মুর্শিদ কুলি খান: বাংলার প্রথম স্বাধীন নবাব

মুর্শিদ কুলি খান (১৬৬০ – ৩০ জুন ১৭২৭) বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার প্রথম স্বাধীন নবাব হিসেবে ইতিহাসে স্মরণীয়। তিনি মোহাম্মদ হাদী নামেও পরিচিত এবং জন্মসূত্রে তাঁর নাম ছিল সূর্য নারায়ণ মিশ্র। দাক্ষিণাত্য মালভূমিতে জন্মগ্রহণকারী এই ব্যক্তি একজন হিন্দু থেকে মুসলিম হয়ে ওঠার পর মুঘল সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসক ও পরবর্তীতে বাংলার প্রথম নবাব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর জন্ম হয়েছিল আনুমানিক ১৬৬০ সালে দাক্ষিণাত্য মালভূমিতে, যা মুঘল সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। তাঁর শৈশবকালীন নাম ছিল সূর্য নারায়ণ মিশ্র। মাত্র দশ বছর বয়সে, তাঁকে হাজি শফি নামের এক পারসিক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করা হয়। হাজি শফি তাঁকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন এবং মোহাম্মদ হাদী নাম দেন। এরপর শফির মৃত্যুর পর তিনি বিদর্ভের দিভানের অধীনে চাকরি করেন। এখান থেকেই তাঁর কর্মজীবনের উত্থান শুরু হয়। রাজস্ব সংগ্রহের দক্ষতার মাধ্যমে তিনি সম্রাট আওরঙ্গজেবের নজরে আসেন এবং তাঁকে বাংলার দিভান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

বাংলায় আগমন এবং শাসন শুরুর প্রস্তুতি :

মুর্শিদ কুলি খান ১৭০০ সালে বাংলার দিভান হিসেবে নিযুক্ত হন। তবে এই নিয়োগের ফলে বাংলার সুবাহদার আজিম-উশ-শানের সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্ব শুরু হয়। আজিম-উশ-শান বাংলার রাজস্ব নিজেদের জন্য ব্যবহার করতে চাইলে কুলি খান বাধা দেন। এর ফলে উভয়ের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হয়।

১৭০৭ সালে সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর, কুলি খানকে বাংলার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দাক্ষিণাত্যের মালভূমিতে স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু ১৭১০ সালে তিনি আবার বাংলার দায়িত্বে ফিরে আসেন। ১৭১৭ সালে মুঘল সম্রাট ফররুখসিয়ার তাঁকে বাংলার নবাব হিসেবে ঘোষণা করেন এবং একইসঙ্গে দিভানের দায়িত্বও তাঁর হাতে তুলে দেন। এই পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে মুর্শিদ কুলি খান বাংলার প্রথম স্বাধীন নবাব হিসেবে ইতিহাসে নাম লেখান।

মুর্শিদাবাদের প্রতিষ্ঠা :

ঢাকায় অবস্থান অনিরাপদ মনে করায় মুর্শিদ কুলি খান বাংলার প্রশাসনিক রাজধানী ঢাকার পরিবর্তে মাকসুদাবাদে স্থানান্তর করেন। শহরটি গঙ্গার তীরে অবস্থিত হওয়ায় যোগাযোগ ও বাণিজ্যের জন্য উপযুক্ত ছিল। পরবর্তীতে তিনি শহরটির নাম পরিবর্তন করে নিজের নামানুসারে মুর্শিদাবাদ রাখেন। মুর্শিদাবাদে কুলি খান কাটরা মসজিদসহ আরও অনেক স্থাপনা নির্মাণ করেন। তিনি সেখানে দপ্তর, বাসস্থান এবং ইউরোপীয় বণিকদের জন্য বিশেষ জায়গা তৈরি করেন। মুর্শিদাবাদ ধীরে ধীরে বাংলার প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে পরিণত হয়।

প্রশাসনিক সংস্কার :

মুর্শিদ কুলি খানের শাসনামলে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক ছিল তাঁর প্রশাসনিক সংস্কার। তিনি মুঘলদের প্রচলিত জাগিরদারি ব্যবস্থার পরিবর্তে নতুন মাল জাসমানি ব্যবস্থা চালু করেন। এই ব্যবস্থায় ভূমির কর সংগ্রহের দায়িত্ব জমিদারদের উপর ন্যস্ত করা হয়। জমিদারি প্রথার মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের কার্যক্রম আরও সহজ ও কার্যকর হয়।

এছাড়া তিনি রাজস্বের একটি অংশ মুঘল সাম্রাজ্যে পাঠানো অব্যাহত রাখেন। যদিও মুঘল সাম্রাজ্য তখন ধসে পড়ছিল, তবুও মুর্শিদ কুলি খান এই কাজটি করতেন মুঘল সম্রাটের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের জন্য। প্রতি বছর ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা রাজস্ব হিসেবে মুঘল দরবারে পাঠানো হতো।

অর্থনীতি ও বাণিজ্য :

মুর্শিদাবাদে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রসার ঘটান মুর্শিদ কুলি খান। মুর্শিদাবাদ ধান, রেশম এবং বিভিন্ন ধরনের কৃষিপণ্যের রপ্তানি কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পায়। তবে ১৭২০ সালে তিনি চাল রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন, যা স্থানীয় মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সাহায্য করেছিল। বাণিজ্যের প্রসারে তিনি ইউরোপীয় বণিকদের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধা প্রদান করেন। শহরে নতুন ব্যবসায়ী শ্রেণির উত্থান ঘটে, যারা তাঁর দরবারে উপস্থিত থাকত। মুর্শিদকুলী খান বাংলায় রাজস্ব প্রশাসনকে সুবিন্যস্ত করার জন্য বেশ কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। যেসব জমিদার খেলাপি ছিল তাদের কঠোরভাবে মোকাবিলা করা হতো। বেশ কয়েকটি গ্রাম পরিমাপ করা হয়েছিল এবং নতুন করে মূল্যায়ন করা হয়েছিল। রাজস্ব কর্মকর্তারা জমিদারি থেকে রাজস্ব আদায় করতেন।

তার কঠোর নীতির কারণে বার্ষিক রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি পায়। তিনি তার প্রদেশের জন্য 1722 সালে একটি নতুন বন্দোবস্ত চালু করেন। এটি 1656 সালের পূর্ববর্তী বন্দোবস্তের চেয়ে বেশি ছিল। সাম্রাজ্যিক মনসবদারদের জায়গির উড়িষ্যায় স্থানান্তরিত করা হয়েছিল যদিও মুর্শিদ কুলি খান পারস্য থেকে তার আত্মীয়দের জায়গির ও অফিস বরাদ্দ করে বাধ্য করেছিলেন। এভাবে জায়গিরে বরাদ্দকৃত জমি কমে যায় এবং খালিসা জমি বৃদ্ধি পায় যার ফলে সাম্রাজ্যিক মনসবদারদের থেকে হুমকি কমে যায় যাদের ক্ষমতা চূর্ণ করা হয়েছিল। সাম্রাজ্যিক বাহিনীর আকার হ্রাস করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল এবং তাদের সুযোগ-সুবিধা এবং ভাতাও হ্রাস করা হয়েছিল। মনসবদারদের আরও দুর্বল করার জন্য, মুর্শিদকুলি খান সাম্রাজ্যের কোষাগারে পাঠানোর জন্য পর্যাপ্ত রাজস্ব নিশ্চিত করতে সক্ষম হন এবং বাংলার প্রতি সাম্রাজ্য সরকারের বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক মনোভাব নিশ্চিত করতে পারেন।

ধর্মীয় নীতি :

ধর্মীয়ভাবে মুর্শিদ কুলি খান ছিলেন একজন প্রগতি-minded শাসক। যদিও তিনি একজন মুসলিম শাসক ছিলেন, তবুও হিন্দুদের প্রতি তিনি যথেষ্ট উদার ছিলেন। কর সংগ্রহ এবং অন্যান্য প্রশাসনিক কাজে তিনি অনেক হিন্দু কর্মকর্তাকে নিয়োগ দিয়েছিলেন, কারণ তাঁদের পারস্য ভাষার উপর দক্ষতা ছিল। মুর্শিদাবাদে তাঁর শাসনামলে ঈদ-উল-মিলাদ এবং অন্যান্য ইসলামি উৎসব অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালিত হতো। পাশাপাশি হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসব পালনে কোনো বাধা প্রদান করা হয়নি।

স্থাপত্য ও অবদান :

মুর্শিদ কুলি খান কাটরা মসজিদ নির্মাণ করেন, যেখানে তিনি নিজের জন্য সমাধিস্থল নির্মাণ করেছিলেন। মসজিদটি মুর্শিদাবাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য নিদর্শন। এছাড়াও তিনি দপ্তর, দাতব্য প্রতিষ্ঠান, এবং বণিকদের জন্য সুরক্ষিত জায়গা তৈরি করেন। মুর্শিদকুলি খান 1700 সালে বাংলার দেওয়ান হন। তিনি 1716 থেকে 1727 সাল পর্যন্ত দেওয়ান ও নাজিমের অফিস একত্রিত করেন এবং বাংলার নবাবদের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। মুঘল শাসনামলে প্রদেশের প্রশাসন এইভাবে পরিচালিত হত: একে ফৌজদারের অধীনে সরকারে বিভক্ত করা হয়; যিনি সরাসরি কেন্দ্র কর্তৃক নিযুক্ত ছিলেন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য দায়ী ছিলেন যেখানে আমিল রাজস্ব আদায়কারীর ভূমিকা পালন করতেন; সরকারকে আবার পরগনায় বিভক্ত করা হয় যেখানে কানুনগোরা হিসাবরক্ষক হিসেবে কাজ করত। গ্রাম পর্যায়ে পাটোয়ারী হিসাব রাখার দায়িত্ব পালন করেন।

উত্তরাধিকার ও মূল্যায়ন

১৭২৭ সালের ৩০ জুন মুর্শিদ কুলি খান মারা যান। তাঁর ইচ্ছানুযায়ী তাঁকে কাটরা মসজিদের সিঁড়ির নিচে সমাহিত করা হয়। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর জামাতা সুজা উদ্দীন মুহম্মদ খান বাংলার নবাব হন। তবে মুর্শিদ কুলি খানের শাসনামলে গড়ে ওঠা প্রশাসনিক কাঠামো পরবর্তী নবাবদের শাসন ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মুর্শিদ কুলি খান ছিলেন একজন দক্ষ শাসক এবং প্রশাসক। তিনি বাংলায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করেন এবং অর্থনৈতিকভাবে অঞ্চলটিকে শক্তিশালী করেন। তাঁর শাসনামলে বাংলায় যে সংস্কার এবং উন্নয়ন হয়েছিল, তা বাংলার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে গণ্য করা হয়। মুর্শিদ কুলি খানের জীবন এবং শাসনামলের প্রভাব আজও ইতিহাসে অমলিন। তাঁর নেতৃত্বগুণ এবং প্রশাসনিক দক্ষতা বাংলার ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।




Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter