ আগস্ট ২০২৪, বৃহস্পতিবার, সংখ্যালঘু উন্নয়ন মন্ত্রী কিরেন রিজিজু পার্লামেন্টে ১৯৯৫ সালের ওয়াকাফ অ্যাক্টে সংশোধনী আনার জন্য একটি বিল পেশ করেন। এই বিল নিয়ে দেশজুড়ে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়েছে। এই প্রবন্ধে আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব: ওয়াকাফ সংশোধনী বিল কী? এটি কেন পাশ করা হয়েছে? এর পিছনে সরকারের উদ্দেশ্য কী? এবং এটি কীভাবে মুসলিম সম্প্রদায়ের অধিকারের উপর প্রভাব ফেলতে পারে?
ওয়াকাফ কী?
ওয়াকাফ মুসলিম সমাজের একটি মৌলিক ধর্মীয় ও সামাজিক ব্যবস্থা। যে কোনো ব্যক্তি নিজের সম্পদ—জমি, ভবন, স্কুল, মাদ্রাসা, বা অন্য কোনো স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি—আল্লাহর নামে সমাজের কল্যাণে দান করলে তা ওয়াকাফ সম্পদ হিসেবে গণ্য হয়। এই সম্পদের উপর সকল মুসলমানের সমান অধিকার থাকে। ওয়াকাফ সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয় করা নিষিদ্ধ, এবং এটি শুধুমাত্র সমাজের উন্নতির জন্য ব্যবহৃত হয়। উদাহরণস্বরূপ, একটি জমি ওয়াকাফ হিসেবে দান করা হলে তা মসজিদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বা দরিদ্রদের জন্য আশ্রয় নির্মাণে ব্যবহৃত হতে পারে। শরিয়াহ আইন অনুযায়ী, ওয়াকাফ একটি পবিত্র দায়িত্ব, যা সমাজের দীর্ঘমেয়াদি কল্যাণ নিশ্চিত করে।
ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে, ওয়াকাফ ব্যবস্থা শতাব্দী ধরে মুসলিম সমাজে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, এবং দারিদ্র্য বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ভারতে মুঘল আমল থেকে শুরু করে ব্রিটিশ শাসনকালেও ওয়াকাফ সম্পত্তি সমাজের কল্যাণে ব্যবহৃত হয়েছে। আজও ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ওয়াকাফ সম্পত্তি মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য শিক্ষা ও সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী ভিত্তি প্রদান করে।
ওয়াকাফ সম্পত্তি কীভাবে পরিচালিত হয়?
ওয়াকাফ সম্পত্তি মুসলিম সমাজের উন্নতির জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি স্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদ, হাসপাতাল, বা দরিদ্রদের সাহায্যের জন্য নির্ধারিত থাকে। ১৯৬৪ সালে কেন্দ্রীয় ওয়াকাফ কাউন্সিল প্রতিষ্ঠিত হয়, যা দেশের সমস্ত ওয়াকাফ বোর্ডের তদারকি করে। প্রতিটি জেলায় একটি করে ওয়াকাফ বোর্ড থাকে, যেখানে একজন মুতাওয়াল্লি (ইসলামিক জ্ঞানে অভিজ্ঞ ব্যক্তি), একজন রাষ্ট্রীয় বিচার বিভাগের সদস্য, এবং একজন রাষ্ট্রীয় সিভিল সার্ভিসের সদস্য অন্তর্ভুক্ত থাকেন। এই বোর্ডগুলি ওয়াকাফ সম্পত্তির সঠিক ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করে।
ওয়াকাফ বোর্ডের কাজের মধ্যে রয়েছে সম্পত্তির হিসাব রাখা, এর ব্যবহার তদারকি করা, এবং কোনো বিরোধের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। তবে, অতীতে কিছু ক্ষেত্রে ওয়াকাফ বোর্ডের বিরুদ্ধে অব্যবস্থাপনা বা দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, যা বর্তমান সরকার সংশোধনী বিলের পক্ষে যুক্তি হিসেবে ব্যবহার করছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই অভিযোগগুলি কি সত্যিই সংশোধনী বিলের মতো বড় পদক্ষেপের জন্য যথেষ্ট, নাকি এটি অন্য কোনো উদ্দেশ্যের আড়াল?
১৯৯৫ ওয়াকাফ অ্যাক্ট এবং বিতর্ক:
১৯৯৫ সালের ওয়াকাফ অ্যাক্ট ওয়াকাফ সম্পত্তি পরিচালনার জন্য একটি বিস্তৃত কাঠামো প্রদান করে। এই অ্যাক্টের ধারা ৪০ অনুযায়ী, ওয়াকাফ বোর্ড যে কোনো সম্পত্তিকে ওয়াকাফ হিসেবে ঘোষণা করার জন্য তদন্ত করতে পারে। যদি কোনো সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়, তবে মালিককে ওয়াকাফ ট্রাইব্যুনালে প্রমাণ পেশ করতে হয়। অ্যাক্টের আরেকটি ধারায় বলা হয়েছে, ওয়াকাফ বোর্ডের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোনো সাধারণ আদালতে মামলা করা যাবে না। বিজেপি সরকার দাবি করেছে যে এই ধারার অপব্যবহার করে ওয়াকাফ বোর্ড সাধারণ মানুষের সম্পত্তি হাতিয়ে নিচ্ছে।
কিন্তু এই দাবি কতটা সত্য? ধারা ৪০ অনুযায়ী, ওয়াকাফ বোর্ড তদন্ত করতে পারে এবং দলিলপত্র দাবি করতে পারে, তবে তারা সরাসরি কোনো সম্পত্তি দখল করতে পারে না। যদি কোনো সম্পত্তি নিয়ে সন্দেহ হয়, তবে তদন্তের জন্য কেন্দ্রীয় স্তরে একটি দল গঠন করা হয়, এবং তারা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়। এছাড়া, যিনি সম্পত্তির মালিক হিসেবে দাবি করেন, তিনি এক বছরের মধ্যে ওয়াকাফ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ জানাতে পারেন। এই প্রক্রিয়া স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য তৈরি করা হয়েছে। তবে, শরিয়াহ আইনে ওয়াকাফ ঘোষণার জন্য দলিলের প্রয়োজন হয় না, যা কিছু ক্ষেত্রে জটিলতা সৃষ্টি করে। বিজেপি সরকার এই বিষয়টিকে কাজে লাগিয়ে দাবি করছে যে ওয়াকাফ বোর্ডের ক্ষমতা অপব্যবহৃত হচ্ছে।
ওয়াকাফ সংশোধনী বিলের বিস্তারিত আলোচনা:
বিজেপি সরকার এই সংশোধনী বিলের নাম দিয়েছে ইন্টিগ্রেটেড ওয়াকফ ম্যানেজমেন্ট, এমপাওয়ারমেন্ট, ইফিসিয়েন্সি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যাক্ট। এই বিলের মাধ্যমে সরকার দাবি করছে যে তারা ওয়াকাফ সম্পত্তির পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বাড়াতে চায়। তবে, বিলের বিভিন্ন ধারা মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। প্রধান সংশোধনীগুলি হলো:
- ওয়াকাফ বোর্ডের গঠনে পরিবর্তন: প্রতিটি বোর্ডে দুজন মুসলিম মহিলা এবং দুজন অমুসলিম অফিসার অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এই প্রস্তাব মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রশ্ন তুলেছে যে কেন একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে অমুসলিমদের এতটা ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে।
- ওয়াকাফ ঘোষণার শর্ত: শুধুমাত্র সেই ব্যক্তি ওয়াকাফ করতে পারবেন যিনি গত পাঁচ বছর ধরে মুসলিম। এই শর্ত শরিয়াহ আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, কারণ শরিয়াহ অনুযায়ী যে কোনো মুসলিম ব্যক্তি ওয়াকাফ করতে পারেন, সময়সীমার কোনো বাধ্যবাধকতা ছাড়াই।
- তদন্তের ক্ষমতা: বর্তমানে ওয়াকাফ বোর্ড নিজে তদন্ত করতে পারে, তবে নতুন বিলে এই ক্ষমতা জেলা শাসক বা ডেপুটি কমিশনারের হাতে দেওয়া হয়েছে। এটি উদ্বেগের কারণ, কারণ জেলা শাসক কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে কাজ করেন এবং তাদের সিদ্ধান্ত নিরপেক্ষ নাও হতে পারে।
- কেন্দ্রীয় ডাটাবেস: সমস্ত ওয়াকাফ সম্পত্তি কেন্দ্রীয় পোর্টালে নথিভুক্ত করতে হবে। এটি স্বচ্ছতার জন্য উপকারী হলেও, কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধির আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে।
- আইনি প্রক্রিয়া: ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্ত আর চূড়ান্ত থাকবে না। মালিক ৯০ দিনের মধ্যে আদালতে আপিল করতে পারবেন। এটি একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হলেও, জেলা শাসকের হাতে তদন্তের ক্ষমতা এই সুবিধাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
কেন এত বিতর্ক?
বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে অস্থিরতা বেড়েছে। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA), জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (NRC), এবং বাবরি মসজিদ মামলার রায় মুসলিম-বিরোধী নীতির উদাহরণ হিসেবে দেখা হয়। ওয়াকাফ সম্পত্তি ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম সম্পদের মালিক, এবং এটি মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও সামাজিক কাঠামোর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বর্তমানে হাইকোর্টে ১২০টিরও বেশি ওয়াকাফ-সংক্রান্ত মামলা বিচারাধীন রয়েছে, যা এই সম্পত্তির গুরুত্ব এবং এর নিয়ে বিতর্কের গভীরতা প্রকাশ করে।
বিজেপি সরকার দাবি করছে যে এই বিল ওয়াকাফ বোর্ডের দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনা দূর করবে। কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, এটি মুসলিম সম্প্রদায়ের অধিকার কেড়ে নেওয়ার একটি প্রচেষ্টা। অমুসলিম অফিসারদের বোর্ডে অন্তর্ভুক্তি এবং জেলা শাসকের হাতে তদন্তের ক্ষমতা মুসলিম সম্প্রদায়ের স্বায়ত্তশাসনের উপর আঘাত হিসেবে দেখা হচ্ছে। এই বিলের পিছনে সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে—এটি কি সত্যিই স্বচ্ছতার জন্য, নাকি মুসলিম সম্প্রদায়কে প্রান্তিক করার আরেকটি পদক্ষেপ?
মোদী সরকারের ষড়যন্ত্রমূলক নীতি:
বিজেপি সরকারের আমলে মুসলিম সম্প্রদায় বারবার লক্ষ্যবস্তু হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। CAA এবং NRC-এর মতো নীতি মুসলিমদের মধ্যে ভয় ও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। বাবরি মসজিদ মামলার রায় এবং গোহত্যা নিষেধাজ্ঞার মতো পদক্ষেপও মুসলিম-বিরোধী বলে সমালোচিত হয়েছে। ওয়াকাফ সংশোধনী বিলকে অনেকে এই ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবে দেখছেন। সরকারের দাবি যে এই বিল স্বচ্ছতা বাড়াবে, তবে বিলের ধারাগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে এটি ওয়াকাফ বোর্ডের স্বাধীনতা হ্রাস করতে পারে এবং কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, জেলা শাসকের হাতে তদন্তের ক্ষমতা দেওয়া উদ্বেগজনক। জেলা শাসক কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে কাজ করেন, এবং তাদের সিদ্ধান্ত সরকারের পক্ষপাতমূলক হতে পারে। এছাড়া, অমুসলিম অফিসারদের বোর্ডে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব প্রশ্ন তুলেছে যে কেন শুধুমাত্র মুসলিম ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এমন নিয়ম প্রয়োগ করা হচ্ছে। মন্দির বা গির্জার সম্পত্তি পরিচালনার ক্ষেত্রে এমন কোনো নিয়ম নেই। এটি মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি বৈষম্যমূলক নীতির ইঙ্গিত দেয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন যে এই বিল হিন্দু ভোটব্যাঙ্ককে খুশি করার জন্য তৈরি করা হয়েছে। বিজেপি সরকারের হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা ধর্মীয় বিভাজন তৈরি করে রাজনৈতিক লাভ অর্জনের চেষ্টা করে বলে অভিযোগ রয়েছে। ওয়াকাফ সম্পত্তি মুসলিম সম্প্রদায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ, এবং এটি নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে সরকার মুসলিমদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক শক্তি হ্রাস করতে চাইছে বলে অনেকে মনে করেন।
মুসলিম অধিকারের পক্ষে যুক্তি:
এই বিলের বিরুদ্ধে মুসলিম নেতা ও সম্প্রদায় তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। অল ইন্ডিয়া মুসলিম মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন (এআইএমআইএম) নেতা আসাদউদ্দিন ওয়াইসি এই বিলের বিরুদ্ধে স্পষ্ট যুক্তি তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, “জেলা শাসক কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে কাজ করেন। তারা কখনোই সরকারের বিরুদ্ধে যাবেন না। এটি ওয়াকাফ বোর্ডের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার একটি প্রচেষ্টা।” তিনি পাঁচ বছর মুসলিম হওয়ার শর্তের সমালোচনা করে বলেন, “এটি শরিয়াহ আইনের পরিপন্থী। কেন আমাকে সমাজের জন্য দান করতে পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হবে? এটি অযৌক্তিক এবং বৈষম্যমূলক।”
ওয়াইসি আরও প্রশ্ন তুলেছেন, “মন্দির বা গির্জার সম্পত্তি পরিচালনার ক্ষেত্রে কেন এমন নিয়ম নেই? কেন শুধুমাত্র মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠানের উপর এই নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হচ্ছে?” তিনি এই বিলকে মুসলিম সম্প্রদায়কে হয়রানি এবং তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা হ্রাস করার একটি হাতিয়ার হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের সদস্য খালিদ হুসেন বলেন, “এই সংশোধনী বিল ওয়াকাফ বোর্ডের স্বায়ত্তশাসন ধ্বংস করবে। এটি মুসলিম সম্প্রদায়ের সম্পত্তির উপর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করবে, যা দীর্ঘমেয়াদে সম্প্রদায়ের ক্ষতি করবে।” রাজনৈতিক বিশ্লেষক কুরবান আলী মনে করেন, “এই বিল হিন্দু ভোটব্যাঙ্ককে খুশি করার জন্য তৈরি করা হয়েছে। বিজেপি সরকার ধর্মীয় বিভাজন তৈরি করে রাজনৈতিক লাভ অর্জনের চেষ্টা করছে।”
বিরোধী দলগুলিও এই বিলের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে। ওড়িশার বিজেডি নেতা নবীন পট্টনায়েক বলেন, “এই বিল সংখ্যালঘুদের মধ্যে অসুরক্ষার ভাব সৃষ্টি করছে। আমরা এর বিরোধিতা করব।” তৃণমূল কংগ্রেস এবং সমাজবাদী পার্টিও এই বিলকে মুসলিম-বিরোধী বলে সমালোচনা করেছে।
বিলের সম্ভাব্য প্রভাব:
এই সংশোধনী বিল পাশ হলে মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর এর ব্যাপক প্রভাব পড়তে পারে। প্রথমত, ওয়াকাফ বোর্ডের স্বাধীনতা হ্রাস পাবে, কারণ জেলা শাসক এবং কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ বাড়বে। দ্বিতীয়ত, অমুসলিম অফিসারদের অন্তর্ভুক্তি মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করতে পারে, কারণ তারা মনে করেন যে তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে বহিরাগতদের হস্তক্ষেপ অগ্রহণযোগ্য। তৃতীয়ত, পাঁচ বছর মুসলিম হওয়ার শর্ত ওয়াকাফ ঘোষণার প্রক্রিয়াকে জটিল করবে এবং অনেককে এই পবিত্র কাজ থেকে বিরত রাখতে পারে।
দীর্ঘমেয়াদে, এই বিল মুসলিম সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক ও সামাজিক শক্তি হ্রাস করতে পারে। ওয়াকাফ সম্পত্তি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, এবং দারিদ্র্য বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যদি এই সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে চলে যায়, তবে এর সঠিক ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। এছাড়া, এই বিল ধর্মীয় বিভাজন তৈরি করে সামাজিক সম্প্রীতির ক্ষতি করতে পারে।
উপসংহার:
ওয়াকাফ মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয়, সামাজিক, এবং অর্থনৈতিক কাঠামোর একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই সংশোধনী বিল মুসলিম অধিকারের উপর আঘাত এবং তাদের সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণের একটি প্রচেষ্টা বলে মনে হয়। সরকারের দাবি যে এটি স্বচ্ছতা বাড়াবে, তবে বিলের ধারাগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে এটি মুসলিম সম্প্রদায়ের স্বায়ত্তশাসন এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর হুমকি সৃষ্টি করতে পারে।
আমাদের দাবি—মুসলিম সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষায় সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এই বিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে হবে এবং সরকারকে বোঝাতে হবে যে ধর্মীয় বৈষম্য গ্রহণযোগ্য নয়। ভারত একটি বহুত্ববাদী দেশ, এবং এখানে সকল সম্প্রদায়ের সমান অধিকার থাকা উচিত। ওয়াকাফ সংশোধনী বিল শুধু মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য নয়, ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের জন্যও একটি পরীক্ষা। আমাদের সকলকে একসঙ্গে কাজ করে এই বিলের মাধ্যমে সৃষ্ট বিভাজন রোধ করতে হবে।
রেফারেন্স:
- https://www.bbc.com/bengali/articles/c5y3p55p6mpo
- https://esstoday.in/amp/india/story/naveen-patnaiks-bjd-to-oppose-waqf-amendment-bill-cites-sense-of-inscurity-among-minorities-in-odisha-444690-2024-09-06
- https://youtu.be/270pVuZ7wxU?si=FEnTl-7TdRDR07oV
- https://thewire.in/government/waqf-amendment-bill-explained
- https://indianexpress.com/article/explained/explained-law/waqf-amendment-bill-2024-9502457/