নারী, পরিবার ও কর্মজীবন: দায়িত্বের ভারসাম্যে মাকাসিদ আল-শরিয়াহর পথনির্দেশনা

ভূমিকা

নগরায়ন ও আধুনিকায়নের প্রক্রিয়া নারীদের ভূমিকা ও অবস্থানের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। এই প্রক্রিয়াগুলোর ফলে নারীদের ভূমিকার পরিবর্তন ঘটে এবং তারা ঘরের বাইরের কাজেও যুক্ত হতে শুরু করেন। অতীতের নারীদের তুলনায় তখন ঘরের বাইরে কাজ করার প্রয়োজন ছিল না; তাদের দায়িত্ব মূলত ঘরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কর্মজীবী নারী প্রসঙ্গটি বহু বছর ধরেই বিতর্ক ও মতবিরোধের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকেই মনে করেন, কর্মজীবী স্ত্রীদের কারণে পারিবারিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে, যার মধ্যে কিছু নির্দিষ্ট অধিকার ও দায়িত্ব অবহেলিত হয়েছে—এটি পরিবার কাঠামোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য হলো: প্রথমত, নারীরা কাজ করতে পারবেন কি না—এই বিষয়ে তাদের অধিকার ও সমতার দিকটি আলোচনার মাধ্যমে তুলে ধরা। দ্বিতীয়ত, যদি স্ত্রী কাজ করেন, তাহলে যে ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে এবং ইসলামী শরীয়তের উদ্দেশ্য (মাকাসিদ আল-শরিয়াহ) অনুযায়ী সেই সমস্যাগুলোর সমাধান কীভাবে করা যায়, তা বিশ্লেষণ করা।

ইসলামে নারীর অবস্থান

ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে নারীর কাজ করা অনুমোদনযোগ্য, প্রশংসনীয় এবং কিছু পরিস্থিতিতে বাধ্যতামূলকও হতে পারে। একই সঙ্গে, নারীরা ইচ্ছাকৃতভাবে কাজ করা বা না করাও বৈধ, যতক্ষণ তা শরীয়তের সীমার মধ্যে থাকে। তবে যদি কোনো কাজ তাদের জন্য শরীরিক, মানসিক বা ধর্মীয় দিক থেকে ক্ষতিকর হয়, তাহলে তা করা তাদের জন্য অনুমোদিত নয়।

যদি নারীর ভরণপোষণের দায়িত্ব স্বামী, পিতা, ভাই কিংবা অন্য কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি পালন করে থাকেন, তাহলে ইসলামি বিধান অনুযায়ী তার জন্য কাজ করা বাধ্যতামূলক নয়—তাদের খরচ বহনের দায়িত্ব পুরুষ অভিভাবকের ওপরই বর্তায়, তিনি ধনী হোন বা গরিব। অন্যদিকে, যদি নারীর কাজ করার উদ্দেশ্য হয় স্ত্রী বা মায়ের মৌলিক দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া, তবে সে কাজ শরীয়ত অনুযায়ী অননুমোদিত বা নিষিদ্ধ। তবে কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে নারীদের কাজ করা অনুমোদনযোগ্য, বিশেষত যখন তা ফরজে কিফায়াহ পর্যায়ভুক্ত পেশার আওতাভুক্ত হয়—যেমন চিকিৎসক, শিক্ষক, নার্স ইত্যাদি, যেখানে নারীদের অংশগ্রহণ সমাজের প্রয়োজনে অপরিহার্য।

নারীদের কাজ করার ক্ষেত্রে ইসলাম কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো—বাইরে যাওয়ার পূর্বে স্বামীর (বা অভিভাবকের) অনুমতি গ্রহণ। এছাড়া, ইসলাম এমন শারীরিক পরিশ্রমনির্ভর কাজ থেকে নারীদের বিরত রাখে, যা তাদের স্বাভাবিক প্রকৃতি, শারীরিক সামর্থ্য এবং মানসিক প্রস্তুতির সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ এবং যা তাদের বা অন্যদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে লিঙ্গ সমতার দিক

বিশ্বের কিছু দেশে এখনো নারীদের প্রতি বৈষম্য করা হয়; তাদের কাজ করতে দেওয়া হয় না কিংবা জনজীবনে অংশগ্রহণে বাধা সৃষ্টি করা হয়। তবে ইসলাম নারীদের জনজীবনের অধিকারে পুরুষদের সমান মর্যাদা দিয়েছে। অবশ্য কিছু নির্দিষ্ট দায়িত্ব শুধুমাত্র পুরুষদের ওপর আরোপিত হয়েছে—সমাজ, পরিবার এবং নারীর কল্যাণ, সেইসঙ্গে তাদের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যের আলোকে।

ইসলাম পুরুষ ও নারীর মধ্যে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সমতা প্রতিষ্ঠা করেছে: নাগরিক অধিকার, শিক্ষার অধিকার, কাজের অধিকার, দায়িত্ব ও শাস্তির ক্ষেত্রে, এবং মানবতার মৌলিক মূল্যবোধে। এসব ক্ষেত্রেই ইসলাম নারী-পুরুষের সমান মর্যাদা নিশ্চিত করেছে। তবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা পুরুষ ও নারীর স্বাভাবিক পার্থক্যের ভিত্তিতে কিছু বিষয়ে ভিন্নতা নির্ধারণ করেছেন। যেমন: নারীদের ঋতুকালে নামাজ আদায় মাফ রাখা হয়েছে—যা ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি হলেও এই শর্তে বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য পার্থক্যের মধ্যে রয়েছে: অর্থনৈতিক দায়িত্ব, উত্তরাধিকার, সাক্ষ্য ও তালাকের অধিকার।

এই ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি লিঙ্গভিত্তিক ন্যায় ও সমতার একটি টেকসই মডেল তৈরি করে, যা টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য (SDG) অর্জনের ক্ষেত্রেও সহায়ক। এর উদ্দেশ্য হলো—নারীদের পূর্ণ ও কার্যকর অংশগ্রহণ এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনের সব স্তরে নেতৃত্বের সমান সুযোগ নিশ্চিত করা। ইসলামে লিঙ্গভিত্তিক ভূমিকা পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে বিবেচিত হয়—এটি শুধুমাত্র বাহ্যিক সমতার ধারণা নয়, বরং দায়িত্ব ও অধিকারের ভারসাম্যমূলক বিন্যাস।

সমস্যা ও মাকাসিদ আল-শরিয়াহ থেকে সমাধান

কর্মজীবী নারীদের মুখোমুখি হতে হয় ব্যস্ত সময়সূচি এবং কাজ ও পরিবারের দায়িত্ব পালনে ভারসাম্যহীনতার মতো সমস্যার, যা ঘরোয়া সমস্যার মূল কারণ। স্ত্রী কাজ করলে যেসব সমস্যা দেখা যায় তার মধ্যে আছে: পারিবারিক সহিংসতা, সন্তানদের সামাজিক সমস্যা যেমন পড়াশোনায় অবহেলা, ভালোবাসার অভাব, বিদ্রোহিতা, ব্যভিচার ইত্যাদি। এর কারণ হচ্ছে সন্তানরা মায়ের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়, কারণ সন্তানের স্বাভাবিক চাহিদা হলো মায়ের স্নেহ। তদ্রূপ, স্বামীরও প্রয়োজন স্ত্রীর সহায়তা পরিবারের ব্যবস্থাপনায়। তদ্ব্যতীত, নারীদের বাইরের কাজে নিয়োজিত হওয়ার হার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তালাকের হারও বেড়েছে (লেভিতান ও বেলাউস, ১৯৮১)। তালাকের কারণ অনেক, তার মধ্যে একটি হলো কর্মজীবী স্ত্রী যদি বুঝতে পারে যে সে একজন যোগ্য উপার্জনকারী, তাহলে সে একটি অসুখী বিবাহ টিকিয়ে রাখার চেয়ে তালাককে বেছে নিতে পারে।

পরিবারে যে সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি হয় তা সমাধানে ইসলামি শরীয়তের উদ্দেশ্য ( মাকাসিদ আল-শরিয়াহ) থেকে সমাধান খোঁজা যেতে পারে। পরিবারের মধ্যে ভালো ধর্মীয় শিক্ষা, বিশেষ করে আকিদা ও ইবাদতের ক্ষেত্রে, খুবই গুরুত্বপূর্ণ যাতে পরিবারের সদস্যরা সামাজিক সমস্যা থেকে রক্ষা পায়। তাই ধর্ম রক্ষার জন্য পরিবারকে অশোভন কর্মকাণ্ড থেকে দূরে রাখা আবশ্যক( স্যাফিনি এট আল., ২০২০)। দ্বিতীয়ত, বংশধারা রক্ষার জন্য, পিতামাতাকে নিশ্চিত করতে হবে যাতে তাদের সন্তানরা এমন কোনো কাজ না করে যা বংশধারাকে ধ্বংস করে, যেমন: ব্যভিচার। তাই ভালোবাসা ও যত্ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে (ওমেন অ্যান্ড দ্য সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস, এসডিজি, এন.ডি.)। তৃতীয়ত, আমরা জানি স্ত্রী যদি কাজ করে তার উদ্দেশ্য সম্পদ রক্ষা করা, তবে তা অবশ্যই পূর্বে বর্ণিত শর্তসাপেক্ষে হতে হবে যাতে পরিবার অবহেলিত না হয় এবং তালাক রোধ করা যায়। সুতরাং, মাকাসিদ আল-শরিয়াহ-এর আলোকে এটি অবশ্যই একটি উত্তম সমাধান। যদি সম্পদ রক্ষা এবং ধর্ম রক্ষার মধ্যে দ্বন্দ্ব হয়, তাহলে ধর্ম রক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত ( হুসনি এট আল., ২০১৫)। কারণ ধর্ম রক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয় কারণ এটি চিরস্থায়ী সুখের পথ খুলে দেয়, যা আত্মা, বুদ্ধি বা সম্পদ রক্ষার মাধ্যমে অর্জিত হতে পারে।

উপসংহার

নারীদের কাজ করাই সামাজিক সমস্যাবৃদ্ধির মূল কারণ নয়। বাস্তবতা হলো, সমাজে এমন বহু কর্মজীবী নারী আছেন, যারা সফলভাবে ঘর ও বাইরের দায়িত্ব সামলিয়ে একটি সুস্থ ও সুখী পরিবার গড়ে তুলেছেন। কর্মজীবন এবং পারিবারিক জীবনের মধ্যে সঠিক ভারসাম্য স্থাপন সম্ভব—যদি নারী ও পুরুষ উভয়ের মধ্যে সহযোগিতা, দায়িত্ববোধ এবং পারস্পরিক সম্মান বজায় থাকে। তাই কর্মজীবী নারীদের দায়ী করে পারিবারিক সমস্যাকে ব্যাখ্যা করা একপাক্ষিক ও অগ্রহণযোগ্য বিশ্লেষণ।

ইসলাম নারীদের কাজ করার স্বাধীনতা প্রদান করেছে, তবে সেটি ধর্মীয় সীমারেখার মধ্যে থাকতে হবে। ইসলামী শরীয়ত এমন কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করে, যেখানে তারা সমাজে অবদান রাখতে পারেন—বিশেষত এমন পেশায়, যা ফরজে কিফায়াহ যেমন: চিকিৎসা, শিক্ষা, সমাজসেবা ইত্যাদি। ইসলাম নারীর স্বভাব, মর্যাদা ও নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দিয়ে কাজের নীতিমালা নির্ধারণ করেছে, যা নারীদের জন্য সম্মানজনক ও ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করে। তবে স্বাধীনতার পাশাপাশি ইসলামে নারীদের কিছু দায়িত্বও নির্ধারিত হয়েছে, বিশেষত পরিবারের প্রতি। একজন নারী যদি কর্মজীবন বেছে নেন, তবে তাঁকে উচিত নিজের পারিবারিক দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং সে অনুযায়ী জীবনযাপন করা। এর জন্য প্রয়োজন—নিজেদের অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞান এবং ধর্মীয় মূল্যবোধভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি।

সুতরাং, নারীদের কাজ করাকে সামাজিক সমস্যার মূল কারণ হিসেবে দেখার পরিবর্তে, আমাদের উচিত পরিবারে দায়িত্ববন্টন, ধর্মীয় শিক্ষা, পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং সহমর্মিতার অভাবকে চিহ্নিত করা। ইসলাম ভারসাম্যমূলক জীবন গঠনের যে দিকনির্দেশনা দেয়, তা অনুসরণ করলেই নারী-পুরুষ উভয়ে সমাজ ও পরিবারে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবেন।



Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter