উন্নয়নের আড়ালে দিল্লিতে মুসলিম ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা প্রশাসনিক নিশানায়
দেশের রাজধানী দিল্লি। রাজধানী যেহেতু সকলের জন্য সব থেকে নিরাপদ হওয়া উচিত। কিন্তু ধারাবাহিকভাবে ধ্বংসের সম্মুখীন হচ্ছে বিভিন্ন মুসলিম ঐতিহ্যবাহী স্থান। কখনও প্রশাসন উন্নতির অজুহাত দেখাচ্ছে, কখন অধিগ্রহণের অভিযোগ তো আবার কখনও রাজনৈতিক দল সমর্থিত সাম্প্রদায়িক সংগঠনের হুমকি।
বাবরি মসজিদ ধ্বংস নিয়ে দেশীয় মুসলমানের এখনও আঘাত নিরাময় হয়নি। কিন্তু তারা একমত হয়ে সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত স্বীকার করেছে এবং সাম্প্রতিক, একই স্থানে রাম মন্দিরও উদঘাটন হয়ে গেল। এখনও আবার নতুন তর্ক-বিতর্ক গড়ে উঠছে বানারসের জ্ঞানবাপি এবং মথুরার শাহী ঈদগাহ মসজিদ কেন্দ্র করে মুসলমান ন্যায়ের প্রত্যাশী।
গত জানুয়ারি ৩০ তারিখ ভোর-আলোর পূর্বে, ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট কুতুব মিনার থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মেহেরাউলির প্রাচীন আখুঞ্জি মসজিদ বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। সূত্র অনুসারে তথাeকথিত অধিগ্রহণ বিরোধী অভিযানে দিল্লি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (ডিডিএ) আখুঞ্জি মসজিদ সহ বেহরুল উলূম মাদ্রাসা এবং পুরো প্রাঙ্গণ ও কবরস্থানের বেশ কয়েকটি কবর ভেঙে ফেলে। সুলতানা রাজিয়ার আমলে অবস্থিত ছিল মসজিদটি। ৭০০-৮০০ বছর থেকে যে মসজিদের আজানে স্থানীয় বাসিন্দারা মুখরিত হয়ে আছে হঠাৎ সেই ভোরে বুলডোজারের কর্কট শব্দে তাদের ঘুম ভাঙ্গে। স্থানীয়দের অভিযোগ প্রায় এই অভিজান পূর্বে কোন নোটিশ ছাড়াই সম্পূর্ণ করা হয়।
অন্যদিকে উন্নয়ন ও সংরক্ষণের উদ্দেশে ১৯৫৭ সালে গঠিত দিল্লি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের দাবি অনুসারে স্থাপনাটি সরকারের নথিতে সংরক্ষিত নয়। তাছাড়া, স্থাপনাটি অবৈধ এবং বনভুমির জায়গায় অবস্থিত।
গত ১৩ বছর ধরে ওয়াকফ বোর্ডের সদস্য এবং মসজিদের তত্ত্বাবধায়ক ইমাম জাকির হোসেনের কাছ থেকে দ্য কুইন্ট রিপোর্ট করেছে, "৩১ জানুয়ারী, ডিডিএ কর্তৃপক্ষ ভোর ৫:৩০-এ আসে। ফজরের (সকালের নামাজের) জন্য মাদ্রাসার বাচ্চা এবং আমি জাগ্রত ছিলাম। আমরা সবে মাত্র ওজু এবং নামাজের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম তখনই তারা এসে পৌঁছাল। হঠাৎ এত ভিড় এবং বুলডোজার দেখে আমি ভয় পেয়ে যায়।"
"শিশুরা (১০-1১৮ বছর বয়সী এবং অনেকই এতিম) তাদের চপ্পলও পরেনি। জিনিসপত্র সংগ্রহ করার জন্য আমাদের কোন সময় দেওয়া হয়নি, তাদের জামাকাপড়, রেশন, বই এমনকি মাদরাসার কুরআন, সবকিছুই ধ্বংস হয়ে গেছে।" ইমাম সাহেব বলেন।
এটা শুধু আখুঁজি মসজিদের ঘটনা নয়। কিছু আগে দিল্লির প্রাচীনতম এক মাজার অবৈধ অধিগ্রহণ বলে ধ্বংস করে দেওয়া হয় যেটি পৃথ্বীরাজ চৌহানের এক পরিবার সদস্যের ছিল এবং তুর্কি ও আফগান আক্রমণের পূর্বে থেকে অবস্থিত। বাবা ফারিদের মাজার আগামী ধ্বংসের তালিকায় দেখা যাচ্ছে।
অনুরূপ মুসলিমদের প্রাচীন স্থাপনা কেরালা থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত। ভারতের দক্ষিণে তো অনেক হিন্দু চোলা, চেরা এবং পাল্লাভা রাজারা নিজেই বহু নির্মাণ করেছে। তাই বর্তমানে, মুসলিমদের ঐতিহাসিক স্থাপনার এরকম ধ্বংস ক্রিয়া ভারতের ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের এক ঘোর অবমাননা।
৩১ জানুয়ারী পর্যন্ত, যখন এটি ভেঙে ফেলা হয়, বাবা হাজী রোজবিহার মাজারটি ফতেহ বুর্জ বা লাল কোটের বিজয় গেটের কাছে অবস্থিত ছিল। একটি লাল চাদরের নীচে পাশের কবরটি বিবি নামে তাঁর এক মহিলা শিষ্যের ছিল।
বিবিকে পৃথ্বীরাজ চৌহানের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বলা হয় যিনি হাজী রোজবিহারের অধীনে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং তার ধর্মান্তর শহরের জ্যোতিষীদের উদ্বিগ্ন করে যে এটি একটি অশুভ লক্ষণ এবং দিল্লিতে ইসলামী শাসনের আবির্ভাবের পূর্বাভাস।
এসব ছাড়াও কিছু দিন আগে ট্রাফিক অসুবিধা বলে দিল্লিতে মুঘোল আমলের সুনহেরী মসজিদ হটাবার পরামর্শ চেয়ে একটি পাবলিক নোটিস জারি করেছিল দিল্লি মিউনিসিপ্যাল কাউন্সিল (এনএমডিসি)।
কখনও ঐতিহ্যবাহী নাম পরিবর্তন তো কখনও সোজাসুজি বুলডোজার পরিক্রণের সংখ্যালঘু মুসলমান এবং সাধারণ ভারতীয়দের এক চিন্তাভাবনার ডাক দেয়। এই সকল রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ ভারতের সমৃদ্ধ ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা চলছে। এই ঐতিহাসিক বিভিন্নতার সংরক্ষণের জন্য সচেতন নাগরিকদের অগ্রাধিকার পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত যাতে ধর্ম-জাতি নির্বিশেষে দেশের বহুত্ববাদ বজায় থাকে। অন্যায়-অত্যাচার এবং মিথ্যার ভন্ডামিকে পরাজিত করে দেশবাসী সত্যের প্রত্যাশী।