আল-আশারিয়াহ এবং আল-মাতুরিদিয়াহ মতবাদের সংক্ষিপ্ত আলোচনা
ভূমিকা:
ইসলামি আকিদার ক্ষেত্রে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের দুটি প্রধান মতবাদ ইমাম আবুল হাসান আল-আশআরী (রহ.) এবং ইমাম আবু মনসুর আল-মাতুরিদী (রহ.)-এর সঙ্গে সম্পর্কিত। এই দুই মহান ইমাম ইসলামি শিক্ষাকে বুদ্ধিবৃত্তিক ও দলিলভিত্তিক প্রমাণের মাধ্যমে সুসংহত করেন এবং বিভ্রান্ত গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে আহলে সুন্নাতের আকিদার প্রতিরক্ষা করেন। আজকের দিনে অধিকাংশ আহলে সুন্নাত মুসলমান এই দুটি মতবাদের অনুসারী।
আল-আশরিয়াহ
ইমাম আবুল হাসান আলী ইবন ইসমাইল আশআরী (রহ.) ২৬০ হিজরি (৮৭৪ খ্রিস্টাব্দ) সালে বাসরা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একটি জ্ঞানী ও ধার্মিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ইসমাইল আশআরী (রহ.) একজন মুহাদ্দিস ও ফকিহ ছিলেন এবং তার বংশ পরিচয় সাহাবি হযরত আবু মূসা আশআরী (রাঃ)-এর সাথে মিলে।
জ্ঞানার্জনের পথ ও আকিদার পরিবর্তন:
প্রথমদিকে, ইমাম আশআরী (রহ.) মুতাযিলা মতবাদের অনুসারী ছিলেন এবং এই মতবাদের বিখ্যাত আলেম আবু আলী আল-জুব্বাই-এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি মুতাযিলা মতবাদ প্রচার করেন, কিন্তু পরে যখন তিনি মুতাযিলা মতবাদের মধ্যে অনেক দুর্বলতা দেখতে পান, তখন তিনি প্রকাশ্যে এ মতবাদ থেকে সরে আসেন। একদিন তিনি বাসরার প্রধান মসজিদে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেন:
“আমি মুতাযিলা মতবাদ থেকে তওবা করছি এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকিদাকে গ্রহণ করছি।“
এরপর তিনি কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে একটি মধ্যপন্থী আকিদা উপস্থাপন করেন, যা পরে “আশআরী মতবাদ” নামে পরিচিত হয়।
আশআরী মতবাদের মূলনীতি:
১. আল্লাহর গুণাবলী: আল্লাহ তাআলার সকল গুণ বাস্তবিক, তবে তার প্রকৃতি কেমন তা জানা যায় না।
২. তকদির: মানুষ সীমিত স্বাধীনতা রাখে, তবে আল্লাহর ইচ্ছা সর্বোচ্চ ক্ষমতাশালী।
৩. ঈমান: ঈমান শুধুমাত্র অন্তরের বিশ্বাসের মাধ্যমে অর্জিত হয়, আমল তার অপরিহার্য অংশ নয়।
৪. ওহি ও বুদ্ধি: ওহিকে বুদ্ধির ওপরে স্থান দেওয়া হয়, তবে যুক্তিবাদী প্রমাণও গ্রহণযোগ্য।
৫. আল্লাহর কালাম: কুরআন আল্লাহর অমুখরিত কালাম, যা অনাদি ও অনন্ত।
বিশিষ্ট গ্রন্থসমূহ:
আল-ইবানাহ আন উসূল আদ-দিয়ানাহ
মাকালাতুল ইসলামিয়্যিন ওয়া ইখতিলাফুল মুসলিন
আল-লুমা’ ফি রাদ্দি আহলুয যাইগ ওয়াল বিদাআ
ইন্তেকাল:
ইমাম আশআরী (রহ.) ৩২৪ হিজরি (৯৩৬ খ্রিস্টাব্দ) সালে বাগদাদে ইন্তেকাল করেন।
আল-মাতুরিদিয়া
ইমাম মাতুরিদির জন্ম ও প্রাথমিক শিক্ষা:
ইমাম আবু মনসুর মুহাম্মাদ ইবন মুহাম্মাদ আল-মাতুরিদী (রহ.) ২৪৮ হিজরি (৮৬২ খ্রিস্টাব্দ) সালে মাতুরিদ, সমরকন্দ (বর্তমান উজবেকিস্তান) শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের একজন মহান আলেম ও কালামবিদ ছিলেন।
জ্ঞানচর্চা ও মতবাদের উন্নয়ন:
ইমাম মাতুরিদী (রহ.) ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর মতবাদকে বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তিতে সুসংহত করেন এবং আকিদার একটি ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেন, যা “মাতুরিদী মতবাদ” নামে পরিচিত। তার দৃষ্টিভঙ্গি ইমাম আশআরী (রহ.)-এর সাথে অনেক ক্ষেত্রে মিল ছিল, তবে কিছু ক্ষেত্রে পার্থক্যও ছিল।
মাতুরিদী মতবাদের মূলনীতি:
১. আল্লাহর গুণাবলী: আল্লাহর গুণাবলী বাস্তবিক, তবে তাদের প্রকৃতি বর্ণনা করা সম্ভব নয়।
২. তকদির: মানুষকে বেশি স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে, তবে সে আল্লাহর ক্ষমতার বাইরে যেতে পারে না।
৩. ঈমান: ঈমানের জন্য অন্তরের বিশ্বাসের পাশাপাশি মুখে স্বীকৃতি দেওয়া আবশ্যক।
৪. ওহি ও বুদ্ধি: ওহি মূল উৎস, তবে বুদ্ধিকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
৫. আল্লাহর কালাম: কুরআন আল্লাহর অনাদি কালাম, তবে এর পাঠ ও শব্দ সৃষ্ট বস্তু।
বিশিষ্ট গ্রন্থসমূহ:
কিতাব আত-তাওহীদ
আত-তাওইল ফি উসূল আদ-দিন
বাইয়ান ওহম আল-মুতাযিলা
ইন্তেকাল:
ইমাম মাতুরিদী (রহ.) ৩৩৩ হিজরি (৯৪৪ খ্রিস্টাব্দ) সালে সমরকন্দে ইন্তেকাল করেন।
আশআরী ও মাতুরিদী মতবাদের তুলনামূলক বিশ্লেষণ
উপসংহার:
ইমাম আশআরী (রহ.) ও ইমাম মাতুরিদী (রহ.)-এর মতবাদ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের দুটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা, যা মূল আকিদায় একমত তবে কিছু বিষয়ের ব্যাখ্যায় পার্থক্য রয়েছে। তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল ইসলামি আকিদার সুরক্ষা ও মুসলমানদের বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করা। আজও তাদের মতবাদ বিশ্বব্যাপী মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিস্তৃত, যা ইসলামি আকিদার বিশুদ্ধতা ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।