বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসি: ইসলামের ইতিহাসের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র

ভূমিকা:- 

দুর্গতি, দূর্দশা পথভ্রষ্টতার সময়ে মুসলিম উম্মতকে কুরআন সুন্নাতের সঠিক পথ দেখিয়েছেন-এমন উলামাদের সংখ্যা ইসলামের ইতিহাসে বহুসংখ্যক উনবিংশ শতাব্দীর মুসলিম উম্মাহর চরম দুর্দিনে, তুরস্কের কঠিন অবস্থার সন্ধিক্ষণে একজন অমিত মনোবল মহাপুরুষের জন্ম অনিবার্য হয়ে উঠেছিলতখনই তুরস্ক দেশে জন্মগ্রহণ করেন বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসি, যিনি ছিলেন একজন বিজ্ঞ আলিম এবং দেশের জন্য একজন লড়াকু সৈনিক,

জন্ম:- 

সমগ্র মুসলিম উম্মাহর আশা - আকাঙ্ক্ষার প্রতীক প্রতীক, ওসমানী খিলাফতের ক্ষিয়মান দশায় ১৮৭৭ সালে (১২৯৩ হিজরি) ফজরের আজানের সময় পূর্ব তুরস্কের বিতলিস প্রদেশের নুরস নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন সাঈদ নূরসি তিনার পিতা, মির্জা সাহেব, ছিলেন একজন অত্যন্ত আল্লাহ ভীরু দ্বীনদার ব্যক্তি তিনি এতটাই পরিছন্ন জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন যে, জীবনে কখনো কোনো অবৈধ জিনিস আস্বাদন করেননি এবং স্বীয় সন্তান -সন্ততিকে অবৈধ কিছু পানাহার করাননি

তিনার সংক্ষিপ্ত জীবন:- 

বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসি ছিলেন মুসলিম উম্মাহার ক্রান্তিলগ্নে আবির্ভূত হওয়া সেই সকল মানুষদের একজন, যারা জাহেলিয়াতের ঘন অন্ধকারে মশাল হাতে আলোর মিছিল শুরু করেছিলেন তার হাতে সূচিত সেই আলোর মিছিলই আজ পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছেতুরস্কতে ওসমানীয় খলিফা সুলতান আব্দুল হামিদ উপলব্ধি করেন যে, ব্রিটেন ফ্রান্স তার সঙ্গে খোলামেলাভাবে যুদ্ধের পরিবর্তে ধর্মহীনতার বীজ বপন করছে এবং ইউরোপ ওসমানীয়দের ওপর নিজস্ব কিছু চিন্তা-ধারা রোপণ করতে চায় এবং তারা দাবি করে যে ইউরোপীয় সভ্যতাই একমাত্র সভ্যতা অতঃপর, তৎকালীন খিলাফতের শিক্ষিত শ্রেণীর লোকেরাই অন্ধের মত মিথ্যা ধারণাকে বেশি বেশি গ্রহণ করতে থাকে ১৮৭৬ সালে সুলতান আব্দুল হামিদদের ক্ষমতা রোহনের পর থেকেই তথাকথিত প্রগতিশীল মহল ইউরোপীয় সংস্কৃতি আমদানির আপ্রাণ চেষ্টা শুরু করে, যেটাকে তারা এক আন্দোলনে রূপান্তরিত করে নাম দিলো -New Ottomanism (নব-উসমানিয়বাদ) এবং সুলতান হামিদ নিজেও নব-উসমানীয়দের একজন ছিলেন বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসি সবসময় মুক্ত সাংবিধানিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সমর্থক ছিলেন কিন্তু নব-উসমানীয়দের মধ্যে থেকেই যখন নব-তুর্ক (Young Turks) নামের সর্বনাশ আন্দোলন শত বছরের উসমানীয় সাম্রাজ্যের কন্ঠরোধ করতে আরম্ভ করে, তখনই নুরসি প্রতিবাদ  করতে মুখর হয়ে ওঠেন

উক্ত সময়েই তুর্কির মাটিতে অন্ধকার যুগের সূচনা হয় আধুনিকতা,সভ্যতা সাংস্কৃতির নামে ইসলামের সাথে প্রকাশ্যে শত্রুতা চরম বিরোধিতা শুরু হয় উন্নতি অগ্রগতির দোহাই দিয়ে তুর্কিদের মেরুমজ্জায় ঢোকানো হয়েছিল  সাংঘাতিক বিষ শুরু হয়েছিল আল্লাহর দিন শরিয়াকে নিভিয়ে ফেলার ঘৃণ্য প্রচেষ্টা আর এসবের উদ্দেশ্য ছিল একটি; তা হল:- ইসলামের সঙ্গে তুর্কি  জাতির সম্পর্ক চিরতরে মূল উৎপাটন এবং তুর্কীদের হৃদয়ের ঈমানের নূরকে চিরতরে নিভিয়ে ফেলে নাস্তিকতার আধারে নিমজ্জিত করা

এইভাবেই ইউরোপীয় ষড়যন্ত্রকারীরা এবং তাদের তুরস্ক সমর্থকরা শুরু করে একের পর এক ইসলাম পালনে নিষেধাঙ্গা- যাতে মুসলিম সমাজ তাদের হৃদয় আত্মার তৃষ্ণা নিবারণ করতে না পারে তারা একদিকে বিদ্যালয় সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় শিক্ষা নিষিদ্ধ করে তোলে, অন্যদিকে নাস্তিক্যবাদী শিক্ষা প্রণয়ন করে ঐতিহাসিক মসজিদ,মাদ্রাসাকে ঘোড়ার আস্তাবলে পরিণত করে এর বাস্তব উদাহরণ ঐতিহাসিক হাগিয়া সোফিয়া মসজিদ, যেটিকে জাদুঘরে পরিণত করা হয়েছিল ইনস্টানবুল বিজয়ের শৌর্য- ঐশ্বর্যের প্রতীক এই মসজিদকে দীর্ঘ ৮৬ বছর পর ২০২০ সালে আবারো মসজিদে রূপান্তর করা হয় ১৯৮৫ সালে লম্বা জুব্বা পরিধান নিষিদ্ধ করা হয়, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলিতে আরবি বর্ণমালা কে প্রত্যাখ্যান করে ল্যাটিন বর্ণমালার প্রবর্তন করা হয় এছাড়া ১৯২৮ সালে এক অধ্যাদেশ বলে সকল প্রকার ধর্মীয় গ্রন্থ রচনা মুদ্রণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় তখনই জ্বলে উঠেন বদিউজ্জামান, এবং স্বৈরাচারী শাসকের সামনে উচ্চকণ্ঠে মহাসত্যের দাওয়াত তুলে ধরতে বাধ্য হন

পরিণতি:

অতঃপর তাঁর বিরুদ্ধে শুরু হয় কারা নির্যাতন নির্বাসন এই কারাগার থেকে সেই কারাগার এখান থেকে সেখানেকিন্তু ইতিহাস সাক্ষী আছে যে বিপ্লবীরা নির্ভয়ে তাদের বিপ্লব চালিয়ে গিয়েছেন, কারো হুমকিতে দম্ভিত হননি যেখানে যে পরিস্থিতিতে ছিলেন,সেখানে নিরালায় বিপ্লবের বীজ বুনন করেছিলেন বদিউজ্জামান তার ব্যতিক্রম ছিলেন না তাকে যেখানেই শৃঙ্খলিত করে রাখা হয়েছিল, সেখানেই ফুটিয়েছিলেন প্রশান্তির ফুল কারাবাস নির্বাসনের ২৭  বছরে রচনা করেছিলেন বিখ্যাত অমর গ্রন্থ "রিসালায়ে নুর" বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসির সত্যের যে চারা গাছ রোপণ করে গিয়েছিলেন তা আজ ফুলে- ফলে সুশোভিত লাখে লাখে পথভ্রষ্ট মানুষ সেই ফুলের ঘ্রাণে ব্যাকুল হয়ে ফিরে এসেছে আল-কুরআনের ছায়ায়

রিসালায়ে নূরের প্রেক্ষাপট পরিচিতি:- 

"রিসালায়ে নুর" আরবি শব্দ, যার অর্থ হলো আলো বা হেদায়েতের নিবন্ধসমূহ বা আলোর পঙক্তিমালা বা পথনির্দেশক আলো প্রায় ৬০০০ অধিক পৃষ্ঠাসংবলিত ১৪ খন্ডের একটি রচনা সংকলনের নাম- "রিসালয়ের নূর" এবং এটি লেখা হয়েছে আরবি এবং উসমানীয় তুর্কি ভাষায় এতে ১৩০ এর অধিক প্রবন্ধ (রিসালা) রয়েছে পর্যন্ত বিশ্বের প্রায় ৫২ টি ভাষায় অনুদিত হয়েছে রিসালায়ে নূর

লিখন পদ্ধতি:-

 রিসালায়ে নূরের প্রবন্ধ সমূহ মূলত ১৯১০ থেকে শুরু করে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে রচিত রিসালায়ে নূরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছেএটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ গ্রন্থ যা লেখকের নিজ হাতে সরাসরি রচিত নয়; এটি পুরোটাই শ্রুতিলিখন তিনি বলতেন এবং তার ছাত্ররা তার শুনে শুনে লিখতেন পরে লিখিত কপি সাঈদ নুরসি নিজ হাতে সম্পাদনা করতেনবলা বাহুল্য যে, রিসালায়ে নূর -এর কপির সংখ্যা প্রায় ইদানিং লক্ষ অতিক্রম করেছে এবং ১৯৫৭ সালে এর প্রিন্টেড কপি বাজারে আসে রিসালায়ে নূর তাফসির হলেও প্রচলিত সাধারণ তাফসীর গ্রন্থগুলির মতো শব্দ থেকে শব্দ ধরে কিংবা আয়াত থেকে আয়াত ধরে তাফসীর করা হয়নি, এটি একটি বিষয় ভিত্তিক তাফসীর

উপসংহার:- 

ইসলামের ইতিহাসে সাঈদ বদিউজ্জামান নুরসি ছিলেন এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব তিনি (১৮৭৭-১৯৬০) কুরআন ইসলামের নিমিত্তে যে অনন্য অবদান দিয়ে গেছেন তা ইতিহাসের এক সোনালী অধ্যায় হয়ে থাকবে বদিউজ্জামান এমন একসময় জন্ম নিয়েছিলেন যখন তুরস্কে মুসলিম খিলাফত পতনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল এবং ধর্মবিরোধী পাশ্চাত্য সভ্যতার আগ্রাসন মুসলিম বিশ্বকে গ্রাস করছিলো তিনি দুই দুইটি বিশ্বযুদ্ধ প্রত্যক্ষভাবে দেখেছেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রণাঈনে লড়াই করেছেন নিজ দেশের স্বকীয়তার  জন্য সংগ্রাম করেছেন কোট মার্শাল, জেল-জুলুম, নির্যাতন কারাবরণ সব ধরনের হয়রানি নির্যাতন পরম ধৈর্যের সাথে মোকাবিলা করেছেন সব পরিস্থিতিতে ইতিবাচক বিকল্প উদ্ভাবন এবং নতুন কর্মকৌশল গ্রহণ করে আন্দোলন চালিয়ে যাবার যে দিকনির্দেশনা তিনি দিয়ে গিয়েছেন তা তাঁর জীবনের একটি অন্যতম বড় অবদান তার দ্বিতীয় অবদান হচ্ছে রিসালায় নূর বদিউজ্জামান যে আলো দেখাতে পেরেছিলেন সেই আলো যেন ক্রমান্বয়ে আরো সুস্পষ্ট হচ্ছে এবং সেই আলোয় একদিন গোটা পৃথিবীটাকে আবার আলোময় করে তুলবে ইনশাআল্লাহ  

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter