এই ব্যক্তিকেন্দ্রিক পৃথিবীতে ইসলাম আমাদের জন্য উত্তরাধিকার হিসেবে কী রেখে গেছে

পরোপকারিতার (الإيثار): এক পরিচিতি

ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী, পরোপকারিতা বা ঈসার (الإيثار) একটি মহৎ গুণ, যা অন্যের কল্যাণের জন্য নিজের প্রয়োজন ও স্বার্থ ত্যাগ করার মধ্যে নিহিত। ইসলাম এই গুণটিকে শুধু একটি নৈতিক গুণ হিসেবেই নয়, বরং একটি উচ্চতর আধ্যাত্মিক স্তরের পরিচায়ক হিসেবে গণ্য করে। কুরআন এবং হাদীসে পরোপকারিতার অনেক দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়, যা মুসলমানদের এ গুণ অর্জনের প্রতি উৎসাহিত করে।

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:

"وَيُؤْثِرُونَ عَلَىٰ أَنفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ ۚ وَمَن يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُو۟لَـٰٓئِكَ هُمُ ٱلْمُفْلِحُونَ"
“আর তারা নিজেদের প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও অন্যদের নিজেদের উপর অগ্রাধিকার দেয়। আর যারা তাদের মনোমালিন্য থেকে রক্ষা পেয়েছে, তারাই তো সফল।” (সূরা আল-হাশর, ৫৯:৯)

এই আয়াতে মদীনার আনসার সাহাবীদের উদারতা ও আত্মত্যাগের প্রশংসা করা হয়েছে, যারা মুহাজির ভাইদের নিজের ঘর, খাদ্য ও সম্পদ ভাগ করে দিয়েছিলেন, যদিও নিজেরাও কষ্টে ছিলেন।

রাসূলুল্লাহ ছিলেন পরোপকারিতার সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত। তিনি তাঁর জীবনে সর্বদা অন্যের কল্যাণের জন্য আত্মত্যাগ করেছেন। তিনি বলেছেন:

"لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يُحِبَّ لِأَخِيهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ"
“তোমাদের কেউই প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্যও তা ভালোবাসবে যা সে নিজের জন্য ভালোবাসে।” (সহীহ বুখারী ১৩; সহীহ মুসলিম ৪৫)

এই হাদীস থেকে বোঝা যায় যে, প্রকৃত ঈমান সেই ব্যক্তির মধ্যেই আছে, যে নিজের মত করেই অন্যের মঙ্গল কামনা করে।

রাসূলুল্লাহ –এর জীবনে এমন বহু উদাহরণ রয়েছে, যেখানে তিনি নিজের কষ্টের তোয়াক্কা না করে উম্মতের কল্যাণে কাজ করেছেন। এমনকি কিয়ামতের দিনেও তিনি তাঁর উম্মতের জন্য শাফায়াত করবেন এবং বলবেন:

"أُمَّتِي، أُمَّتِي"
“আমার উম্মত, আমার উম্মত।”

নবী মুহাম্মদ এবং তাঁর সাহাবাগণের কিছু হৃদয়স্পর্শী পরোপকারের ঘটনা

1—মদিনায় একবার এক সন্ধ্যায় ক্ষুধার্ত মানুষদের কষ্টে রাসূলুল্লাহ -এর হৃদয় ভারাক্রান্ত। দিনের পর দিন তিনি নিজের পেটে পাথর বেঁধে কাটান, কিন্তু উম্মতের একেকজনকে দেখে চোখে জল এসে যায়। সেদিন তাঁর ঘরে ছিল মাত্র তিনটি খেজুর। ঠিক সেই সময় একজন দরিদ্র সাহাবী একটি ছোট বাচ্চা কোলে নিয়ে এলেন। শিশুটি ক্ষুধায় কাঁদছে, মা তার দুধ দিতে পারছে না, কারণ তার পেটে কিছুই নেই।

রাসূলুল্লাহ নিজের জন্য রেখে দেওয়া তিনটি খেজুর ওই মায়ের হাতে তুলে দিলেন। মা দুটি খেজুর নিজে না খেয়ে তার সন্তানদের মুখে দিলেন। শিশুরা খুশিতে খেতে লাগলো। এরপর মা মুখে নিলেন শেষ খেজুরটি। তখন একটি বাচ্চা আবার তার দিকে তাকিয়ে কাঁদতে লাগলো। আর মা… সেই খেজুরটিও ফাটিয়ে দু'ভাগ করে সন্তানকে দিয়ে দিলেন। নিজে কিছুই খেলেন না।

এই দৃশ্য দেখে রাসূলুল্লাহ -এর চোখে জল চলে আসে। তিনি বললেন:

"إِنَّ اللَّهَ قَدْ أَوْجَبَ لَهَا بِهَا الْجَنَّةَ، أَوْ أَعْتَقَهَا بِهَا مِنَ النَّارِ"

"আল্লাহ এর জন্য তাকে জান্নাতের নিশ্চয়তা দিয়েছেন, অথবা এর জন্য তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়েছেন।"

এক মা যখন এমন আত্মত্যাগ করে, তখন বুঝে নিতে হয়, এই ধর্মের প্রাণটাই হল পরোপকারিতা। রাসূলুল্লাহ নিজের ক্ষুধাকে উপেক্ষা করে অন্যের ক্ষুধার্ত শিশুর মুখে হাসি ফুটাতে চেয়েছিলেন—এটাই ছিল তাঁর চরিত্র।

2—একদা মদীনার তীব্র শীতে একজন মুহাজির সাহাবী এক রাতে রাসূল -এর কাছে আসলেন। বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমি তিন দিন ধরে কিছু খাইনি।” রাসূল তাঁর ঘর খুঁজে দেখলেন। কিছুই নেই। তিনি সাহাবাদের বললেন, “আজ রাতে কে আমার এই ভাইকে অতিথি হিসেবে গ্রহণ করবেন?”

একজন আনসার সাহাবী দাঁড়ালেন, বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমি তাকে নিয়ে যাচ্ছি।”

তিনি অতিথিকে বাড়ি নিয়ে গেলেন। ঘরে গিয়ে দেখলেন, খাবার আছে শুধু একজনের জন্য। তিনি স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করলেন। স্ত্রী বললেন, “আমরা সন্তানদের না খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিই। আলো নিভিয়ে দিই যেন মনে হয় আমরা খাচ্ছি, আর অতিথিকে দিই সেই রুটি।”

তারা ঠিক তাই করলেন। অতিথি একাই খেলেন, আর স্বামী-স্ত্রী না খেয়ে কাটালেন রাত।

পরদিন সকালে রাসূল তাঁদের বললেন, মুখে হাসি, চোখে আনন্দ—

“আল্লাহ স্বয়ং জান্নাতে হাসলেন গত রাতে তোমাদের কাজ দেখে।” (সাহিহ বুখারী ও মুসলিম)

3—মদীনার একজন ধনী সাহাবী ছিলেন হযরত আবু তালহা (রাঃ)। তাঁর সবচেয়ে প্রিয় সম্পদ ছিল একটি ফলের বাগান—َيْرُ حَاء নামে পরিচিত। এই বাগানটি ছিল অত্যন্ত সুন্দর, ঠাণ্ডা ঝর্ণাধারায় ভরপুর, যেখানে রাসূলুল্লাহ -ও মাঝে মাঝে বিশ্রাম নিতেন।

একদিন তিনি এই আয়াত শুনলেন:

"لَن تَنَالُوا ٱلْبِرَّ حَتَّىٰ تُنفِقُوا۟ مِمَّا تُحِبُّونَ"
“তোমরা কখনো পুণ্যের স্তরে পৌঁছবে না যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের প্রিয় বস্তু থেকে ব্যয় কর।” (সূরা আলে ইমরান ৩:৯২)

এই আয়াত শোনার সাথে সাথেই আবু তালহা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ -এর কাছে এলেন। বললেন:

“ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমার সবচেয়ে প্রিয় সম্পদ এই বাগান। আমি আজই এটিকে আল্লাহর রাস্তায় দান করছি।”

রাসূলুল্লাহ খুব খুশি হলেন এবং বললেন:

“বাহ! এটা হচ্ছে প্রকৃত লাভজনক সম্পদ। আমি বলি, তুমি এটিকে তোমার নিকট আত্মীয়দের মাঝে বণ্টন করে দাও।”

হযরত আবু তালহার এই দান ছিল নিখাদ পরোপকারিতার একটি উজ্জ্বল নিদর্শন—যেখানে একজন ব্যক্তি তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটিও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ত্যাগ করতে দ্বিধা করেন না।

4—মদীনার প্রাথমিক সময়ে শহরে পরিষ্কার পানির তীব্র অভাব ছিল। একটি কূপ ছিল—বিরে রূমা (بئر رُومة)—যেটি একটি ইহুদি ব্যক্তির মালিকানাধীন ছিল। সে এতে প্রচুর টাকা নিয়ে পানি বিক্রি করতো।

রাসূলুল্লাহ বললেন:

“যে ব্যক্তি ‘বিরে রূমা’ কূপ কিনে মুসলমানদের জন্য দান করবে, তার জন্য জান্নাত।”

এই ঘোষণা শুনে হযরত উসমান (রাঃ) ইহুদির সঙ্গে দর কষাকষি করলেন। ইহুদি সম্পূর্ণ কূপ বিক্রি করতে রাজি না হওয়ায় উসমান (রাঃ) প্রথমে অর্ধেক অংশ কিনে নিলেন, এবং দিন পরিবর্তন করে একদিন মুসলিমদের ফ্রি পানি নিতে দিতেন। পরে পুরো কূপটি ২০,০০০ দিরহাম দিয়ে কিনে পুরোপুরি সাদাকা করে দিলেন।

এই ঘটনা এমন এক দৃষ্টান্ত যা বোঝায়—কেউ যদি সত্যিকারভাবে আল্লাহর জন্য কিছু দান করে, তবে তা চিরস্থায়ী হয়। আজও এই কূপ সৌদি আরবে সরকারি রক্ষণাবেক্ষণে চলমান, এবং এর আয় থেকে মুসলমানদের কল্যাণে খরচ হয়।

হযরত আবু বকর, উমর ও আলী (রাঃ): “তিন খলিফার তিন অদ্বিতীয় দান”

আবু বকর (রাঃ): সবকিছু আল্লাহর জন্য

তাবুক যুদ্ধের সময় ছিল অত্যন্ত কঠিন। মুসলমানদের কাছে সৈন্য চালানোর মতো পর্যাপ্ত সম্পদ ছিল না। রাসূল চাঁদার জন্য আহ্বান জানালেন।

হযরত উমর (রাঃ) ভাবলেন, “আজ আমি আবু বকরকে অতিক্রম করব।” তিনি ঘরে যা ছিল তার অর্ধেক আনলেন। রাসূল জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি তোমার পরিবারের জন্য কী রেখে এসেছো?” তিনি বললেন, “অর্ধেক।” এরপর এলেন আবু বকর (রাঃ)। তিনি সবকিছু নিয়ে এলেন। রাসূল জিজ্ঞেস করলেন, “পরিবারের জন্য কী রেখে এসেছো?” তিনি জবাব দিলেন:

"أَبْقَيْتُ لَهُمُ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُ"
“আমি তাদের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে রেখে এসেছি।”

এই আত্মত্যাগ এমন এক মাপকাঠি হয়ে গেল, যা মানবতার ইতিহাসে বিরল।

উমর (রাঃ): নিজের জন্য নয়, উম্মতের জন্য

হযরত উমর (রাঃ) খলিফা থাকা অবস্থায় একবার নিজে গমের বস্তা কাঁধে তুলে গরিবদের বাড়িতে পৌঁছে দেন। কেউ বলল, “আমরা তুলে দেব, আপনি খলিফা!”

উমর (রাঃ) বললেন:

“তুমি কি কিয়ামতের দিন আমার বোঝা বহন করবে?”

এই জবাব কেবল দায়িত্ববোধ নয়, পরোপকারিতার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।

আলী (রাঃ): রুটি দিয়ে জান্নাতের পথে

সূরা দাহর (সূরা ইনসান)-এ একটি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, যেখানে আলী (রাঃ), ফাতিমা (রাঃ), হাসান ও হুসাইন (রাঃ) তিনদিন উপবাস করেও তিনটি দিন তিনজন দরিদ্রকে তাদের রুটি দিয়ে দেন। একদিন এতিম, একদিন বন্দী, একদিন মিসকীন।

আল্লাহ তাঁদের সম্পর্কে বলেন:

"وَيُطْعِمُونَ ٱلطَّعَامَ عَلَىٰ حُبِّهِۦ مِسْكِينٗا وَيَتِيمٗا وَأَسِيرًا"
“তারা আল্লাহর প্রেমে মিসকীন, এতিম ও বন্দীকে খাদ্য দান করে।” (সূরা দাহর ৭৬:৮)

এমন কী, নিজের সন্তানের মুখেও একটিও রুটি উঠল না—তবুও দান করলেন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।

আজকের দুনিয়া যেখানে “আমি আগে, আমি বেশি”—এই মানসিকতা ছড়িয়ে পড়েছে, সেখানে এই গল্পগুলো হৃদয়ে গভীরভাবে নাড়া দেয়। একটি ক্ষুধার্ত শিশুর জন্য খেজুর ছেড়ে দেওয়া, বা একজন অচেনা অতিথির জন্য নিজের রুটি উৎসর্গ করে রাত কাটানো—এগুলো শুধু গল্প নয়, এগুলো জীবনের দিক নির্দেশনা। যদি একজন ব্যক্তি নিজের “স্বার্থ” ছেড়ে এই আলোর পথে হাঁটে, তার আত্মা নিঃসন্দেহে প্রশান্ত হবে। রাসূলুল্লাহ এবং সাহাবারা আমাদের শিখিয়েছেন: সত্যিকার তৃপ্তি আসে যখন তুমি নিজের প্রয়োজনের চাইতেও অন্যের মুখে হাসি ফোটাও। পরোপকারিতা কেবল একজনকে সাহায্য করে না—এটা সমাজ গঠন করে, সম্পর্ককে দৃঢ় করে, হৃদয়কে প্রশান্তি দেয়। এই সাহাবীদের জীবনের দৃষ্টান্তগুলো শুধু ইতিহাস নয়, একেকটি জীবন্ত আদর্শ—যেখানে মানুষের “আমি” মরে যায়, আর “আমরা” বেঁচে ওঠে। যাদের কাছে আল্লাহর সন্তুষ্টি, ভাইয়ের সুখ, এবং মানবতার কল্যাণ—নিজের ক্ষুধা, ক্লান্তি কিংবা প্রিয় সম্পদের চেয়েও বেশি মূল্যবান ছিল।

আজকের স্বার্থকেন্দ্রিক সমাজে যদি আমরা সাহাবাদের এই আত্মত্যাগের শিক্ষা গ্রহণ করি, তাহলে পারস্পরিক ভালোবাসা, সহানুভূতি ও মানবিকতা দিয়ে একটি পরোপকারী সমাজ গঠন সম্ভব। 

ইসলামে পরোপকারিতা কেবল একটি নৈতিক গুণ নয়, বরং ঈমানেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। রাসূলুল্লাহ ও তাঁর সাহাবারা তাঁদের জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে অন্যের জন্য আত্মত্যাগের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা আমাদের জন্য চিরন্তন আদর্শ। একজন প্রকৃত মুসলমান তার নিজের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে অপরের কল্যাণে কাজ করে—এটাই ইসলামের দাবি।

আধুনিক সমাজে যেখানে ব্যক্তি কেন্দ্রিকতা ও স্বার্থপরতা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে, সেখানে ইসলামী পরোপকারিতা হতে পারে একটি কার্যকর প্রতিশোধমূলক শক্তি—যা সমাজে সহানুভূতি, একতা ও শান্তির বাতাবরণ তৈরি করে। কুরআন ও হাদীস আমাদের শিখিয়েছে, যে ব্যক্তি অন্যকে নিজের চেয়েও অগ্রাধিকার দেয়, সে-ই প্রকৃত সফল। অতএব, আমাদের উচিত শিশু বয়স থেকেই পরিবার ও শিক্ষার মাধ্যমে ঈসার মানসিকতা গড়ে তোলা—যেখানে মানুষ শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবে না, বরং তার প্রতিবেশী, সমাজ ও মানবতার জন্যও নিজেকে দায়বদ্ধ মনে করে। পরোপকারিতা শুধু একজনকে সাহায্য করে না—এটি একজনকে মানুষ করে, সমাজকে আলোকিত করে এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের পথ খুলে দেয়।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter