অপটিকের জনক ইবনুল হাইথাম: এক বিখ্যাত মুসলিম বিজ্ঞানী

আব্বাসী খিলাফতের যুগের বিখ্যাত মুসলিম বিজ্ঞানী ইবন আল-হাইথম, যাঁকে আলহাজেন নামেও ডাকা হয়। তাঁকে অপটিক্সের জনক (Father of Optics) হিসেবে সম্মান জানানো হয়। তাঁর পূর্ণ নাম ছিল আবু আলী হাসান ইবন হাসান ইবন আল-হাইথম। ৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে ইরাকের বাসরা শহরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বিজ্ঞান বিপ্লবের সময় আইজ্যাক নিউটন, জোহানেস কেপলার, ক্রিস্টিয়ান হাইগেন্স এবং গ্যালিলিও গ্যালিলি তাঁর কাজ উদ্ধৃত করেছেন।

প্রাথমিক শিক্ষা ও জ্ঞানার্জন

ইবনে আল-হাইথাম তাঁর প্রাথমিক শিক্ষাজীবনে কুরআন, হাদিস, ফিকাহ, দর্শন, গণিত এবং জ্যোতির্বিদ্যার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহে দক্ষতা অর্জন করেন। এরপর তিনি ইরাকের রাজধানী বাগদাদের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন এবং উচ্চশিক্ষায় অগ্রসর হন। বাগদাদের মসজিদ ও মাদ্রাসাগুলোতে তিনি ‘মজলিসে’ বসে শিক্ষক থেকে মৌখিক পাঠ গ্রহণ করতেন, পরে শিক্ষার্থীরা সেই পাঠ লিখে রাখতেন ও তা নিয়ে দৃষ্টান্তভিত্তিক আলোচনা করতেন।

তিনি গ্রিক ও আরবি—উভয় ভাষার সাহিত্য ও বৈজ্ঞানিক রচনার গভীর অধ্যয়ন করেন। বিশেষত ইউক্লিড, আর্কিমিডিস, পটোলেমি এবং আল-ফারাবীর মতো বিশিষ্ট চিন্তাবিদের গ্রন্থাবলি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন, যা তাঁর চিন্তাধারার ভিত্তি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

বাগদাদে বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও অনুশীলন

পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষাধর্মী গবেষণার ধারণা তিনি লাভ করেন বাগদাদের বিশ্ববিখ্যাত House of Wisdom-এর বৈজ্ঞানিক পরিবেশে। সেখানে আল-কিন্দি, আল-খুয়ারিজমী, হুনাইন ইবনে ইসহাকসহ আরও অনেক প্রথিতযশা গবেষকের সঙ্গে কাজ করে তিনি নতুন পদ্ধতি ও চিন্তাধারা আত্মস্থ করেন।

সম্ভবত বাগদাদে অথবা কায়রো যাওয়ার পূর্বে তিনি “এক জ্যামিতিক প্রশ্ন” সমাধান করে তার প্রতিউত্তর লেখেন, যা থেকে জানা যায় যে তিনি সে সময়ে বাগদাদে কিছু গবেষণাকর্মে অংশগ্রহণ করেছিলেন।বাগদাদ” নামটি ইসলামপূর্ব যুগ থেকেই প্রচলিত। এটি ইরাকের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর, এবং আব্বাসীয় যুগে ইসলামী বিশ্বের অন্যতম সাংস্কৃতিক ও প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল। ৭৬২ খ্রিস্টাব্দে আব্বাসীয় খলিফা আবু জাফর আল-মানসুর এই শহর প্রতিষ্ঠা করেন।

টাইগ্রিস নদীর তীরে অবস্থিত এই শহর মধ্যযুগে “শিক্ষার কেন্দ্র” হিসাবে বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পায়। বাগদাদ ছিল ইসলামি সভ্যতা, বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য এবং শিল্পের কেন্দ্রবিন্দু। এর House of Wisdom বা Bayt al-Hikmah ছিল এক বিশ্বখ্যাত গবেষণাকেন্দ্র, যেখানে বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও গবেষকেরা একত্রিত হয়ে জ্ঞানের উন্মোচনে কাজ করতেন। একে বলা হতো ‘বিশ্বের জ্ঞাননগরী’ বা The City of Knowledge

মিশরে যাত্রা ও কার্যক্রম

প্রায় ১০১০ থেকে ১০১৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ইবনে আল-হাইথাম মিশরের কায়রো শহরে গমন করেন। সেখানে তিনি একটি জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পে নিয়োজিত ছিলেন। তবে প্রকল্পটি ব্যর্থ হলে, তিনি নিজেকে মানসিকভাবে অসুস্থ বা পাগল হিসেবে উপস্থাপন করে সরকারি দমন-পীড়ন থেকে মুক্তি লাভ করেন।

তিনি গণিত, অপটিক্স ও দর্শন—এই তিনটি ক্ষেত্রে গভীরভাবে অধ্যয়ন ও গবেষণা করেছেন। এসব গবেষণার ফলাফলই পরবর্তীতে তাঁর সর্বজনস্বীকৃত বিখ্যাত গ্রন্থ কিতাব আল-মানাযির (Kitāb al-Manāir), যা ইংরেজিতে Book of Optics নামে পরিচিত, তাতে অন্তর্ভুক্ত হয়।

???? Book of Optics: বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী গ্রন্থ

Book of Optics ইবনে আল-হাইথাম কর্তৃক রচিত একটি বিপুল প্রভাব বিস্তারকারী বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ, যা প্রায় ১০১১–১০২১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সম্পন্ন হয়। এটি মোট সাতটি খণ্ডে বিভক্ত এবং আলোকবিজ্ঞান, দৃষ্টিবিজ্ঞান, প্রতিফলন, প্রতিসরণসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর ভিত্তিকৃত।

এই গ্রন্থের গবেষণার ভিত্তিতেই তাঁকে "Father of Optics" বা অপটিক্সের জনক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তিনি প্রথমবারের মতো পরীক্ষার মাধ্যমে দেখান যে সৌর আলো, কিংবা যেকোনো আলোক—সবই একই প্রকৃতির, এবং এই আলো গাণিতিকভাবে বিশ্লেষণযোগ্য।

গ্রন্থের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ

  • দৃষ্টির প্রকৃতি ও তত্ত্ব: প্রচলিত গ্রিক emission theory of vision (যেমন: ইউক্লিড ও পটোলেমি) কে চ্যালেঞ্জ করে তিনি বলেন, দৃষ্টিশক্তি চোখ থেকে বেরিয়ে নয়, বরং বস্তুর উপর পড়ে প্রতিফলিত আলো চোখে প্রবেশ করে।
  • আলো ও প্রতিফলন (Reflection): বিভিন্ন ধরনের আয়না থেকে আলো কীভাবে প্রতিফলিত হয়, সে বিষয়টি তিনি বিস্তৃতভাবে বিশ্লেষণ করেছেন।
  • প্রতিসরণ (Refraction): যখন আলো ভিন্ন ঘনত্বের মাধ্যমে প্রবেশ করে, তার গতিপথ কীভাবে পরিবর্তিত হয়—তা তিনি গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের যুক্তিতে ব্যাখ্যা করেন। উদাহরণস্বরূপ, পানিতে ঢোকানো কাঠির ভাঙা দেখানোর ঘটনা।
  • চোখের গঠন ও কার্যপ্রণালী: চোখের কর্নিয়া, লেন্স, রেটিনাসহ বিভিন্ন অংশের কার্যকারিতা এবং কীভাবে এগুলোর মাধ্যমে বস্তু দেখার সক্ষমতা অর্জিত হয়, তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
  • দৃষ্টিভ্রম (Optical Illusions): মানুষের কখন, কেন এবং কীভাবে ভুলভাবে দেখে, তা মনস্তত্ত্ব ও ভাবনার প্রভাবসহ ব্যাখ্যা করেছেন।
  • বৈজ্ঞানিক গবেষণার পদ্ধতি: তিনি পর্যবেক্ষণ, অনুমান, পরীক্ষা ও যাচাই—এই চারধাপে গঠিত গবেষণা-পদ্ধতির প্রয়োগ করেন, যা আজকের আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ভিত্তি হিসেবে পরিগণিত হয়।
  • Alhazen's Problem: গোলাকার আয়নায় আলো প্রতিফলনের একটি জটিল গণিত-সম্পর্কিত সমস্যার সমাধান দেন, যা পরবর্তীকালে ইউরোপীয় গণিতবিদদের নিকট গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে।

তিনি প্রায় ২০০টিরও বেশি গ্রন্থ ও গবেষণাপত্র রচনা করেছেন, যার মধ্যে বিজ্ঞান ছাড়াও দর্শন, যুক্তিবিদ্যা ও ধর্মীয় চিন্তাধারার উপরেও লেখা রয়েছে।

ইসলামী আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় প্রভাব

ইবনে আল-হাইথাম ছিলেন আশ‘রি মতবাদ অনুসারী একজন সুন্নি মুসলিম। তিনি বিশ্বাস করতেন যে বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদ ইসলামের অন্তর্গত এবং সত্যের সন্ধানে উভয়ই প্রয়োজনীয়। তিনি বলেন, প্রকৃতিকে তার নিজের ভাষায় কথা বলতে দিতে হবে; মানুষের ভুল-ত্রুটিকে দূরে সরিয়ে প্রকৃত সত্য জানার চেষ্টা করা উচিত—এই দৃষ্টিভঙ্গিই তাঁর ধর্মীয় বিশ্বাসে নিহিত। ধর্ম ও যুক্তির এই সম্মিলিত মানসিকতা তাঁর বৈজ্ঞানিক কর্মযাত্রার ভিত্তি গঠন করে।

প্রভাব ও উত্তরাধিকার

  • Alhazen Crater: চন্দ্রপৃষ্ঠের দূরবর্তী অংশে অবস্থিত একটি গহ্বরের নাম রাখা হয়েছে “আলহাজেন”—তাঁর সম্মানে।
  • গ্রহাণু ৫৯২৩৯ Alhazen: ইবনে আল-হাইথামের নামে নামাঙ্কিত একটি গ্রহাণু, যা তাঁর জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কিত অবদানের স্বীকৃতি বহন করে।

পরলোকগমন 

১০৪০ খ্রিস্টাব্দে মিশরের কায়রো শহরে ইবনে আল-হাইথাম মৃত্যুবরণ করেন। বিজ্ঞানের ইতিহাসে তাঁর অবদান, চিন্তা ও দর্শন আজও আন্তর্জাতিক গবেষণা ও জ্ঞানচর্চায় আলোর উৎস হয়ে আছে।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter