ইসলামের আলোকে প্রকৃতি: প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি মুমিনদের কর্তব্য
ভূমিকা:
মানুষ একাকী এই পৃথিবীতে বসবাস করে না; বরং সে পরিবেষ্টিত একটি বিস্ময়কর ও জটিল জীবজগতে। গাছপালা, নদী-নালা, পাহাড়-সমুদ্র, পশু-পাখি, আকাশ ও বাতাস—এসব প্রকৃতির অনন্য উপাদানসমূহ আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টিজগতের অংশ, যা মানবজাতির জন্য একটি একটি চিন্তার খোরাক ও শিক্ষণীয় নিদর্শন। ইসলাম ধর্ম কেবলমাত্র নামাজ, রোজা, হজ বা অন্যান্য উপাসনামূলক কর্মকাণ্ডের প্রতিই গুরুত্ব প্রদান করে না; বরং তা মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র—ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও পরিবেশগত—এ ভারসাম্য ও ন্যায়পরায়ণতা বজায় রাখার উপর জোর দেয়। পরিবেশ সংরক্ষণ, প্রকৃতির প্রতি দায়িত্বশীল আচরণ এবং সৃষ্টিজগতের সকল জীবের প্রতি সহানুভূতিশীল মনোভাব পোষণ করাকে ইসলামের মৌলিক নৈতিক দায়িত্বের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ফলে, একজন প্রকৃত মুসলিমের জন্য প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি সচেতনতা শুধুমাত্র একটি সামাজিক কর্তব্য নয়, বরং তা একটি ধর্মীয় দায়িত্বও।
ইসলাম ধর্মে প্রকৃতিকে আল্লাহ তায়ালার কুদরতের জ্বলন্ত নিদর্শন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। একটি পাখির ডানার নিখুঁত গঠন, একটি পাতার সূক্ষ্ম শিরা, নদীর স্রোতের ধারাবাহিক গতি কিংবা বৃষ্টির এক ফোঁটার মধ্যেও পরিলক্ষিত হয় স্রষ্টার অপার মহিমা ও সুনিপুণ সৃজনশক্তি। ইসলাম মানবজাতিকে এই নিদর্শনসমূহ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ও উপলব্ধি করতে উৎসাহিত করে, যেন তারা কৃতজ্ঞতাসূচক মনোভাব পোষণ করে এবং এগুলোর কোনো প্রকার ক্ষতিসাধনে বিরত থাকে। বর্তমান সময়ে যখন পরিবেশ দূষণ ও প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতা মানবজাতির অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন ইসলামি জীবনদর্শন আমাদের একটি বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গির দিকে আহ্বান জানায়—যেখানে প্রকৃতি কেবল ভোগের উপকরণ নয়, বরং স্রষ্টার পক্ষ থেকে প্রাপ্ত এক মহান ‘আমানত’। এই বিশ্বাস থেকেই পরিবেশের প্রতি দায়িত্বশীলতা এবং টেকসই ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব আরও সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।
সৃষ্টির মাঝে স্রষ্টার পরিচয় ও কুরআনের দৃষ্টিভঙ্গি:
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বহুবার প্রকৃতিকে মানবজাতির জন্য চিন্তার উপকরণ হিসেবে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন:
إن في خلق السماوات والأرض واختلاف الليل والنهار لآيات لأولي الألباب
“নিশ্চয়ই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে এবং রাত ও দিনের পরিবর্তনে বুদ্ধিমানদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।" (সূরা আলে ইমরান, ৩:১৯০)
এই আয়াত আমাদের প্রকৃতির দিকে গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করতে উৎসাহিত করে, যেখানে লুকিয়ে আছে কেবল সৌন্দর্য নয়, বরং আল্লাহর একত্ববাদের স্পষ্ট প্রমাণ। ইসলামের দৃষ্টিতে প্রকৃতি একটি শিক্ষালয়, যার প্রতিটি উপাদান মানুষকে স্রষ্টার সত্তা ও গুণাবলি চিনতে সহায়তা করে। ফলে প্রকৃতি ও পরিবেশের অবহেলা মানে আল্লাহর নিদর্শনকে অবজ্ঞা করার শামিল।
কুরআনে পাহাড়কে ‘স্তম্ভ’, নদীকে ‘জীবনের ধারক’ এবং বৃক্ষকে ‘রিজিকের উৎস’ বলা হয়েছে। সূরা আর-রহমান-এ (আয়াত ৭-৮) আল্লাহ বলেন: والسماء رفعها ووضع الميزان، ألا تطغوا في الميزان
"তিনি আকাশকে উঁচু করেছেন এবং তিনি স্থাপন করেছেন ওজন/পরিমাপ। যাতে তোমরা সীমালঙ্ঘন না করো।"
এই আয়াত প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা ও পরিবেশের সুষ্ঠু ব্যবহার সম্পর্কে স্পষ্ট নির্দেশ দেয়।
পরিবেশ সংরক্ষণ ও জলের অপচয় রোধে ইসলামের নির্দেশ
ইসলামে পরিবেশ রক্ষা শুধু সামাজিক বা নাগরিক দায়িত্ব নয়, বরং এক প্রকার ইবাদত। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) গাছ লাগানো, জমি চাষ, পশু-পাখির যত্ন ও জলের সঠিক ব্যবহারকে নেক আমলের অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
তিনি বলেন:
ما من مسلم يغرس غرسا أو يزرع زرعا فيأكل منه طير أو إنسان أو بهيمة إلا كان له به صدقة (صحيح البخاري)
"যে ব্যক্তি একটি গাছ রোপণ করে, যতক্ষণ সে মানুষ বা প্রাণী সেই গাছ থেকে উপকার পায়, ততক্ষণ পর্যন্ত তা সদকা হিসেবে বিবেচিত হবে।" (সহীহ বুখারী)
এছাড়া পানির অপচয় সম্পর্কে তাঁর শিক্ষা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এক সাহাবিকে অজুর সময় অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করতে দেখে তিনি বলেছিলেন: لا تسرف في الماء ولو كنت في نهر جار
"অজুর সময়ও অপচয় হয়। এমনকি যদি তুমি নদীর তীরে থাকো, তবুও অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করা যাবে না।" (ইবনে মাজাহ)
এই শিক্ষা আধুনিক পরিবেশবাদী আন্দোলনের চেয়েও অনেক আগে আমাদের জানিয়ে দেয়, পরিবেশের প্রতি দায়িত্ব পালন করা ইসলামি নৈতিকতার অংশ।
প্রাণীকুলের প্রতি দয়া ও জীবজগতের সম্মান:
প্রকৃতি মানে শুধু গাছপালা বা পানি নয়; এতে রয়েছে জীবজগৎও। ইসলাম পশুপাখির প্রতিও দয়ার শিক্ষা দেয়। নবীজি (সা.) বলেন:
"এক নারী একটি বিড়ালকে আটকে রেখে খাবার ও পানি না দেওয়ার কারণে জাহান্নামে গিয়েছে।" (সহীহ মুসলিম)
অন্যদিকে, একজন ব্যক্তি কুকুরকে পানি পান করানোর কারণে জান্নাতে গিয়েছে—এমন হাদিসও রয়েছে। এই দৃষ্টান্তগুলো দেখায়, একটি ক্ষুদ্র কাজও যদি প্রাণীর প্রতি দয়াপূর্ণ হয়, তাহলে তা আল্লাহর দরবারে মহান আমল হিসেবে বিবেচিত হয়।
এছাড়াও শিকার বা পশুর ওপর অপ্রয়োজনীয় কষ্ট দেওয়াও কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অর্থাৎ, জীবজগতের প্রতি সহানুভূতি ইসলামে শুধু আদর্শ নয়, বরং দায়িত্ব।
বৃক্ষরোপণ ও ভূমি রক্ষা: একটি সদকায়ে জারিয়া:
গাছ লাগানো কেবল সামাজিক দায়িত্ব নয়, বরং চিরস্থায়ী নেকি অর্জনের একটি উপায়। হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন: "যদি কিয়ামত এসে পড়ে এবং তোমার হাতে একটি গাছের চারা থাকে, তবে যদি পারো, তা রোপণ করে দাও।" (মুসনাদে আহমদ)
এই হাদীসটি অসাধারণ একটি বার্তা বহন করে—জীবনের শেষ মুহূর্তেও যদি মানুষের হাতে কিছু উপকারী কাজ থাকে, তবে তা অবহেলা করা যাবে না। গাছ রোপণ একদিকে যেমন পরিবেশ রক্ষা করে, অন্যদিকে তেমনি মানুষের মৃত্যুর পরও তার জন্য সওয়াবের দরজা খোলা রাখে। আজকের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে এই হাদীস নতুন করে ভাবতে শেখায়, যে, একজন মুসলিম হিসেবে আমাদের দায়িত্ব প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থান করা—not exploitation, but conservation.
আধুনিক পরিবেশ সংকট, ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি ও আমাদের করণীয়:
বর্তমানে পৃথিবী এক ভয়াবহ পরিবেশ সংকটের মুখোমুখি। গ্লোবাল ওয়ার্মিং, বন উজাড়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, বায়ু ও জলদূষণসহ বিভিন্ন দুর্যোগে মানবজাতি আজ আতঙ্কিত। অথচ ইসলাম বহু আগেই আমাদেরকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছে—‘অপচয় কোরো না, সীমালঙ্ঘন কোরো না, ভারসাম্য নষ্ট কোরো না।’ إن المبذرين كانوا إخوان الشياطين
"নিশ্চয়ই অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই।" (সূরা বনি ইসরাইল, ১৭:২৭)
আমাদের উচিত এই আয়াতগুলো ও হাদীসগুলোর আলোকে জীবন পরিচালনা করা। ইসলামের পরিবেশভাবনা শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং বৈশ্বিক সচেতনতার একটি শক্তিশালী সূত্র।
উপসংহার:
প্রকৃতি শুধু আমাদের ঘরের বাইরে নয়, বরং আমাদের ঈমানের অংশ। গাছের ছায়া, বাতাসের পরশ, জলের ধারা—সবই আল্লাহর রহমতের প্রকাশ। ইসলামে এই নিদর্শনগুলোর প্রতি দায়িত্ববান হওয়া মানে স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। একজন প্রকৃত মুসলমান সেই ব্যক্তি, যিনি মানুষ, প্রাণী ও প্রকৃতির প্রতিও দায়িত্বশীল। ইসলাম আমাদের শিখিয়েছে—“পৃথিবী আল্লাহর আমানত, আমরা তার খলিফা।” সুতরাং আমানতের খেয়ানত নয়, বরং তার হেফাজত করাই আমাদের কর্তব্য। আসুন, ইসলামের প্রকৃতি সংরক্ষণ ও দয়ার শিক্ষাকে অন্তরে ধারণ করে একটি পরিবেশবান্ধব, ভারসাম্যপূর্ণ ও ঈমানদার সমাজ গড়ে তুলি।