বিস্মৃত নয়, গর্বের নাম তাঁরা: ইসলামের পথে বীর নারীরা  প্রথম স্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা নারী সাহাবি রুফাইদা (রা.)- পর্ব - ১

ইতিহাস যাদের ভাস্কর্য গড়তে ভুলে গেছে, তাদের মধ্যে রুফাইদা আল আসলামিয়া (রা.) একটি উজ্জ্বল নাম। আমরা যখন আধুনিক নার্সিংয়ের জননী হিসেবে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলকে স্মরণ করি, তখন ভুলে যাই—তাঁর হাজার বছর আগেই আরবের প্রখর রোদ ও যুদ্ধবিক্ষুব্ধ প্রান্তরে এক মহীয়সী নারী দাঁড়িয়েছিলেন চিকিৎসা ও সেবার দীপ্ত মশাল হাতে। তিনি শুধু নার্স ছিলেন না, ছিলেন এক ধরনের স্বপ্নদ্রষ্টা—যিনি নারীদের জন্য সেবাব্রতের পথ খুলে দিয়েছিলেন ইসলামের প্রথম যুগেই।

রুফাইদা আল আসলামিয়া: ইতিহাসের আড়ালে এক দীপ্ত নাম

মদিনার খাজরাজ গোত্রের আসলাম শাখার সন্তান রুফাইদা আল আসলামিয়া (রা.) প্রথমদিকের ইসলাম গ্রহণকারীদের একজন। তাঁর পিতা হযরত আসলাম (রা.) চিকিৎসাবিদ্যায় সুপণ্ডিত ছিলেন। পিতার অনুপ্রেরণায় ও নিজ আগ্রহে তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রে পারদর্শিতা অর্জন করেন। শুধু জ্ঞান অর্জন করেই থেমে থাকেননি—নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন মানবতার সেবায়। যুদ্ধের সময় আহত সাহাবিদের চিকিৎসার জন্য তিনি তৈরি করেছিলেন একটি অস্থায়ী তাঁবু হাসপাতাল—‘খাইমাতু রুফাইদা’, যা ইতিহাসে ইসলামি চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রথম প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত।

খন্দকের যুদ্ধে হযরত সা’আদ বিন মুআজ (রা.)-এর মারাত্মক জখম হলে তাঁকে এই রুফাইদার তাঁবুতে পাঠানো হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রতিদিন গিয়ে তাঁর অবস্থা জিজ্ঞেস করতেন। খায়বার যুদ্ধেও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর সেবার স্বীকৃতিস্বরূপ রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁকে যুদ্ধের গনিমতের অংশ দিতেন—যা ছিল এক অভাবনীয় সম্মান।

তাঁর সময়ের সুযোগ ও তাঁদের ব্যবহার: এক প্রেরণার পাঠ

রুফাইদা (রা.)-এর সময় ছিল সহজ নয়। নারীর স্বাধীনতা তখনকার আরব সমাজে ছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। তবুও, তিনি তাঁর পারিবারিক ও গোত্রীয় অবস্থান, চিকিৎসাবিদ্যায় জ্ঞান এবং ধর্মীয় আদর্শকে কাজে লাগিয়ে গড়েছিলেন একটি ইতিহাস। তাঁর সামনে সুযোগ খুব কম ছিল, কিন্তু যেটুকু ছিল—তিনি সেটুকুকেই সর্বোচ্চভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন।

এই সময়ের নারীদের তুলনায় তখনকার সুযোগ অনেক সীমিত হলেও তাঁরা সেই সীমাবদ্ধতাকেই শক্তিতে রূপান্তর করতে পেরেছিলেন। আজকের নারীরা উচ্চশিক্ষা, প্রযুক্তি, আন্তর্জাতিক সহায়তা, সংবিধানিক অধিকারসহ অজস্র সুযোগের মাঝে দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই সুযোগগুলো কতটা কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে?

আজকের সমাজ: সুযোগ আছে, কিন্তু আদর্শ কোথায়?

বর্তমানে স্বাস্থ্যখাতে নারীদের অংশগ্রহণ অনেক বেড়েছে। নার্সিং, ডাক্তারি, পাবলিক হেলথ—সব ক্ষেত্রেই নারীরা অগ্রণী। তবে রুফাইদার (রা.) সময়ের মতো আত্মত্যাগ, নিষ্ঠা ও মানবিকতার অভাব লক্ষণীয়। তিনি চিকিৎসাকে পেশা হিসেবে নয়, এক ধরনের ইবাদত হিসেবে দেখতেন। যুদ্ধে আহত যোদ্ধার ক্ষত সেবা করার মাধ্যমে তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে ব্রত ছিলেন।

আধুনিক সমাজে চিকিৎসা অনেকাংশে বাণিজ্যিক হয়ে গেছে। রোগী সেবার ক্ষেত্রেও দেখা যায় দায়িত্বহীনতা ও মানবিক ঘাটতি। এইখানেই রুফাইদা (রা.)-এর শিক্ষা আমাদের দরকার—তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, সীমিত সংস্থানেও আত্মনিবেদন আর আদর্শ নিয়ে কাজ করলে কীভাবে ইতিহাস গড়া যায়।

কেন আমরা পারছি না, অথচ তারা পেরেছিলেন?

তাঁদের কাছে ধর্ম ছিল চালিকাশক্তি, আমাদের কাছে তা প্রায়শ লোকদেখানো অনুষঙ্গ। তাঁদের কাজ ছিল ‘উম্মাহ’র জন্য, আমাদের কাজ ব্যক্তি প্রতিষ্ঠা বা সুনাম অর্জনের জন্য।তাঁরা সীমিত সুযোগে সংগ্রাম করতেন, আমরা অসীম সুযোগেও পিছিয়ে পড়ছি আত্মকেন্দ্রিকতায়। এই ব্যবধানের কারণ আমাদের মূল্যবোধের অবক্ষয়। আত্মত্যাগ, নৈতিকতা, সহমর্মিতা—এসব গুণ হারিয়ে যাচ্ছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বার্থ ও প্রাপ্তির দৌড়ে।

ভবিষ্যতের সম্ভাবনা: এক নবজাগরণ সম্ভব কি?

রুফাইদা (রা.) শুধু ইতিহাসের পাতায় বন্দি কোনো চরিত্র নন, বরং এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা। তাঁর নামেই বর্তমানে ‘রুফাইদা নার্সিং প্রাইজ’ প্রদান করা হয় বাহরাইনে—যা নার্সিং শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করে রোগীসেবার আদর্শে। এটি প্রমাণ করে, ইতিহাস ঠিকই ফিরে আসে, যদি কেউ সেই আদর্শকে ধারণ করে এগোতে চায়।

আজকের মুসলিম সমাজে যদি রুফাইদার জীবনচরিত মেয়েদের সামনে তুলে ধরা হয়, তাহলে নতুন এক চিন্তার জন্ম হতে পারে। নারীরা শুধু শিক্ষিত নয়, আদর্শবান, মানবিক ও সেবাপরায়ণ হয়ে উঠতে পারে।

শুধু স্বাস্থ্যক্ষেত্রে নয়, জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে রুফাইদা (রা.)-এর মতো নারীরা প্রয়োজন—যারা জীবনের চেয়ে বড় লক্ষ্যকে সামনে রেখে কাজ করতে জানে।

শ্রদ্ধা নয়, অনুসরণ চাই !

রুফাইদা (রা.) ছিলেন সাহাবা, মহীয়সী নারী, চিকিৎসক, মানবসেবিকা—আরও বড় কথা, তিনি ছিলেন এক বাতিঘর। তাঁর তাঁবু ছিল শুধু আহতদের চিকিৎসাকেন্দ্র নয়, এক আদর্শের উৎস। আমাদের সমাজ আজ যেসব সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে—নৈতিকতা সংকট, মানবিক শূন্যতা, দায়িত্বহীনতা—তার সমাধান রুফাইদার মতো আদর্শদের মধ্যেই নিহিত।

তাঁকে শুধুই ইতিহাসের পাতায় রেখে দিলে চলবে না। আমাদের দরকার সেই আদর্শকে আবারও জীবন্ত করে তোলা, আমাদের মেয়েদের হৃদয়ে সেই আলো জ্বালানো। আধুনিক সমাজের এত সুযোগ, এত সম্ভাবনার মাঝেও আমরা যদি তাঁর মতো একজনকেও গড়তে না পারি—তাহলে আমাদের ব্যর্থতাই প্রকট হয়ে উঠবে।

আজ তাই দরকার, ‘খাইমাতু রুফাইদা’-র মতো মানবসেবার তাবু আমাদের সমাজে আবার গড়ে উঠুক—যেখানে সেবিকা হবে শুধু কর্মী নয়, এক আদর্শ বাহক।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter