ইবনে সিনা: চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক জীবন্ত কিংবদন্তি

ইবনে সিনা একজন খ্যাতিমান মুসলিম বিজ্ঞানী হিসাবে পরিচিত। তাঁর পুরো নাম ছিল আবু আলী আল-হুসাইন ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আল হাসান ইবনে আলী ইবনে সিনা। লাতিন ভাষায় তাঁর নাম বিকৃত হয়ে পরিচিত হয় Avicenna নামে, তবে ইতিহাসের পাতায় আজও তিনি ‘ইবনে সিনা’ নামেই সর্বাধিক পরিচিত।তিনি ৯৮০ খ্রিস্টাব্দে বুখারার (বর্তমান উজবেকিস্তান) নিকটবর্তী একটি গ্রামে এক ইসমাইলি শিয়া পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আব্দুল্লাহ ছিলেন শিয়া হলেও কাজ করতেন সুন্নি শাসিত সরকারের অধীনে। ইবনে সিনাকে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান ও ক্লিনিক্যাল ফার্মাকোলজির জনক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইরান, তুরস্ক, আফগানিস্তান, ব্রিটেন, রাশিয়া সহ বহু দেশের জ্ঞানী সমাজ তাঁকে জাতীয় গর্ব হিসেবে দাবি করে।

শৈশব থেকেই প্রতিভাবান

ইবনে সিনা ছোটবেলা থেকেই অসাধারণ মেধা ও প্রতিভার পরিচয় দেন। মাত্র ১০ বছর বয়সেই তিনি সম্পূর্ণ কুরআন মুখস্থ করেন। তিনি কুরআনের ব্যাখ্যা নিয়ে পাঁচটি পুস্তিকা রচনা করেন, যার মধ্যে একটি ছিল “নবুত্তের প্রমাণ” শিরোনামে। যুক্তিবিদ্যা ব্যবহার করে কুরআনের ব্যাখ্যা প্রদানকারী তিনি অন্যতম, যার প্রমাণ তাঁর “আল-বুরহান আল-সিদ্দিকীন” গ্রন্থ। এতে তিনি যুক্তির সাহায্যে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব প্রমাণ করেন এবং তৎকালীন ঈশ্বর-অবিশ্বাসীদের শক্ত জবাব দেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানে আত্মনিয়োগ করেন এবং দরিদ্র ও অসহায় রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান করতেন। ফলে তাঁর সুনাম দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ১৭ বছর বয়সে তিনি বিভিন্ন শাস্ত্রে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন, যার পেছনে তিনজন গৃহশিক্ষকের অবদান ছিল:

• ইসমাইল সুফি (ধর্মতত্ত্ব, ফিকহ ও তাফসির),

• মাহমুদ মসসাহ (গণিত),

• নাতেলি (দর্শন, ন্যায়শাস্ত্র, জ্যামিতি, টলেমির আল-মাজেস্ট, আইন শাস্ত্র ও জ্যোতিষশাস্ত্র)।

নাতেলি ইবনে সিনার প্রতিভা দেখে বিস্মিত হয়ে তাঁর পিতাকে বলেছিলেন, "আপনার ছেলে একদিন বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী হবে; পড়াশোনায় যেন কোনো ব্যাঘাত না ঘটে।" কিছুদিন পর নাতেলি স্বীকার করেন যে, ইবনে সিনার মেধার গভীরতায় তিনি নিজেও আর শিক্ষা দিতে সক্ষম নন। তখন ইবনে সিনা নিজ চেষ্টায় অগ্রসর হতে থাকেন। আত্মজীবনীতে তিনি উল্লেখ করেন:

"ওস্তাদ যেভাবে সমস্যার সমাধান করতেন, আমি তার চেয়েও উত্তমভাবে করতে পারতাম।"

মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসকের মর্যাদা অর্জন করেন এবং ১৯ বছর বয়সে বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, অর্থনীতি, রাজনীতি, গণিত, জ্যামিতি, ন্যায়শাস্ত্র, সাহিত্য ও চিকিৎসাশাস্ত্রসহ বহু বিষয়ে অসাধারণ দক্ষতা লাভ করেন। ২১ বছর বয়সে তিনি “আল-মাজমুয়া” নামক একটি বিশ্বকোষ রচনা করেন। ধারণা করা হয়, ইবনে সিনা প্রায় ৪৫০টি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, যার মধ্যে ১৫০টি দর্শনশাস্ত্র এবং ৪০টি চিকিৎসা বিজ্ঞানের ওপর।

আল-কানুন ফিৎ তিব

চিকিৎসা বিজ্ঞানে তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত রচনা হলো “আল-কানুন ফিৎ তিব” (The Canon of Medicine)।

এই চিকিৎসা বিশ্বকোষে রয়েছে:

• প্রথম খণ্ড: শরীরতত্ত্ব ও স্বাস্থ্যবিজ্ঞান,

• দ্বিতীয় খণ্ড: ৭৫০টি গুল্ম, প্রাণীজ ও খনিজ ওষুধের বর্ণনা,

• তৃতীয় খণ্ড: মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গের রোগ, উপসর্গ ও নির্ণয়,

• চতুর্থ খণ্ড: জ্বর, কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়রিয়া, বসন্ত, হাড় ভাঙা, চামড়ার রোগ ইত্যাদি,

• পঞ্চম খণ্ড: রোগের ব্যবস্থাপত্র, বড়ি, পাউডার, সিরাপ প্রভৃতি চিকিৎসা সামগ্রী।

তাঁর আরেক বিখ্যাত গ্রন্থ “কিতাবুশ শিফা” একটি দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক বিশ্বকোষ। এখানে তিনি বলেন:

"মন দেহকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে। মন সুস্থ থাকলে শরীরও সহজেই সুস্থ হয়।"

আধুনিক গবেষণায়ও তাঁর এই বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে; চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বলেন, মানুষের ৭০%-৭৫% রোগ মানসিক কারণে সৃষ্টি হয়।

ইবনে সিনা এবং মনোবিজ্ঞান

ইবনে সিনা জ্ঞানচর্চায় এতটাই নিবেদিত ছিলেন যে, এক রাতেই সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত ১০০ পৃষ্ঠার গবেষণাপত্র রচনা করে ফেলতেন। কোনো বিষয় বুঝতে না পারলে তিনি দু'রাকাত নফল নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতেন এবং প্রার্থনা করতেন, "হে আল্লাহ! তুমি আমার জ্ঞানের দরজা খুলে দাও।" আল্লাহর দয়ায় তিনি মাঝে মাঝে স্বপ্নে অমীমাংসিত সমস্যার সমাধান পেয়ে যেতেন।

সৈয়দ হোসেন লিখেছেন, ইবনে সিনার মতে আত্মা দেহের কাঠামো দ্বারা আবদ্ধ হলেও তিনি ‘ভালো আত্মা’ বা ‘মন্দ আত্মা’ নামে কোনো ভেদ করেননি। বরং তিনি বিশ্বাস করতেন, আত্মার মুক্তির পথ হচ্ছে জ্ঞান অর্জন, যা প্লেটোর “ফেডো” গ্রন্থের ভাবনার সঙ্গে মিল রাখে। তিনি স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে একটি অনন্ত বিকিরণ প্রক্রিয়ার ধারণাকে প্রাধান্য দিয়েছেন।

অবশেষে, আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের এই মহান জনক ১০৩৭ খ্রিস্টাব্দের ২২ জুন হামাদানের যুদ্ধশিবিরে মাত্র ৫৮ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter