যুক্তি, বিশ্বাস ও আধুনিক নাস্তিকতা: জাভেদ আখতারের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে ইসলামী প্রতিউত্তর

ভূমিকা

জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি ও সমাজসেবী জাভেদ আখতারের সাম্প্রতিক “মাই অ্যাথিয়িজম” শীর্ষক বক্তৃতা ও প্রশ্নোত্তর পর্বে ধর্ম, বিশ্বাস ও যুক্তি সম্পর্কে বিভিন্ন নাস্তিক্যবাদী সমালোচনা উপস্থাপিত হয়েছে। উক্ত আলোচনায় মূলত কয়েকটি মৌলিক দাবি উত্থাপিত হয়েছে—যেমন: আধুনিক যুক্তিবাদ নাকি স্বভাবতই নাস্তিকতার দিকে পরিচালিত করে; ইসলামী ঈমানকে অযৌক্তিক ও অন্ধবিশ্বাস হিসেবে চিত্রিত করা; বিজ্ঞান ও ধর্মের মধ্যে একটি অনিবার্য দ্বন্দ্ব বিদ্যমান—এমন ধারণা প্রচার করা; এবং ধর্মীয় পরিচয়কে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির উপকরণ হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ উত্থাপন করা। এই প্রবন্ধে উক্ত দাবিসমূহকে একটি সমালোচনামূলক ও বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গিতে পর্যালোচনা করা হয়েছে এবং কুরআন–সুন্নাহ ও ইসলামী বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যের আলোকে এসব আপত্তির যুক্তিসম্মত প্রতিউত্তর উপস্থাপন করার প্রয়াস নেওয়া হয়েছে। আলোচ্য প্রতিটি বিষয়ে প্রাসঙ্গিক কুরআনি আয়াত, নির্ভরযোগ্য তাফসীর এবং প্রাসঙ্গিক বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তি সংযোজনের মাধ্যমে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির সুসংহত ও ভারসাম্যপূর্ণ ব্যাখ্যা তুলে ধরা হয়েছে।

তাওহীদী ঈশ্বরবাদ-এর যুক্তিসঙ্গততা ও নাস্তিক্যবাদী আপত্তিসমূহ

নাস্তিক দর্শনের পক্ষপাতীরা প্রায়শই দাবি করে যে আধুনিক বুদ্ধিমত্তার ডিফল্ট অবস্থান হিসেবে নাস্তিকতাই গ্রহণযোগ্য। কিন্তু মূল মতবাদ হলো ঈশ্বরবিশ্বাসও তর্কোচিত ও যৌক্তিকভাবে সমর্থনীয়। এটি প্রায়ই দর্শনশাস্ত্রের কসমোলজিকাল যুক্তি দ্বারা বোঝানো হয়: ‘বিস্ফুটিত মহাবিশ্বকে একটি অনিবার্য সৃষ্টি ও কর্তার প্রয়োজন, কারণ নিজস্ব শর্তে তৈরি কোন বস্তুকে কিভাবে অযাচিতভাবে অস্তিত্বের যোগান দেয়া হতে পারে?’ সূরা আত-তূর এর আয়াতসমূহ এই প্রশ্ন তুলে ধরে: أَمْ خُلِقُوا مِنْ غَيْرِ شَيْءٍ أَمْ هُمْ الْخَالِقُونَ "

“তারা কি কোনো কিছু ছাড়া সৃষ্টি হয়েছে, না তারা নিজেই স্রষ্টা?” । (সূরা আত-তূর ৫২:৩৫)

এই আয়াতের বাংলা অর্থ অনুসারে (‘তারা কি স্রষ্টা ছাড়া সৃষ্টি হয়েছে, না তারা নিজেরাই স্রষ্টা?’) প্রশ্নটি স্পষ্ট – যদি মানুষ ও পৃথিবী-সূর্যকে নিজেই সৃষ্টি হতে হয়, তাহলে মহাবিশ্বের অন্তর্ঘাত বোঝা যাবে না। সেইসঙ্গে সূরা আল-মূলক ৩–৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহর সৃষ্টি যবনিকা বর্ণনা করা হয়েছে: তিনি সপ্ত আকাশ স্তরে স্তরে সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁর সৃষ্টিতে ত্রুটি বা ফাটল (খুঁত) নেই। আর তাৎপর্যপূর্ণ যে এই আয়াতে প্রত্যক্ষভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে চোখ ফেরিয়ে আবার তাকানো (ফকরের অভাব খোঁজা) শাস্তি পরিণতি রূপে প্রত্যাবর্তিত করে দেবে। অর্থাৎ ইসলামী বর্ণনায় চারিপাশের প্রাকৃতিক বিশ্ব নিষ্কলুষ, সুবিন্যস্ত ও যুক্তিপূর্ণ; তাই যুক্তি-বুদ্ধির মোড়কে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে প্রত্যাখ্যান করা সহজ নয়।

বিজ্ঞানমতের যুগে সৃষ্টির সূক্ষ্ম-সমন্বয় (fine-tuning) বিষয়টিও ইহুদী-খ্রিস্টান কুসংস্কার নয়, বরং এ কথা নিশ্চিত করে যে মহাবিশ্বে জীবননির্মাণের জন্য অনেক সূক্ষ্ম নিয়মিত মান (physical constants) বিধৃত আছে। নাস্তিক জগত-বর্ণনায় এই সৌম্য বিন্যাসের কারণ ব্যাখ্যা করা কঠিন। ইসলামী শিক্ষায় এটিকে আল্লাহর বিজ্ঞ শাসন বলে মানা হয়, যেমন সূরা আল-মূলক ৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে “রহমানের সৃষ্টি” {الرَّحْمٰنِ}। ইসলামের যুক্তিবাদের আধিক্য প্রকাশ করতে বলা যেতে পারে: জ্ঞান ও বিজ্ঞান যে নিয়মিত বিশ্ব আবিষ্কার করে এসেছে, তার পেছনে একটি পরমজ্ঞ স্রষ্টার পরিকল্পনা উপলব্ধি করে ইসলাম কাফেলা দেয়।

চেতনা ও নৈতিক বাস্তববাদ (moral realism) সম্পর্কেও ইসলাম এমন ব্যাখ্যা দেয় যা অজ্ঞাতশক্তির তুলনায় পরিপূরক। মানুষে আত্মচেতনা ও নৈতিক বিচারবুদ্ধির উপস্থিতি তা ইঙ্গিত দেয় যে কোন নৈতিক আদর্শের উৎস থাকা বাঞ্ছনীয়। অন্যদিকে অবৈজ্ঞানিকবাদ এসব ব্যাখ্যার কথা বলার স্থান দেয় না। আল-কুরআন এ বিষয়ের উপর দৃষ্টি আকর্ষণ করে সূরা আশ-শামস ৭–১০ নম্বর আয়াতসমূহে:

وَنَفْسٍ وَمَا سَوَّاهَافَأَلْهَمَهَا فُجُورَهَا وَتَقْوَاهَاقَدْ أَفْلَحَ مَنْ زَكَّاهَاوَقَدْ خَابَ مَنْ دَسَّاهَا

“শপথ প্রাণের এবং যে তাকে সঠিক রেখেছে; অতঃপর তার চেতনায় পাপ ও তাকওয়া (ধর্ম অনুশীলনের ক্ষমতা) উজ্জীবিত করেছে; তারাই সফল হয়েছে, যারা নিজেকে পরিশুদ্ধ করেছেন, আর তারাই ব্যর্থ হয়েছে, যারা নিজেরা নিজেদের নষ্ট করেছেন।” 

এখানে নৈতিক-আত্মার মাপকাঠি পরিষ্কার: আত্মাকে শিষ্টাচারের প্রতি অনুপ্রাণিত করাই সাফল্য, অন্যথায় পরাভূত হন ব্যর্থ ব্যক্তি। এই বিবেচনায় লক্ষ্যণীয়, কুরআন মানবকে নিজ “নফস” বা আত্মার সর্বাঙ্গীন ঠিকঠাক করায় উদ্বুদ্ধ করে এবং লক্ষ্য রাখায় । এগুলো কেবল ইসলাম নয়, শুদ্ধ নৈতিক যুক্তির প্রতিফলনও। ইসলামী ব্যাখ্যা মতে, বস্তুনিষ্ঠ নৈতিকতা ও চেতনার উপস্থিতি ঈশ্বরের অস্তিত্বের সুস্পষ্ট প্রমাণ, যা বিদ্রোহী নাস্তিকদর্শনের অনুচিত মন্তব্যের বিরুদ্ধে এক যুক্তিসম্মত উত্তর।

(উপাত্ত ও যুক্তি) প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, এ ধরনের দার্শনিক অবস্থানগুলির সমালোচনা এবং ইসলামীয় দৃষ্টিতে শক্তিশালী ব্যাখ্যা নথিত। সেই গবেষণাপত্রে আলভিন প্ল্যান্টিগা ও রিচার্ড সোয়িনবার্নের মত দার্শনিকদের উদ্ধৃতি দিয়ে জানানো হয়েছে যে ঈশ্বরবাদও পর্যাপ্ত যুক্তিগত প্রমাণের অধিকারী। ইসলামে বিশ্বাসকে অন্ধবিশ্বাস হিসেবে দেখার পরিবর্তে, এটিকে ‘তাসদিক’ (যৌক্তিক নিশ্চিতকরণ) এবং ‘তাওয়াক্কুল’ (আস্থা) সহ গণ্য করা হয়। ইসলামি দর্শনের আলোকে ঈমান তর্ক-বুদ্ধি, ইতিহাস ও অভিজ্ঞতার সমন্বয়; যেটি গবেষণায়ও প্রতিষ্ঠিত যৌক্তিকতা।

ঈমান মানে কি অযৌক্তিক বিশ্বাস?

নাস্তিক সমালোচনার একটি সাধারণ দাবি হল, ঈমান মানে যুক্তি, প্রমাণ কিংবা সাধারণ বুদ্ধির বিপরীত একটি নির্ভরতা (belief without proof)। এই ধারণাটি ইসলামিক ধারণার সাথে মিথ্যা মিল রয়েছে। ইসলাম শেখায়, ঈমান মানে স্বতঃসিদ্ধ গ্রহণ নয়; বরং এতে রয়েছে যুক্তি-নির্ভর আত্মবিশ্বাস, সচেতন স্বীকারোক্তি ও তওয়াক্কুল। কুরআনে বারবার বুদ্ধিমত্তা দিয়ে পরখ করার আহ্বান আছে, যেমন أَفَلَا تَعْقِلُونَ (সূরা ফাতির ৩৫:১৪) – “তুমি কি বুদ্ধি-ব্যবহার কর না?” ইত্যাদি।

ইসলামী দৃষ্টিতে ঈমানকে অনেক সূত্রের ওপর স্থাপিত মনে করা হয়। প্রমাণসূত্র: প্রকৃতি, ইতিহাস ও নেয়ামতে ঈশ্বরের নিদর্শন (আয়াত) প্রদর্শিত হয়েছে; মানুষের অভিজ্ঞতায় সৃষ্টি-শৃঙ্খলা এবং হৃদয়ের গভীরে সৃষ্টি-অনুভূতি প্রত্যক্ষ হয়। বাস্তব প্রত্যক্ষের প্রত্যয়: কুরআনে ইলম-এ-গাইব (অদেখা জ্ঞানের উৎস) হিসেবে রাসূলের সাক্ষ্য, সংরক্ষিত কিতাব (ওহি) এবং আদর্শ জীবনপথ (সুন্নাহ) ব্যক্তিগত ও সামাজিক ভিত্তিতে আদর্শ ভূমিকায় আনা হয়েছে। এই সবকে ইসলাম একটি যুক্তিসম্মত ভিত্তি হিসেবে স্বীকার করে যা বিজ্ঞানেও দেখা যায় (উদাহরণস্বরূপ, বিজ্ঞান গবেষণায় গবেষকদের প্রত্যক্ষ সাক্ষ্যগ্রহণের গুরুত্ব)। যেমন সূরা ফুসসিলাত ৪১:৫৩ আয়াতে  বলা হয়েছে: وَنُرِيهِمْ آيَاتِنَا فِي الْآفَاقِ وَفِي أَنفُسِهِمْ – “আমি অচিরেই তাদেরকে আমার নিদর্শনাবলি দেখাবো দিগন্তসমূহে এবং তাদের নিজেদের অন্তরে, যতক্ষণ না তাদের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে যাবে যে—এই কুরআনই সত্য।” 

অতএব ইসলামে ঈমানকে দৃঢ় বিশ্বাস হিসেবে দেখা হয়, যেটি যুক্তি, প্রমাণ ও অভিজ্ঞতার সম্মিলিত আলোকে প্রতিষ্ঠিত। তাই এটি অযৌক্তিক বা অন্ধবিশ্বাস নয় বরং বিবেচিত বিশ্বাস।

জনসংখ্যা বনাম সত্য: জনপ্রিয়তার সমালোচনা

নাস্তিক্যবাদী সমালোচনার একটি প্রচলিত রূপ হলো এই দাবি করা যে—কোনো বিশ্বাসের সত্যতা নাকি মূলত নির্ভর করে কতজন মানুষ তা গ্রহণ করে তার ওপর। এই যুক্তি অনুযায়ী বলা হয়, আল্লাহর প্রতি ঈমানের পেছনে নাকি প্রধান কারণ হলো বিপুল সংখ্যক মানুষের তা অনুসরণ করা; অর্থাৎ যদি ভিন্ন কোনো বিশ্বাস অধিক জনপ্রিয় হতো, তবে মানুষ সেটিই গ্রহণ করত। যুক্তিবিদ্যায় এই ধরনের যুক্তিকে (argumentum ad populum) বলা হয়, যা একটি স্বীকৃত যুক্তিভ্রান্তি।

ইসলাম এই ধরনের জনপ্রিয়তানির্ভর সত্য নির্ধারণকে স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করে। কুরআন কারিমে বহু স্থানে সতর্ক করে বলা হয়েছে যে, সংখ্যাধিক্য বা সামাজিক রেওয়াজ কখনোই সত্যের মানদণ্ড হতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন—وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ اتَّبِعُوا مَا أَنْزَلَ اللَّهُ قَالُوا بَلْ نَتَّبِعُ مَا أَلْفَيْنَا عَلَيْهِ آبَاءَنَا “আর যখন তাদেরকে বলা হয়—আল্লাহ যা নাজিল করেছেন তা অনুসরণ করো, তখন তারা বলে—না; আমরা তো সেই পথই অনুসরণ করব, যাতে আমরা আমাদের পিতা-পুরুষদেরকে পেয়েছি।” (সূরা আল-বাকারা, ২:১৭০) এই আয়াতের মাধ্যমে কুরআন স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, অন্ধ অনুসরণ ও সামাজিক প্রচলন সত্য নির্ধারণের বৈধ ভিত্তি নয়। বরং সত্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে যুক্তি, প্রমাণ ও বিবেচনা অপরিহার্য।

অনুরূপভাবে, সূরা আয-যুমার (৩৯:১৮)-এ আল্লাহ তা‘আলা সত্য অনুসারীদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে বলেন—الَّذِينَ يَسْتَمِعُونَ الْقَوْلَ فَيَتَّبِعُونَ أَحْسَنَهُ “যারা কথা শোনে, অতঃপর তার মধ্যে যা উত্তম তা অনুসরণ করে।” অতএব ইসলামী দৃষ্টিতে কোনো মতের সত্যতা তার জনপ্রিয়তার ওপর নির্ভরশীল নয়; বরং তা নির্ভর করে যুক্তিসংগততা, প্রমাণযোগ্যতা ও নৈতিক সামঞ্জস্যের ওপর

বিজ্ঞান ও ঈমান: বিরোধ না পরিপূরকতা?

আরেকটি প্রচলিত অভিযোগ হলো—ধর্মবিশ্বাসী মানুষ নাকি একদিকে আধুনিক বিজ্ঞানকে গ্রহণ করে, আবার অন্যদিকে ধর্মীয় গ্রন্থ অনুসরণ করে; ফলে তারা একটি দ্বৈত ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ মানসিক অবস্থানে বাস করে। এই অভিযোগের পেছনে প্রায়ই ইউরোপীয় ইতিহাসের কিছু ঘটনা—যেমন গ্যালিলিওর সঙ্গে চার্চের সংঘাত—উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। তবে এই ধরনের তুলনা ঐতিহাসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উভয় দিক থেকেই অসম্পূর্ণ। গ্যালিলিওর ঘটনা মূলত একটি বিশেষ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে কিছু চার্চ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈজ্ঞানিক মতবাদের সংঘাত ছিল; এটি ঈশ্বরবিশ্বাস বা ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে বিজ্ঞানের সার্বিক বিরোধের প্রমাণ নয়। বিশেষত ইসলামী সভ্যতার ইতিহাসে ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে এমন কোনো মৌলিক দ্বন্দ্ব পরিলক্ষিত হয় না।

মধ্যযুগীয় মুসলিম সভ্যতায় ইবনুল হাইসম, আল-বিরুনি, ইবনু সিনা প্রমুখ মনীষীরা ধর্মীয় বিশ্বাস বজায় রেখেই জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা, চিকিৎসাবিজ্ঞান ও দর্শনে অসামান্য অবদান রেখেছেন। এটি প্রমাণ করে যে ইসলামী বিশ্বদর্শনে ধর্ম ও বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান পরস্পরবিরোধী নয়; বরং পরস্পরসম্পূরক। কুরআন নিজেও বিজ্ঞানকে কোনো পাঠ্যবই হিসেবে উপস্থাপন করে না এবং নির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক মডেল চাপিয়ে দেয় না। বরং এটি মানুষকে প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ ও চিন্তাশীল গবেষণার দিকে আহ্বান জানায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন—إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لَآيَاتٍ لِأُولِي الْأَلْبَابِ “নিশ্চয়ই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে এবং রাত ও দিনের আবর্তনে বোধশক্তিসম্পন্নদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।” (সূরা আলে ইমরান, ৩:১৯০–১৯১)

এই আয়াতগুলো থেকে স্পষ্ট যে ইসলাম মানুষকে পর্যবেক্ষণ, গবেষণা ও চিন্তাশীলতার প্রতি উৎসাহিত করে। ইসলামী দৃষ্টিতে বিজ্ঞান মূলত এই প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করে—‘বিশ্ব কীভাবে পরিচালিত হয়’, আর ধর্ম উত্তর দেয়—‘এই বিশ্ব কেন অস্তিত্বশীল এবং মানুষের নৈতিক দায়িত্ব কী’। সুতরাং বিজ্ঞান ও ধর্মের মধ্যে যে দ্বন্দ্বের কথা বলা হয়, তা প্রকৃতপক্ষে একটি কৃত্রিম বিভাজন, বাস্তব কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক অনিবার্যতা নয়।

কষ্ট ও অনিষ্টের সমস্যা 

“যদি পরম সর্বশক্তিমান একটি পবিত্র ঈশ্বর থাকে, তাহলে কেন পৃথিবীতে এত কষ্ট, অবিচার, দুর্দশা?”— এমনই প্রশ্ন তুলে ধরেন জাবেদ আখতার। ইসলামের উত্তরটি বহুস্তরীয়। প্রথমত, আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে মানুষকে স্বৈরাচারী করে দেবার প্রতিপ্রেক্ষিতে স্বাধীন ইচ্ছা অপরিহার্য; এই স্বাধীনতার জায়গায় মানুষ ভূল-ত্রুটিসহ কৃতকর্ম করলে অন্তত: ব্যক্তিগত পরকালের ন্যায় এবং নৈতিক জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তোলে। সূরা আল-শূরা ৪২:৩০-এ বলা হয়েছে, “এমন কোন বিপদ বা কল্যাণ নেই যা আল্লাহ্ না করে দেন; তবে মানুষের অধিকাংশই অনুধাবন করে না।” অর্থাৎ বিপদ-কল্যাণের সাহচর্যে মানুষ পরিপূর্ণতা লাভের সুযোগ পায়।

দ্বিতীয়ত, কঠিন পরিক্ষা ও শোষণকে ঊর্ধ্বমুখী অসাধারণ গুণের বিকাশের জন্য ‘আত্ম-তৈরী’ ভূমিকা হিসেবে দেখা হয়। সূরা আল-বাকারা ২:১৫৫–১৫৭-এ বলা হয়েছে, “আর অবশ্যই আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, ধন-সম্পদ, প্রাণ ও ফল-ফসলের ঘাটতির মাধ্যমে। আর তুমি সুসংবাদ দাও ধৈর্যশীলদের। যারা বিপদে পতিত হলে বলে—‘নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহরই এবং নিশ্চয়ই আমরা তাঁরই নিকট প্রত্যাবর্তনকারী।’ এরাই তারা—যাদের ওপর তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে বিশেষ অনুগ্রহ ও রহমত রয়েছে; আর এরাই হেদায়েতপ্রাপ্ত।” এখানে প্রমাণ দেওয়া হয়েছে যে শিষ্টাচারিক গুণ এবং ধৈর্য, করুণা ইত্যাদি প্রশিক্ষিত হয় কষ্টের মাধ্যেমে। বিভিন্ন ধারার তত্ত্বে এই দিকটি সৌল-মেকিং থিওরি (soul-making) হিসেবে পরিচিত।

তৃতীয়ত, আল্লাহ তা‘আলার জ্ঞান ও হিকমত (প্রজ্ঞা) পরম ও সর্বব্যাপী, অথচ মানুষের জ্ঞান সীমিত ও আংশিক। ফলে কোনো কোনো ঘটনার বাহ্যিক দিক দেখে মানুষ তা অকল্যাণ বা অবিচার বলে মনে করলেও, আল্লাহর দৃষ্টিতে তার পেছনে গভীর কল্যাণ ও সুদূরপ্রসারী হিকমত নিহিত থাকতে পারে—যা মানুষের পক্ষে তাৎক্ষণিকভাবে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। এই সত্যটি কুরআনে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে হযরত মূসা (আ.) ও হযরত খিদর (আ.)–এর ঘটনাবলিতে (সূরা আল-কাহফ ১৮:৬০–৮২)। সেখানে দেখা যায়— যেসব কাজ বাহ্যিকভাবে অন্যায়, ক্ষতিকর বা অযৌক্তিক মনে হয়েছিল (নৌকা ক্ষতিগ্রস্ত করা, এক বালককে হত্যা করা, বিনা পারিশ্রমিকে প্রাচীর মেরামত করা), সেগুলোই পরবর্তীতে উচ্চতর ন্যায় ও কল্যাণের বাহক হিসেবে প্রকাশ পেয়েছে। এর মাধ্যমে কুরআন শিক্ষা দেয় যে— মানুষের সীমিত উপলব্ধির ভিত্তিতে আল্লাহর কর্মপরিকল্পনাকে বিচার করা সঠিক নয়। বরং মুমিনের করণীয় হলো আল্লাহর হিকমতের ওপর আস্থা রাখা, এই বিশ্বাসে যে—যা কিছু আল্লাহ করেন, তা চূড়ান্ত বিচারে ন্যায় ও কল্যাণকরই হয়, যদিও তার পূর্ণ রহস্য মানুষের বোধগম্য নাও হতে পারে।

চতুর্থত, অবিশ্বাসীরা মনে করেন, যদি পরলোকিক ন্যায়বিচার না থাকে, তাহলে ক্ষতিপূরণমূলক প্রতিশ্রুতি হবে না; কিন্তু কুরআন পরিষ্কার করে, ঈমানের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পরকালীন মুক্তি ও ন্যায় (আখিরাত) নিশ্চিতকরণে নিহিত। সূরা আয-যুমার ৩৯:১৮-এ “যারা হেদায়েত সংক্রান্ত আমল করবে, তাদের শেষ দিন সুন্দর” বলেছেন এবং সূরা আল-জান্নাত ৯৯:৭–৮ এ জাহান্নাম ও জান্নাতের শেষ হিসাব বিবরণ এসেছে। ঈমানী ব্যাখ্যা মতে, শেষ বিচারের আশ্বাস অবিচারের শাস্তি নিশ্চিত করে, যা নাস্তিক ধরনে অনুপস্থিত থাকে। এর সাথে ঈশ্বর দারিদ্র ও নিপীড়িতের প্রতি সহমর্মিতা পোষণ করে, এবং অনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে। তাই পৃথিবীর যন্ত্রণা ঈশ্বরবাদ নয় বরং ঈশ্বরের ন্যায়পরায়ণতা প্রদর্শন করে।

এই সব যুক্তি মিলিয়ে দেখা যায়, কষ্টের উপস্থিতি ইসলামিক দর্শনে ঈশ্বর-বিদ্বেষ নয়; বরং ঈশ্বরের মুক্তি, ন্যায়, পরীক্ষা ও প্রশিক্ষণ নীতি পরিপূর্ণ করে।

ধর্মীয় পরিচয় বনাম সাম্প্রদায়িক রাজনীতি

সমকালীন সমাজে একটি প্রচলিত সমালোচনা হলো—ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতাকে অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির উপকরণে পরিণত করা হয়েছে, যার ফলে তথাকথিত ‘সাম্প্রদায়িকতা’ (Communalism) জন্ম নিচ্ছে। ইসলাম এই ধরনের ধর্মীয় অপব্যবহারকে সুস্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করে। প্রকৃতপক্ষে ইসলামী শরীআত বিশ্বাসকে যেকোনো ধরনের রাজনৈতিক শোষণ ও স্বার্থান্বেষী ব্যবহারের হাত থেকে সুরক্ষিত রাখার জন্য নীতিগত বিধান প্রদান করেছে। ইসলাম রাজনৈতিক ক্ষমতাকে স্বৈরাচারী বা একক কর্তৃত্বে ন্যস্ত না করে পরামর্শভিত্তিক শাসনব্যবস্থা (শূরা)–কে বাধ্যতামূলক নীতি হিসেবে নির্ধারণ করেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন—وَأَمْرُهُمْ شُورَىٰ بَيْنَهُمْ “আর তাদের কার্যাবলি পরস্পরের পরামর্শের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়।” (সূরা আশ-শূরা, ৪২:৩৮) এই আয়াত থেকে স্পষ্ট হয় যে, ইসলামে নেতৃত্ব ও রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ জনসম্পৃক্ত পরামর্শের ভিত্তিতে হওয়া আবশ্যক, যা ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে একটি মৌলিক নীতিগত রক্ষাকবচ।

এছাড়া ইসলাম বিচারব্যবস্থা ও নৈতিক শাসনের ক্ষেত্রে কঠোর নির্দেশনা প্রদান করেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন— يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ بِالْقِسْطِ شُهَدَاءَ لِلَّهِ “হে মুমিনগণ! তোমরা ন্যায়ের ওপর সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকো এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে সাক্ষ্য দাও।” (সূরা আন-নিসা, ৪:১৩৫) এই আয়াতের আলোকে ইসলাম শাসকদের ওপর ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, পক্ষপাতমুক্ত অবস্থান গ্রহণ এবং সংখ্যালঘু ও দুর্বল শ্রেণির অধিকার রক্ষাকে ফরজ দায়িত্ব হিসেবে আরোপ করেছে। একই সূরার অন্য আয়াতে নিপীড়িত মানুষের পক্ষে দাঁড়ানোর আহ্বান জানানো হয়েছে (সূরা আন-নিসা, ৪:৭৫)।

ইসলাম ধর্মীয়তার নামে লোক দেখানো ইবাদত ও রাজনৈতিক সুবিধা অর্জনের প্রবণতাকেও কঠোরভাবে নিন্দা করেছে। রিয়া (প্রদর্শনমূলক ধর্মচর্চা) ও নিফাক (অন্তরের দ্বৈততা ও ভণ্ডামি)–কে কুরআন ও সুন্নাহতে গুরুতর ব্যাধি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ স্পষ্টভাবে সতর্ক করেছেন যে, ধর্মকে ব্যক্তিগত মর্যাদা, ক্ষমতা বা জনপ্রিয়তা অর্জনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা চরম গোমরাহী। অতএব ইসলামী দৃষ্টিতে ধর্মীয় পরিচয় কখনোই রাজনৈতিক শোষণ বা সাম্প্রদায়িক বিভাজনের বৈধ মাধ্যম হতে পারে না। ইসলামের সিদ্ধান্তমূলক বক্তব্য হলো—ধর্মের নামে সংঘটিত অন্যায় ধর্মের ত্রুটি নয়; বরং তা অপব্যবহারকারীর নৈতিক বিচ্যুতির বহিঃপ্রকাশ ইসলাম মূলত ন্যায়, সহানুভূতি, মানবিক মর্যাদা ও দায়িত্বশীল শাসনের ধর্ম—শোষণ ও বিভেদের নয়।

নাস্তিক নেতৃত্ব ও শিল্পী নীতিশাস্ত্র

কিছু সমালোচকের মতে, ধর্মনিরপেক্ষ বা নাস্তিক প্রবণতাসম্পন্ন কিছু রাজনৈতিক নেতা জনগণের সমর্থন আদায়ের জন্য ধর্মীয় প্রতীক ও আবেগকে কৌশলগতভাবে, সীমিত মাত্রায় এবং ধাপে ধাপে ব্যবহার করে থাকেন অর্থাৎ, প্রকৃত বিশ্বাসে আস্থাশীল না হয়েও রাজনৈতিক স্বার্থে তারা কখনো কখনো ধর্মের নাম ও ভাষাকে সাময়িক উপকরণ হিসেবে গ্রহণ করে জনগণকে তুষ্ট করার চেষ্টা করেন। ইসলামী শিক্ষা এই ধরনের প্রবণতাকে সুস্পষ্টভাবে অগ্রহণযোগ্য ঘোষণা করেছে। কারণ ইসলাম ধর্মকে রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা অর্জনের হাতিয়ার কিংবা লোক দেখানো আচরণের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের ঘোর বিরোধী। কুরআন ও সুন্নাহতে রিয়া (প্রদর্শনমূলক ধার্মিকতা) এবং নিফাক (অন্তরের বিশ্বাস ও বাহ্যিক আচরণের দ্বৈততা)–কে মারাত্মক নৈতিক ব্যাধি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

রাসূলুল্লাহ স্পষ্টভাবে সতর্ক করেছেন যে, যে ব্যক্তি ধর্মীয় কাজের মাধ্যমে মানুষের প্রশংসা, মর্যাদা বা ক্ষমতা অর্জন করতে চায়, তার সে আমল আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। ইসলামী দৃষ্টিতে সত্যিকার ধার্মিকতা হলো—আন্তরিকতা, নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধ, না যে তা রাজনৈতিক কৌশল বা জনমত নিয়ন্ত্রণের উপায়।

সবকিছুতেই ৯০% নাস্তিক” তত্ত্বের সমালোচনা

নাস্তিক সমালোচকদের একটি প্রচলিত দাবি হলো—ধর্মবিশ্বাসীরা অন্যান্য ধর্মের ত্রুটি ও অসংগতি যুক্তির মাধ্যমে প্রত্যাখ্যান করলেও, নিজেদের ধর্মের ক্ষেত্রে একই ধরনের সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগ করে না। এ কারণে তারা রূপক অর্থে দাবি করেন যে, একজন ধার্মিক ব্যক্তি নাকি “৯০ শতাংশ নাস্তিক”। ইসলামের যুক্তিসম্মত জবাব হলো—বিভিন্ন ধর্মীয় মতবাদের তুলনামূলক পর্যালোচনা করা নাস্তিকতা নয়, বরং তা বুদ্ধিবৃত্তিক সততা ও অনুসন্ধিৎসার পরিচায়ক। ইসলাম নিজেই যুক্তি, প্রশ্ন ও প্রমাণের ভিত্তিতে সত্য যাচাইয়ের আহ্বান জানায়। তাই অন্যান্য ধর্মীয় দাবির সমালোচনা করা এবং একই মানদণ্ডে ইসলামের নিজস্ব দাবিগুলোকেও বিচার করা ইসলামের দৃষ্টিতে নিন্দনীয় নয়; বরং এটি প্রশংসনীয়।

ইসলামী চিন্তাধারার ইতিহাসে আল-গাজ্জালি, ফখরুদ্দীন রাযি, ইবনু রুশদ প্রমুখ মনীষীরা ইসলামের আকীদা ও দর্শনকে গভীর যুক্তি ও সমালোচনামূলক বিশ্লেষণের মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন। তাঁদের কাজই প্রমাণ করে যে, ইসলাম অন্ধ অনুসরণের ধর্ম নয়; বরং এটি আকল (যুক্তি) ও নকল (ওহি)এর সমন্বিত ধর্ম।

অতএব ইসলামের দৃষ্টিতে, সত্য ধর্ম যদি প্রকৃতই আল্লাহপ্রদত্ত হয়, তবে তা কঠোরতম বুদ্ধিবৃত্তিক পরীক্ষায়ও টিকে থাকবে এবং তার মৌলিক তাওহীদী কাঠামো ও নৈতিক সামঞ্জস্য অক্ষুণ্ণ থাকবে। এ কারণেই ইসলামী বিশ্বদর্শন একদিকে বিশ্বাসের দৃঢ়তা রক্ষা করে, অন্যদিকে যুক্তিনির্ভর অনুসন্ধানের পথও উন্মুক্ত রাখে।

উপসংহার

উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, জাভেদ আখতারের উত্থাপিত বহু বক্তব্য মুসলিম আকীদা ও বস্তুনিষ্ঠ যুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়; বরং ইসলাম সেগুলোর অধিকাংশেরই সুসংহত ও ভারসাম্যপূর্ণ প্রতিউত্তর প্রদান করে। আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে ঈশ্বরকে অপ্রাসঙ্গিক প্রতিপন্ন করা কিংবা ইবাদতকে অন্ধবিশ্বাস হিসেবে চিহ্নিত করা—কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে টেকসই নয়। বরং ইসলামী বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যে যুক্তি, বিজ্ঞান, দর্শন ও ওহিভিত্তিক জ্ঞানের মধ্যে একটি গভীর সামঞ্জস্য পরিলক্ষিত হয়, যা আধুনিক জ্ঞানচর্চার সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ।

এই প্রবন্ধে আলোচিত বিষয়াবলি প্রমাণ করে যে, ইসলামের বিশ্বাসব্যবস্থা কেবল আবেগ বা জনপ্রিয়তার ওপর নির্ভরশীল নয়; বরং তা যুক্তিসম্মত, যাচাইযোগ্য এবং নৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে যে তথাকথিত দ্বন্দ্বের কথা প্রায়ই উত্থাপিত হয়, তা প্রকৃতপক্ষে একটি কৃত্রিম বিভাজনের ফল; কারণ কুরআন মানুষকে পর্যবেক্ষণ, অনুসন্ধান ও চিন্তাশীলতার প্রতি নিরন্তর আহ্বান জানিয়েছে। অনুরূপভাবে, দুঃখ–কষ্ট ও দুর্ভোগের সমস্যাকেও ইসলাম নৈতিক পরীক্ষা, আত্মিক পরিশুদ্ধি এবং চূড়ান্ত ন্যায়ের প্রেক্ষাপটে ব্যাখ্যা করে। এছাড়া ইসলাম ধর্মীয় পরিচয়ের অপব্যবহার, সাম্প্রদায়িক বিভাজন এবং নীতিহীন নেতৃত্বের প্রবণতাকে স্পষ্টভাবে নিন্দা করেছে এবং ন্যায়, জবাবদিহিতা ও মানবিক মর্যাদার ভিত্তিতে সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশনা প্রদান করেছে।

অতএব এই সমালোচনামূলক পর্যালোচনার আলোকে প্রতীয়মান হয় যে, ইসলাম একদিকে যেমন যুক্তিবাদী চিন্তাকে স্বীকৃতি দেয়, অন্যদিকে তেমনি একটি সুসংহত ও বিশ্বস্ত নৈতিক কাঠামোও উপস্থাপন করে—যা সমকালীন নাস্তিক্যবাদী আপত্তিসমূহের একটি অর্থবহ ও প্রাসঙ্গিক জবাব হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। ইসলামী চিন্তাধারায় বুদ্ধি ও গবেষণা কখনোই পরিত্যাজ্য নয়; বরং কুরআন–সুন্নাহর আলোকেই মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা প্রতিটি নতুন প্রশ্ন ও বিতর্কের জবাব অনুসন্ধান করে থাকেন। এই ধারাবাহিক অনুসন্ধান ও সমন্বয়ের মাধ্যমেই ইসলাম ইলম ও ঈমানের মধ্যে একটি সুষম ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে চলেছে।

তথ্যসূত্র

  1. আল-কুরআন, সূরা আত-তূর (৫২): ৩৫–৩৬
  2. আল-কুরআন, সূরা আল-মুল্ক (৬৭): ৩–৪
  3. আল-কুরআন, সূরা আশ-শামস (৯১): ৭–১০
  4. আল-কুরআন, সূরা ফুসসিলাত (৪১): ৫৩
  5. আল-কুরআন, সূরা আল-বাকারা (২): ১৭০
  6. আল-কুরআন, সূরা আলে ইমরান (৩): ১৯০–১৯১
  7. আল-কুরআন, সূরা আল-কাহফ (১৮): ৬০–৮২
  8. আল-কুরআন, সূরা আল-বাকারা (২): ১৫৫–১৫৭
  9. আল-কুরআন, সূরা আয-যালযালাহ (৯৯): ৭–৮
  10. আল-কুরআন, সূরা আন-নিসা (৪): ৭৫, ১৩৫
  11. aī al-Bukhārī : Kitāb Badʾ al-Way, Bāb 1, hadīth No. 1. Vol. 1, p. 3, (Al-Maktaba al-Shāmilah; Dār Ibn Kathīr alignment)
  12. aī Muslim: Kitāb al-Imārah, hadīth No. 1907, Vol. 3, p. 1515, (Al-Maktaba al- Shāmilah; Dār Iʾ al-Turāth)
  13. Sunan Abī Dāwūd: Kitāb al-Buyū, hadīth No. 3452, Vol. 3, p. 274, (Al-Maktaba al-Shāmilah)
  14. Sunan al-Tirmidhī: Kitāb al-Akām, hadīth No. 1705, Vol. 3, p. 617, (Al-Maktaba al-Shāmilah)
  15. Plantinga, Alvin. Where the Conflict Really Lies: Science, Religion, and Naturalism. Oxford: Oxford University Press, 2011.
  16. Swinburne, Richard. The Existence of God. 2nd ed. Oxford: Oxford University Press, 2004.




Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter