ঈদে মীলাদুন্নবী (সা): ভারতীয় প্রেক্ষাপটে ইতিহাস, উদ্ভব ও সামাজিক তাৎপর্য

ভারতে নবীপ্রেমের সাংস্কৃতিক উদযাপন

বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর কাছে মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্মদিন এক গভীর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও আধ্যাত্মিক ভাবগাম্ভীর্যের প্রতীক। প্রতি বছর হিজরি বর্ষের রবিউল আউয়াল মাসের বারো তারিখে মুসলমানরা “ঈদে মীলাদুন্নবী” নামে পরিচিত এই দিনটি উদযাপন করে থাকে। ভারত, যেখানে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যা বসবাস করে, সেখানে এই দিনটির তাৎপর্য কেবল ধর্মীয় পরিসরে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি এক বর্ণময় ও গভীর সামাজিক-সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। ভারতে এই দিনটি একটি রাষ্ট্রীয় ছুটির দিন, যা এর জাতীয় গুরুত্বকে তুলে ধরে। কেরালা থেকে কাশ্মীর, গুজরাট থেকে পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত, ভারতের মুসলমানরা বিপুল উদ্দীপনা ও আয়োজনের মাধ্যমে দিনটি পালন করে। শহর ও গ্রামের রাস্তাঘাট সবুজ পতাকা, ব্যানার ও আলোকসজ্জায় সজ্জিত হয়। মসজিদ, দরগাহ ও খানকাহগুলোতে আয়োজন করা হয় বিশেষ মাহফিল, যেখানে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবন, আদর্শ ও মানবতার প্রতি তাঁর অবদান নিয়ে আলোচনা করা হয়। এই দিনকে কেন্দ্র করে আয়োজিত ‘জলুস-এ-মোহাম্মদী’ বা শোভাযাত্রা ভারতীয় সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে, যেখানে লক্ষ লক্ষ ধর্মপ্রাণ মুসলমান একত্রিত হয়ে দরুদ ও সালাম পাঠ করতে করতে পথ পরিক্রমা করে। যদিও এই দিবসটি পালনের ধর্মতাত্ত্বিক বৈধতা নিয়ে মুসলিম সমাজের অভ্যন্তরে বিভিন্ন মত প্রচলিত আছে, তবুও ভারতের অধিকাংশ মুসলমানের কাছে এটি নবীপ্রেম প্রকাশের এক আবেগঘন মাধ্যম। এটি এমন একটি দিন যা মুসলিম পরিচয়কে ઉજાગর করে এবং সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে আরও সুদৃঢ় করে তোলে। এই উদযাপনের মধ্যে দিয়েই ভারতীয় ইসলাম তার নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং সুফিবাদের গভীর প্রভাবকে প্রতিফলিত করে, যা একে অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে স্বতন্ত্র ও বর্ণময় করে তুলেছে।

ঈদে মীলাদুন্নবী পালনের সূচনা ও ভারতে তার বিবর্তন

ঐতিহাসিকভাবে এটি সর্বজনস্বীকৃত যে, নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবদ্দশায়, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন বা তাবে-তাবেঈনদের যুগে তাঁর জন্মদিন পালনের কোনো প্রথা প্রচলিত ছিল না। ইসলামী শাসনের প্রাথমিক শতকগুলিতে মুসলিম সমাজ মূলত কুরআন ও সুন্নাহর মৌলিক শিক্ষাকে আঁকড়ে ধরেছিল এবং নতুন কোনো ধর্মীয় আচারের প্রচলন থেকে বিরত ছিল। ঐতিহাসিকদের মতে, মীলাদুন্নবী উদযাপনের প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেখা যায় মিশরে ফাতেমীয় শিয়া খিলাফতের সময় (দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী)। ফাতেমীয় শাসকরা, যারা নিজেদেরকে নবী-কন্যা ফাতিমা (রা.)-এর বংশধর বলে দাবি করত, তারা নিজেদের রাজনৈতিক বৈধতা প্রতিষ্ঠা করতে এবং জনগণের মধ্যে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে নবী (সা.)-এর পাশাপাশি হযরত আলী (রা.), ফাতিমা (রা.) এবং হাসান-হুসাইন (রা.)-এর জন্মদিনও রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় জাঁকজমকের সাথে পালন শুরু করে। পরবর্তীতে দ্বাদশ শতাব্দীতে, ইরাকের ইরবিল প্রদেশের সুন্নি শাসক মালিক মুজাফফর আল-দীন কোকবুরী প্রথমবারের মতো জাঁকজমকপূর্ণভাবে মীলাদুন্নবী পালন শুরু করেন, যা সুন্নি মুসলিম বিশ্বে এই প্রথাকে জনপ্রিয় করে তোলে। ভারতে এই সংস্কৃতি প্রবেশ করে মূলত সুফি সাধক, দরবেশ এবং মধ্য এশিয়ার আলেমদের মাধ্যমে। ভারতের উর্বর মাটিতে সুফিবাদ বা ‘তাসাউফ’-এর শিকড় অত্যন্ত গভীরে প্রোথিত, যেখানে ‘ইশক-এ-রসুল’ বা নবীপ্রেমকে ঈমানের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গণ্য করা হয়। খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (রহ.), নিজামুদ্দীন আউলিয়া (রহ.)-এর মতো মহান সুফি সাধকদের খানকাহগুলো নবীপ্রেমের চর্চাকেন্দ্রে পরিণত হয় এবং তাঁদের অনুসারীদের মাধ্যমে মীলাদের মাহফিল জনপ্রিয়তা লাভ করে। দিল্লি সালতানাত ও মুঘল যুগেও বিভিন্ন শাসক ও আমির-ওমরাহদের পৃষ্ঠপোষকতায় এই উদযাপন আরও বিস্তৃত হয়। সময়ের সাথে সাথে, এই উদযাপন ভারতীয় স্থানীয় সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদানের সাথে মিশে এক নতুন রূপ ধারণ করে। ‘জলুস’ বা শোভাযাত্রা, কাওয়ালি, না’ত পাঠের আসর, এবং সিন্নি বা তাবাররুক বিতরণের মতো প্রথাগুলো এর সাথে যুক্ত হয়ে মীলাদুন্নবীকে একটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত করেছে, যা আজও ভারতের মুসলিম সমাজে অত্যন্ত উদ্দীপনার সাথে পালিত হয়।

ধর্মতাত্ত্বিক মতভেদ ও বিতর্ক

যদিও ভারতে ঈদে মীলাদুন্নবী বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে পালিত হয়, এর ধর্মীয় বৈধতা নিয়ে মুসলিম সমাজের অভ্যন্তরে একটি গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী বিতর্ক বিদ্যমান। এই বিতর্ক মূলত ইসলামে ‘বিদআত’ বা নতুন সংযোজনের ধারণাটিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। ভারতীয় উপমহাদেশে এই বিতর্কের দুটি প্রধান ধারা স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়, যা মূলত দুটি प्रमुख ইসলামী চিন্তাধারার প্রতিনিধিত্ব করে। একদিকে রয়েছে দেওবন্দী ও আহলে হাদিস মতাদর্শের অনুসারীরা। তাঁদের মতে, ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা, যার সমস্ত ইবাদত ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান কুরআন ও হাদিস দ্বারা স্পষ্টভাবে নির্ধারিত। যেহেতু নবী (সা.) নিজে বা তাঁর সাহাবীরা কখনো জন্মদিন পালন করেননি, তাই এটিকে একটি ধর্মীয় উৎসব হিসেবে পালন করা ইসলামে একটি নতুন সংযোজন বা ‘বিদআত’। তাঁরা যুক্তি দেন যে, নবীর প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শনের সর্বোত্তম উপায় হলো তাঁর সুন্নাহ বা জীবনাদর্শকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অনুসরণ করা, কোনো বিশেষ দিনকে কেন্দ্র করে আনুষ্ঠানিকতা পালন করা নয়। অন্যদিকে, এই মতের বিপরীতে অবস্থান করেন বেরলভী চিন্তাধারার অনুসারীরা, যাঁদের সংখ্যা ভারতে সর্বাধিক। এই মতাদর্শের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম আহমদ রেজা খান বেরলভী (রহ.) এবং তাঁর অনুসারী আলেমগণ মীলাদুন্নবী পালনকে শুধু বৈধই নয়, বরং একটি অত্যন্ত প্রশংসনীয় ও পুণ্যময় কাজ (মুস্তাহাব) বলে মনে করেন। তাঁদের যুক্তি হলো, আল্লাহ তা’আলা স্বয়ং কুরআনে নবী (সা.)-এর আগমনকে মানবজাতির জন্য এক মহান অনুগ্রহ (রহমত) হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সুতরাং, এই অনুগ্রহের দিনটিতে একত্রিত হয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা, নবীর জীবন ও আদর্শ আলোচনা করা, তাঁর প্রতি দরুদ ও সালাম প্রেরণ করা এবং দরিদ্রদের আহার করানো—এগুলো সবই পুণ্যময় কাজ। তাঁরা বিদআতকে দুই ভাগে ভাগ করেন: ‘বিদআতে হাসানাহ’ (উত্তম সংযোজন) এবং ‘বিদআতে সাইয়্যিয়াহ’ (নিকৃষ্ট সংযোজন)। তাঁদের মতে, যে নতুন প্রথার সাথে ইসলামের মৌলিক আকিদা ও বিশ্বাসের কোনো সংঘাত নেই এবং যা মানুষকে ধর্মের প্রতি আরও আকৃষ্ট করে, তা ‘বিদআতে হাসানাহ’ হিসেবে গণ্য হতে পারে। এই ধর্মতাত্ত্বিক বিভাজন আজও ভারতের মসজিদ, মাদ্রাসা ও ইসলামী সংগঠনগুলোতে স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান, যা মুসলিম সমাজের অভ্যন্তরীণ চিন্তার বৈচিত্র্যকে তুলে ধরে।

আধুনিক ভারতে এর প্রাসঙ্গিকতা

ইতিহাসের নানা পরিক্রমা পেরিয়ে এবং ধর্মতাত্ত্বিক বিতর্ক সত্ত্বেও, ঈদে মীলাদুন্নবী আজ ভারতের মুসলিম সমাজের এক অবিচ্ছেদ্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতা। এর তাৎপর্য কেবল একটি ধর্মীয় আচারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, বরং এটি মুসলিম সম্প্রদায়ের ঐক্য, সংহতি এবং পরিচয়ের এক শক্তিশালী প্রতীক। আধুনিক ভারতে, যেখানে বহুত্ববাদ এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য দেশের মূল ভিত্তি, মীলাদুন্নবীর উদযাপনগুলো মুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তির এক উজ্জ্বল নিদর্শন। এই দিনকে কেন্দ্র করে আয়োজিত মাহফিল ও আলোচনা সভাগুলো নতুন প্রজন্মের কাছে নবী (সা.)-এর শাশ্বত বাণী—শান্তি, করুণা, ন্যায়বিচার ও মানবতার বার্তা—পৌঁছে দেওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। বিশেষ করে, বর্তমান সময়ে যখন বিশ্বজুড়ে ইসলাম সম্পর্কে নানা ভুল ধারণা ছড়ানো হচ্ছে, তখন মীলাদুন্নবীর মঞ্চ থেকে নবী (সা.)-এর মানবিক ও ক্ষমাশীল চরিত্রকে তুলে ধরা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। তদুপরি, এই উদযাপনের একটি বড় সামাজিক দিক রয়েছে। দিনটি উপলক্ষে দরিদ্রদের মধ্যে খাদ্য, বস্ত্র ও অর্থ বিতরণ করা হয়, যা ইসলামের সামাজিক ন্যায়বিচারের ধারণাকে শক্তিশালী করে। ‘জলুস-এ-মোহাম্মদী’ বা শোভাযাত্রাগুলো নিছকই ধর্মীয় মিছিল নয়, বরং এটি ভারতীয় মুসলিমদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং দেশের প্রতি তাদের ভালোবাসার এক প্রকাশ্য ঘোষণা। পরিশেষে, ধর্মতাত্ত্বিক বিতর্ক যাই হোক না কেন, ভারতের কোটি কোটি মুসলমানের কাছে ঈদে মীলাদুন্নবী হলো আধ্যাত্মিক নবায়ন, নবীপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ এবং সামাজিক সম্প্রীতি জোরদার করার এক মহামিলন ক্ষেত্র। এটি এমন একটি দিন যা মুসলিম উম্মাহকে তাদের প্রিয় নবীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে এক উন্নত ও ন্যায়নিষ্ঠ সমাজ গঠনের প্রেরণা জোগায়।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter