জ্ঞান যেখানে মুসলমানের পরিচয়: চিকিৎসা বিজ্ঞানে এক বিস্ময়কর যাত্রা
ইসলামি চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাস এক মহিমান্বিত ও বিস্ময়কর ঐতিহ্যের অংশ, যা আমাদের মুসলমানদের গৌরবের অন্যতম প্রধান দিক। প্রিয়নবি মুহাম্মদ (সা.)-এর আগমনেরও বহু আগে, আরবের বুকে একটি মৌলিক চিকিৎসা ব্যবস্থা বিকশিত হয়েছিল। তারা গাছ-গাছড়া, লতা-পাতা থেকে ঔষধ প্রস্তুত করতো, যার আরবি নাম ছিল “আকাকির ওয়াল হাশাইশ”। এই প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতি ছিল চ্যালডিয়ান ঐতিহ্যের সমন্বয়ে গঠিত এবং আরবদের নিজস্ব অভিজ্ঞতার ফল। ইসলামি ঐতিহ্যে আমরা প্রাচীন চিকিৎসকদের মধ্যে হযরত লোকমান (আ.)-এর নাম পাই, যিনি কোরআনেও স্মরণীয়। তারপর আসে খুজাইমের নাম।
ইসলামের সোনালি যুগে মুসলিম মনীষীরা শুধু চিকিৎসা বিদ্যায় সীমাবদ্ধ থাকেননি, বরং তারা গ্রিক, পারসিক ও ভারতীয় চিকিৎসাবিদ্যার সেরা অংশগুলিকে সংগ্রহ করে সেগুলোর উপর ভিত্তি করে এক অভূতপূর্ব, সুসংহত ও আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান গড়ে তুলেছিলেন। হযরত হারিস ইবনে কালদাহ গ্রিক চিকিৎসাবিদ্যার যে বীজ আরবে বপন করেছিলেন, তা পরিপূর্ণ বিকাশ লাভ করে আব্বাসীয় যুগে। বাগদাদ, কুফা, কায়রো—এসব শহর তখন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা গবেষণা কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। মুসলিমরা বিশ্বের সকল চিকিৎসা পদ্ধতির সমন্বয় ঘটিয়ে অনুবাদ করে তা আরবি ভাষায় রচনা করেন এবং নতুন এক চিকিৎসা শাস্ত্রের সূচনা করেন, যাকে আমরা আজ "তিব-এ-ইউনানী" নামে জানি।
এই ইসলামি চিকিৎসাবিজ্ঞানই পরে ইউরোপে প্রভাব বিস্তার করে। অজস্র বছর ধরে ইউরোপের মেডিকেল স্কুলগুলোতে মুসলিম চিকিৎসক ইবনে সিনার আল-কানুন এবং আবুল কাসেম আল-জাহরাবীর অস্ত্রোপচার পদ্ধতি পাঠ্যপুস্তক হিসেবে পড়ানো হতো। বিশিষ্ট পাশ্চাত্য পণ্ডিত ডঃ রবার্ট ব্রিফল্ট পর্যন্ত স্বীকার করেছেন—আজকের এলোপ্যাথিক চিকিৎসার ভিত্তিই গড়ে উঠেছে আরবি চিকিৎসাবিদ্যার উপর। এ গর্ব একদিনে আসেনি; এটি মুসলিম মনীষীদের জ্ঞানের দীপ্তি, গবেষণার তপস্যা এবং মানবতার সেবায় অটল অঙ্গীকারের ফসল।
- অ্যানাটমিতে আরব গণের সুস্পষ্ট জ্ঞান ছিল এবং তারা মানব ও প্রাণী দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নামকরণ করতে সমর্থ হয়েছিল।
- শরীরবিজ্ঞানে মুসলমান চিকিৎসকদের অবদান অবহেলার নয়।
- জীবাণু- বিদ্যার ক্ষেত্রে মুসলমানদের অবদান ছিল বৈপ্লবিক এ বিষয়ে ইবনে খাতিব এবং ইবনে খাতিমাহ যে ট্রিটিজ রচনা করেছিলেন তা যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক তথ্য নির্ভর ছিল। তার সাথে সাথে রোগ সৃষ্টির কারণ, লক্ষণ, ফলাফল প্রভৃতি নির্ধারণে মুসলমান চিকিৎসকদের অনুসন্ধান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
- সার্জারির ক্ষেত্রে মুসলমান চিকিৎসকদের অবদান অবজ্ঞার নয়।
- চক্ষুরোগ ও নেত্রবিজ্ঞানে মুসলমান চিকিৎসকদের ভূমিকা অধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং চক্ষু অপারেশনের ক্ষেত্রে তাদের দক্ষতা ছিল অতি স্মরণীয়।
- ধাত্রীবিদ্যার উন্নয়নের ক্ষেত্রে মুসলমানদের ভূমিকা ছিল অসামান্য।
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে মুসলমানগণ চিকিৎসাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এক অসাধারণ জ্ঞান, দক্ষতা ও প্রজ্ঞার অধিকারী ছিলেন। তারা শুধু বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন না, বরং তারা চিকিৎসাবিদ্যার প্রতিটি শাখায় এমন এক মৌলিক অবদান রেখেছেন, যা মানবজাতির ইতিহাসে স্থায়ী ছাপ রেখে গেছে। তথ্যভিত্তিকভাবে বলা যায়—ঔষধ ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের এমন কোন শাখা ছিল না, যা তাদের দখলের বাইরে ছিল। এই শাস্ত্র, যা একসময় ছিল বিভ্রান্তিকর, সীমিত ও বিক্ষিপ্ত, তা মুসলমান মনীষীদের হাতে গঠিত হয়েছিল এক সুসংহত, কার্যকর ও নান্দনিক রূপে। তারা শুধু অতীতের জ্ঞান সংরক্ষণ করেননি—তারা সেটিকে বিশ্লেষণ, সমন্বয় ও উন্নয়নের মাধ্যমে নতুন এক যুগের দিগন্তে পৌঁছে দিয়েছিলেন।
মুসলিম চিকিৎসকেরা শুধু নিজেদের অঞ্চলভুক্ত ভেষজ উদ্ভিদ ও উপাদান নিয়ে সীমাবদ্ধ থাকেননি। তাঁরা ভারত, চীন, পারস্য ও বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য থেকে অমূল্য উপাদান সংগ্রহ করে তা ফার্মাকোলজির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছিলেন। “ফার্মাকোপিয়া”, “হাইওসসায়েমাস”, “অপিয়েটস”, এমনকি “ডিস্টিলেশন” প্রযুক্তিও তাঁদের অজানা ছিল না। ইবনে সিনার আল-কানুন ফিৎ তিব্ব একা মধ্যযুগীয় ইউরোপের মেডিকেল শিক্ষার ভিত্তি গড়ে তোলে। ইউরোপের সার্জারির জনক হিসেবে যাঁকে মানা হয়—আবুল কাসেম আল-জাহরাবী—তিনি শত শত অস্ত্রোপচারের যন্ত্র আবিষ্কার করে এক বিপ্লব সৃষ্টি করেছিলেন। মধ্যযুগে মুসলমানদের চিকিৎসাবিষয়ক রচনাসমূহ এতই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল যে পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষদিকে ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মেডিকেল সিলেবাসের অর্ধেকই আরবি চিকিৎসাবিদ্যার অনুবাদে পূর্ণ ছিল।
তবে সত্য এই যে, চিকিৎসা বিজ্ঞানের এই গৌরবময় উত্তরাধিকারের কৃতিত্ব এককভাবে মুসলমানদের বলা অনুচিত হলেও, এই শাস্ত্রের মূল ভিত্তি যাঁরা স্থাপন করেছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন মুসলিম মনীষী। আমাদের ঐতিহ্য শুধুই গর্বের বিষয় নয়—এটি ইতিহাসের এক অমূল্য সম্পদ। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, আজ সেই অতীত গৌরব আমাদের স্মৃতি থেকে মুছে যেতে বসেছে। আধুনিক মুসলিম সমাজ যে অবক্ষয়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, তার পেছনে অন্যতম কারণ—আমরা আমাদের ঐতিহ্য, জ্ঞান ও ধর্মীয় আত্মপরিচয় থেকে দূরে সরে গেছি।
এখন সময় এসেছে আবার এক নতুন মুসলিম চিকিৎসা বিপ্লবের সূচনা করার। আমাদের পূর্বসূরিদের মত গবেষণা, উদ্ভাবন এবং জ্ঞানের প্রতি অপরিসীম নিষ্ঠা নিয়ে আমরা যদি আবার সামনে এগিয়ে আসি, তবেই আমরা অতীতের ভুল শুধরে ভবিষ্যতের জন্য এক শক্তিশালী ও সম্মানজনক অবস্থান তৈরি করতে পারবো। অতীতের ঐ গৌরব শুধু স্মরণ করার জন্য নয়—তার উত্তরাধিকার বহন করে তা নবজাগরণে রূপান্তর করাই হলো আমাদের প্রজন্মের আসল দায়িত্ব।