হাদীসের ব্যাখ্যার বহুমাত্রিক ধারা: Joel Blecher-এর Said the Prophet of God গ্রন্থের আলোকে এক পাঠ

ইসলামি অধ্যয়নের বিস্তৃত পরিসরে হাদীসশাস্ত্র একটি মৌলিক ও প্রভাবশালী শাখা। নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর বাণীসমূহ তথা হাদীস যুগে যুগে মুসলিম চিন্তাবিদদের কাছে কেবল ধর্মীয় নির্দেশনা নয়, বরং সমাজ ও সংস্কৃতির বিকাশের একটি প্রাণবন্ত সূত্র হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। Joel Blecher-এর Said the Prophet of God গ্রন্থটি এ-সম্পর্কে আমাদের এক অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি উপহার দেয়।

Blecher এই গ্রন্থে দেখিয়েছেন, হাদীসের ব্যাখ্যা কখনোই একটি স্থির, নিরপেক্ষ প্রক্রিয়া ছিল না—বরং তা ক্রমাগত পুনর্নির্মিত হয়েছে নানা ভৌগোলিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে। তাঁর গবেষণার কেন্দ্রে রয়েছে তিনটি বিশেষ অঞ্চল: আন্দালুস, মামলুক শাসিত মিশর-সিরিয়া এবং ঔপনিবেশিক ও আধুনিক ভারত।

প্রথমেই বলা যায় আন্দালুস তথা মুসলিম স্পেনের প্রসঙ্গ। সেখানে হাদীসকে দেখা হয়েছে যুক্তিবাদ ও ইসলামী ন্যায়বিচারবোধের আলোকে। গ্রিক দর্শনের প্রভাবে গড়ে ওঠা চিন্তাভাবনার সাথে ইসলামি চিন্তার সংমিশ্রণে তৈরি হয় একটি সূক্ষ্ম ব্যাখ্যাপদ্ধতি। এখানে পণ্ডিতগণ হাদীসকে শুধু ধর্মীয় নির্দেশনা হিসেবে নয়, ন্যায়শাস্ত্র ও সমাজতাত্ত্বিক আলোচনার কেন্দ্রে স্থাপন করেন।

এরপরে আমরা যেতে পারি মামলুক শাসিত মিশর ও সিরিয়ার দিকে, যেখানে হাদীসের ভূমিকা ছিল রাষ্ট্রক্ষমতার অঙ্গ হিসেবে। ধর্মীয় কর্তৃত্ব, আধ্যাত্মিক সাধনার ধারার (বিশেষত সুফিবাদের) সঙ্গে মিলিত হয়ে হাদীস সেখানে রূপ পায় রাজনৈতিক ও সামাজিক সাংঘর্ষিকতার দলিলে। Blecher দেখান, এই অঞ্চলে হাদীসের ব্যাখ্যা একদিকে অধিকার ও দায়িত্বের বিতর্ক উসকে দেয়, অন্যদিকে এটি ব্যবস্থাপনাগত নিয়ন্ত্রণের একটি মাধ্যমও হয়ে ওঠে।

সবশেষে আসে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রসঙ্গ, বিশেষ করে ঔপনিবেশিক ও আধুনিক ভারতের প্রেক্ষাপট। ব্রিটিশ শাসনের সময় ইসলামি জ্ঞানের স্বাতন্ত্র্য রক্ষার জন্য হাদীস হয়ে ওঠে প্রতিরোধের ভাষা। দেওবন্দ ও আলিগড়ের মতো প্রতিষ্ঠানগুলি হাদীসের ব্যাখ্যা ব্যবহার করে শিক্ষার কাঠামো পুনর্নির্মাণ করে, এবং ইসলামি আত্মপরিচয়ের ভিত্তি স্থাপন করে আধুনিক চিন্তার প্রেক্ষাপটে। Blecher দেখান, হাদীস এখানে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক অস্ত্র—যার মাধ্যমে মুসলিম সমাজ নিজের অবস্থানকে সংজ্ঞায়িত করে।

Joel Blecher-এর Said the Prophet of God কেবল হাদীসশাস্ত্রের একটি ইতিহাস নয়, বরং এটি ইসলামি চিন্তার অভিযোজন ও স্থায়ীত্বের একটি নৈতিক ও দার্শনিক পাঠ। লেখকের ভাষাশৈলী গবেষণার গাম্ভীর্যকে ছাপিয়ে সাহিত্যিক সৌন্দর্য ও ব্যঞ্জনায় সমৃদ্ধ। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—ঐশী বাণীও সময়ের দাবিতে নতুন অর্থ ধারণ করতে পারে, এবং সেই অর্থের নির্মাণে যুক্ত হয় মানুষের অভিজ্ঞতা, সংকট ও কল্পনা।

হাদীস ব্যাখ্যার নাটকীয়তা ও ক্ষমতার এক পাঠ

Joel Blecher-এর Said the Prophet of God গ্রন্থে হাদীসের ব্যাখ্যা কেবল ধর্মীয় বোধের অভিব্যক্তি হিসেবে নয়, বরং তা রাজনৈতিক কৌশল, সামাজিক প্রভাব ও সাংস্কৃতিক অভিনয়ের এক অন্তর্নিহিত মঞ্চ রূপে হাজির হয়। লেখক দেখিয়েছেন যে, বিশেষত মামলুক শাসনামলে, হাদীসের ব্যাখ্যা অনেকাংশে এক ধরনের পারফর্মেটিভ (performative) পদ্ধতিতে পরিবেশিত হত—যেখানে পণ্ডিতের ভঙ্গি, কণ্ঠস্বরের উত্থান-পতন, আবেগের ব্যঞ্জনা এবং শব্দচয়নের মুন্সিয়ানা দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যে প্রভাব সৃষ্টির হাতিয়ার হয়ে উঠত।

এই পরিসরটি মূলত এক ধরনের জ্ঞান-আধিপত্যের ক্ষেত্র, যেখানে হাদীস ব্যাখ্যা করতে পারা নিজেই একপ্রকার ক্ষমতার চিহ্ন। মামলুক যুগে শাসকগোষ্ঠী ও ধর্মীয় পণ্ডিতদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল পারস্পরিক সুবিধাভোগী। অনেক সময়ই ধর্মীয় ব্যাখ্যা এমনভাবে উপস্থাপিত হতো, যাতে শাসকের নীতিমালা ও কর্তৃত্বকে নৈতিক যুক্তির কাঠামোয় বৈধতা দেওয়া যায়।

‘দ্বাররক্ষক’ বা জ্ঞানের নিয়ন্ত্রক—এক অন্তরালের রাজনীতি

গ্রন্থে যে 'গেটকিপার' শব্দটি বারবার উঠে এসেছে, তা নেহায়েত উপমা নয়; বরং এটি হাদীস ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে একটি স্পষ্ট ক্ষমতার রূপরেখা নির্মাণ করে। Blecher দেখিয়েছেন যে নির্দিষ্ট কিছু পণ্ডিত—যেমন ইবনে হাজর আল-আসকালানি ও বদরুদ্দিন আয়নী—নিজ নিজ মাজহাব অনুযায়ী হাদীস ব্যাখ্যা করতেন, এবং একই হাদীসের পরিপ্রেক্ষিতে একে অপরের মতের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হতেন।

এই দ্বন্দ্ব কেবল মতবৈষম্য নয়, বরং এটি হাদীস ব্যাখ্যার অধিকার নিয়ে হওয়া প্রতিযোগিতা। কে ইসলামের 'প্রামাণ্য' ভাষ্য দিতে পারবে—এই প্রশ্নে তাঁদের অবস্থান ছিল ‘অধিকারিত’ জ্ঞানচর্চার প্রতীক। Blecher এই অবস্থানকে বিশ্লেষণ করেছেন মিশেল ফুকোর ‘raréfaction’ ধারণার আলোকে, যা বলে দেয়—জ্ঞানকে কীভাবে সামাজিক কাঠামোর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত, নিয়ন্ত্রযোগ্য ও সীমিত করে রাখা হয়। অর্থাৎ, ইসলামী বক্তব্য সকলের নয়; এটি নির্বাচিত, অনুমোদিত, এবং অনেকক্ষেত্রে রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত।

তাআজীর ও ব্যাখ্যাগত বহুত্ব—একটি বিতর্কের আলোকে

গ্রন্থটির এক গুরুত্বপূর্ণ পর্বে 'taʿzīr' সংক্রান্ত একটি বিতর্ক আলোচনা করা হয়েছে—যা মূলত বিচারকের অধিকার অনুযায়ী শাস্তি প্রদান নিয়ে। এখানে Blecher তুলনা করেছেন দুই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি: ইবনে হাজর বলেন, এই হাদীস অনুযায়ী শাস্তি দশটি বেত্রাঘাতের বেশি হওয়া উচিত নয়, যেখানে ইবনে তাইমিয়া মত দেন যে পরিস্থিতি অনুযায়ী বিচারক অধিক শাস্তি দিতে পারেন।

এই বৈপরীত্য দেখায় যে হাদীস ব্যাখ্যা একটি গাণিতিক বা একমাত্রিক প্রক্রিয়া নয়। বরং একই বাণী থেকে ভিন্ন চিন্তাধারার মানুষ ভিন্ন মত ও আইনিক নীতির প্রবক্তা হতে পারেন। এটি ইসলামী আইনের গঠনগত গঠনে ব্যাখ্যাগত বহুত্ব (pluralism of interpretation) ও প্রসঙ্গভিত্তিক যুক্তির গুরুত্ব তুলে ধরে। একেই Blecher একটি 'জীবন্ত পাঠ' রূপে বর্ণনা করেছেন।

Joel Blecher-এর Said the Prophet of God গ্রন্থে হাদীস ব্যাখ্যাকে শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় অনুশীলন হিসেবে দেখানো হয়নি—বরং তা সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাবেরও বাহক। লেখক দেখিয়েছেন, মামলুক যুগে হাদীসের ব্যাখ্যা ছিল অনেকটা মঞ্চস্থ নাটকের মতো। একজন ব্যাখ্যাকারী তাঁর বক্তৃতার ভঙ্গিমা, উচ্চারণের নান্দনিকতা, আবেগের তীব্রতা ও শব্দচয়নের কৌশল দিয়ে জনসাধারণের মুগ্ধতা অর্জন করতেন। এই ব্যাখ্যাগুলো কখনো কখনো বিচারিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা, জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি কিংবা শাসক শ্রেণির আনুকূল্য পাওয়ার উদ্দেশ্যেও প্রভাবিত হতো। ফলে হাদীসের ব্যাখ্যা হয়ে ওঠে সামাজিক ভয়েস, রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের হস্তকৌশল, এবং ধর্মীয় অভিনয়শিল্পের এক অঙ্গ।

এছাড়া লেখক ‘গেটকিপার’ বা ‘দ্বাররক্ষক’ ধারণার মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে হাদীস ব্যাখ্যার অধিকার সকলের ছিল না। Blecher এখানে তুলে ধরেছেন ইবনে হাজর ও আয়নী নামক দুইজন পণ্ডিতের উদাহরণ, যারা নিজ নিজ মাজহাব—শাফি’ ও হানাফি—অনুযায়ী হাদীস ব্যাখ্যা করতেন এবং পরস্পরের ভাবনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেন। এই দ্বন্দ্ব কেবল মতের বিরোধ নয়, বরং কে ইসলামের ভাষ্য নির্মাণ করতে পারবেন—এই প্রশ্নের কেন্দ্রে ছিল। এই প্রবণতা মিশেল ফুকোর ‘raréfaction’ ধারণার সঙ্গে মিল রেখে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ফুকো বলেছিলেন, কীভাবে জ্ঞান ও কথনকে নির্দিষ্ট পরিসরে সীমাবদ্ধ করে, কিছু মানুষের হাতে তার কর্তৃত্ব কেন্দ্রীভূত হয়—Blecher এই ধারণা ব্যবহার করে দেখান যে ইসলামি জ্ঞানচর্চায়ও এমন ক্ষমতার বলয় নির্মিত হয়েছে।

গ্রন্থটির একটি গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ অংশ হল ‘taʿzīr’ বা বিচারকের দ্বারা শাস্তি নির্ধারণ সংক্রান্ত একটি হাদীস নিয়ে দুজন পণ্ডিতের ভিন্নমত। ইবনে হাজর মনে করেন এই হাদীস অনুসারে শাস্তি দশটি বেত্রাঘাতের বেশি হওয়া উচিত নয়, যেখানে ইবনে তাইমিয়া বলেন পরিস্থিতি অনুযায়ী বিচারক বেশিও দিতে পারেন। এই বিভাজন দেখায় যে হাদীসের পাঠ সর্বজনীন নয়; বরং তা প্রসঙ্গনির্ভর, বিচারমূলক এবং ব্যক্তি ও মাজহাবভিত্তিক চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত। এটি আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে ধর্মীয় ভাষ্য শুধুমাত্র ঐশী সত্য নয়—তা মানুষের চিন্তা, অভিজ্ঞতা ও প্রয়োজনে নিয়ন্ত্রিত এবং বহুরূপী।




Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter