আমাদের জীবনের সকল ক্ষেত্রে নিয়তের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

মানবজীবন এক বিস্তৃত যাত্রা—যেখানে প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত নানা কাজ ও চিন্তায় ভরপুর। আমরা প্রতিনিয়ত কিছুনা কিছু করছি: কেউ ইবাদত করছে, কেউ উপার্জনের জন্য পরিশ্রম করছে, আবার কেউ পরিবারের দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত। কিন্তু আমরা অনেকেই একটি গভীর ও মৌলিক প্রশ্ন ভুলে যাই—আমি এই কাজটি কেন করছি? এই প্রশ্নের উত্তরই হলো আমাদের "নিয়ত"। “নিয়ত” শব্দটি আরবি ভাষা থেকে এসেছে। এর লগাবী অর্থ হলো—ইচ্ছা, সংকল্প, বা অন্তরের অভিপ্রায়। তবে ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায়, নিয়ত হলো—আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সওয়াবের উদ্দেশ্যে অন্তর থেকে কাজ করার প্রতিজ্ঞা। নিয়ত এমন একটি বিষয়, যা বাইরে থেকে চোখে দেখা যায় না, কিন্তু আল্লাহর দৃষ্টিতে সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

রাসূলুল্লাহ এক অমূল্য হাদীসে বলেন:

"নিয়তের উপরই সমস্ত কাজ নির্ভর করে। এবং প্রত্যেক মানুষ তার সেই নিয়ত অনুযায়ী প্রতিফল পাবে।"
— (সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম) এই হাদীসটি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে বহু ইসলামি পণ্ডিত এটিকে গোটা ইসলামের ভিত্তি বলে অভিহিত করেছেন। কারণ একজন ব্যক্তি বাহ্যিকভাবে অনেক বড় কাজ করলেও, যদি তার অন্তরের উদ্দেশ্য সৎ না হয়—তা আল্লাহর দরবারে কোনো মূল্য পাবে না।

 নিয়ত: একটি অদৃশ্য কিন্তু নির্ণায়ক সত্য

একটি কাজ বাইরের দিক থেকে খুব ভালো দেখালেও তার ভিতরে কি আছে, তা কেবল আল্লাহ জানেন। উদাহরণ স্বরূপ, দুই ব্যক্তি একইভাবে রোজা রাখল, নামাজ পড়ল, হজ করল—কিন্তু একজনের নিয়ত শুধুই আল্লাহর সন্তুষ্টি, অন্যজনের নিয়ত ছিল লোক দেখানো। বাহ্যিক দৃষ্টিতে দুজনই ধার্মিক, কিন্তু আখিরাতে কেবল সেই ব্যক্তি পুরস্কৃত হবে যার নিয়ত খাঁটি ছিল।

নিয়তের বিকৃতি: আমলের মৃত্যু

কেউ যদি কোরআন শিক্ষা দেয়, বক্তৃতা করে, দান করে—কিন্তু তার অন্তরের উদ্দেশ্য হয় খ্যাতি অর্জন, মানুষের প্রশংসা, সম্মান পাওয়া—তাহলে সেই সব কাজ আল্লাহর কাছে বরবাদ হয়ে যায়।

রাসূল আরও বলেন:

"প্রথম যে তিনজনকে কিয়ামতের দিন জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে, তাদের একজন হবে সেই ব্যক্তি যে ইলম অর্জন ও শিক্ষা দিয়েছিল শুধুমাত্র লোকের মধ্যে সম্মান পাওয়ার জন্য।"
— (সহীহ মুসলিম) এই হাদিস আমাদের অন্তর কাঁপিয়ে দেয়। একজন মানুষ সারা জীবন ইবাদতে ব্যয় করতে পারে, কিন্তু যদি উদ্দেশ্য সৎ না হয়, তাহলে সে দুনিয়া ও আখিরাত—দুই জগতেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

নিয়ত বিশুদ্ধ করার বাস্তব উপায়

নিয়ত শুধরে নেওয়া কঠিন নয়, বরং প্রতিনিয়ত চর্চার বিষয়। এখানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় তুলে ধরা হলো—

  1. প্রত্যেক কাজের আগে নিজেকে প্রশ্ন করুন:
    আমি এই কাজটি কার জন্য করছি? শুধুই আল্লাহর জন্য, না মানুষের প্রশংসার জন্য?
  2. গোপন ইবাদতের অভ্যাস গড়ে তুলুন:
    কিছু এমন নেক কাজ রাখুন, যা আপনি কাউকে না জানিয়ে শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য করেন। যেমন: গোপনে দান করা, চুপচাপ তাহায়ুদ পড়া, কাউকে সাহায্য করা ইত্যাদি।
  3. শয়তানের ওয়াসওয়াসা থেকে সতর্ক থাকুন:
    শুরুতে নিয়ত খাঁটি হলেও শয়তান আমাদের মনে অহংকার, খ্যাতির বাসনা ঢুকিয়ে দিতে পারে। তাই আমল চলাকালীনও নিয়ত বারবার পরীক্ষা করা দরকার।
  4. প্রতিদিন নিয়তের জন্য দোয়া করা:
    নিয়তকে বিশুদ্ধ রাখতে রাসূল যে দোয়া শিখিয়েছেন, তা পড়া খুব উপকারী:

"আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকাল ইখলাস ফি নিইয়াতি ওয়া আমালি।"
অর্থ: হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে চাই, আমার নিয়ত ও আমলে একনিষ্ঠতা।

নিয়তের শক্তি: ছোট কাজ, বড় পুরস্কার

নিয়তের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো—ছোট ছোট সাধারণ কাজকেও সে ইবাদতে পরিণত করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ:

  • আপনি পরিবারের দায়িত্ব পালন করছেন—যদি নিয়ত থাকে "আল্লাহর হুকুম পালন", তবে সেটিও ইবাদত।
  • একজন মা তার সন্তানের খিদমত করছে, রান্না করছে, পরিষ্কার করছে—যদি মনে থাকে আল্লাহর সন্তুষ্টি, তাহলে প্রতিটি কাজের জন্য সে সওয়াব পাবে।
  • আপনি ঘুমাচ্ছেন, খাচ্ছেন, হাঁটছেন—সবই হতে পারে ইবাদত, যদি নীতিটা হয় সঠিক।

অন্যদিকে, নিয়ত খারাপ হলে নামাজ, রোজা, হজ—সবই নিরর্থক হয়ে যেতে পারে।

 শেষ কথা: 

নিয়ত একটি সূক্ষ্ম অথচ সর্বাধিক প্রভাবশালী বিষয়। এটি এমন এক বীজ, যেটি সঠিকভাবে রোপণ হলে তার ফল হবে জান্নাত, আর যদি সেই বীজ পচে যায়, তবে তার পরিণতি হবে জাহান্নাম। আমরা অনেক সময় কাজের বাহ্যিকতা নিয়ে গর্ব করি, কিন্তু আসল প্রশ্ন হলো—আল্লাহর জন্য করেছি তো? সুতরাং, আমাদের প্রতিদিনের জীবনে, প্রতিটি কাজ শুরু করার আগে এই প্রার্থনা করা উচিত—

"হে আল্লাহ! আমার অন্তরকে খাঁটি করুন। আমার সমস্ত কাজ আপনার সন্তুষ্টির জন্য হোক, যেন আমার কোনো আমল বরবাদ না হয়।" আল্লাহ আমাদের সকলকে একনিষ্ঠ, খাঁটি, রিয়া ও অহংকারমুক্ত নিয়তের তাওফিক দান করুন-আমিন।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter