ওমর আল-ফারুক : একজন বিশ্বনেতা । (প্রথম অংশ)
ইতিহাস শুধু মাত্র আকর্ষণীয়ই নয়, সত্যিকারের অনুপ্রেরণাদায়কও। প্রতিটি যুগ পরবর্তীকালের জন্য নমুনা হয়ে এসেছে এবং এইভাবে রাজ্য এবং মানবজাতির ইতিহাস গৃহবাসী থেকে চন্দ্র দর্শনার্থী পর্যন্ত বিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু এই বিশাল চক্রের মধ্যে ইতিহাস শুধুমাত্র কিছু ব্যক্তির সঙ্গেই সীমিত রয়েছে যাদের জীবন আজও প্রদীপের মতন জ্বলজ্বল করে। এই মহান ব্যক্তিরা এক সুন্দর সভ্যতার পথপ্রদর্শক হিসেবে কাম করেছিলেন। কিছু ব্যক্তি ছিলেন রাজা,পন্ডিত, দার্শনিক, শাসক এবং সেনাপতি যিনারা জীবনের আসল উদ্দেশ্যটি শীঘ্রই বুঝতে পারেন এবং সমাজকে সৌখিন ও গৌরব করে তোলার অপ্রাণ চেষ্টা করেন। সমস্ত মহাপুরুষ, সমাজ সংস্কারক, চিন্তাবিদ রাষ্ট্রনায়ক এবং দেশ প্রেমিক শুধুমাত্র একটি ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষদের থেকে আলাদা আর সেটি হলো তারা স্বপ্ন দেখার সাহস করেছিলেন এবং সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তর করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন।তিনারা জীবনের অর্থ এবং উদ্দেশ্য উভয়ই বুঝতে পারেন এবং এটি অর্জনের জন্য এককভাবে নিজেকে নিবেদিত করে।
সপ্তম শতাব্দীতে রোমানের এক দুত এক দলবদ্ধ হয়ে মদিনার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। সেইখানে পৌঁছে দুত এক পথচারীকে জিজ্ঞেসা করলো। আমাকে বলুন খলীফার প্রাসাদ কোথায়? এই প্রশ্ন শুনে সেই পথচারী বিস্মৃত হয়ে বলেন, প্রাসাদ বলতে আপনি কি বোঝেন? সে জবাবে বলে আমি খালিফা ওমরের প্রাসাদ কোথায় তায়ই দেখতে চাই। তখন পথচারী এক মুচকি হেসে জবাব দিল উহু আপনি খালিফা ওমরকে দেখতে চান, চলুন। দুতকে মসজিদে নববীতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে গিয়ে দেখে যে সেই সময়কার সর্বশ্রেষ্ঠ খলিফা শাসক, যিনার সৈন্যবাহিনী তিনটি পরিচিত মহাদেশে ছড়িয়ে আছে মসজিদে নববীর খালি মেঝেতে শুয়ে আছেন। এই দৃশ্য দেখে দুত হতবাক হয়ে গেল যা পরবর্তীতে এই ঘটনায়ই রোমান সম্রাটকেও মুগ্ধ করেছিল।
ওমার, সম্পূর্ণ নাম হলো ওমার ইবন আল-খাত্তাব।যিনি মক্কায় 586 খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন, এবং ৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে মদিনায় পরলোক গমন করে। তিনি ছিলেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম এর শ্বশুর। তিনাকে দুই কারণের জন্য ইসলামের “সেন্টপল” বলে আখ্যায়িত করা হয়। প্রথমত ইসলাম প্রচারে সাফল্যের কারণ এবং দ্বিতীয়ত ইসলামের বিরোধিতা করার জন্য, কিন্তু অবশেষ পথ পরিবর্তন করে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু সাল্লাম কে সমর্থন করেছিলেন। তারই অধীনে আরব সৈন্যরা বিশ্বের অনেক অংশ জয় করে পরবর্তীতে এক বিখ্যাত আরব গড়ে তোলে। তিনি প্রথম হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু কে প্রথম খালিফা স্থাপনের তত্ত্বাবধান করে এবং তারই সঙ্গে পারস্য এবং বাইজানটাইন উভয়ই সাম্রাজ্যের উপর বিজয়ের পরিকল্পনা করেছিলেন। সরলতা দারিদ্র এবং ন্যায় বিচার, হযরত ওমরের এই তিন গুণাবলী আরবের ইতিহাস দ্রুতই পরিবর্তন করে।
প্রথম হিজরতের সময় ওমর রাঃ মুহাম্মদ সাঃ এর গুরুত্বপূর্ণ সহচর ছিলেন।ওমর রাঃ ছিলেন ইসলামের সমগ্র ভৌগলিক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্থাপনকারী। প্রথমত তিনি মোহাম্মদ সঃ এর বিরোধিতা করে কিন্তু ৬১৫ খ্রিস্টাব্দে ইসলাম ধর্মকে গ্রহণ করে। ৬২২ খ্রিস্টাব্দে তিনি মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে মদিনায় যান এবং সেখানে হযরত আবু বকর রাঃ ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়। ৬২৫ খ্রিস্টাব্দে মেয়ে হাফসার সঙ্গে মুহাম্মদ সাল্লাম এর বিয়ে সুসম্পন্ন হয়।৬৩২ খ্রিস্টাব্দে মোহাম্মদ সাঃ এর মৃত্যুর পর, হযরত আবু বকর রাঃ প্রথম খালিফা হিসাবে নিয়োজিত করার জন্য দায়িত্ব নেন। আবু বকর (৬৩২-৬৩৪), হযরত ওমরের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করেছিলেন এবং তিনাকেই তার উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করে। খালিফা হিসেবে প্রথম নিজেকে “আমিরুল মোমেনীন” হিসেবে অভিহিত করে। তিনার শাসনকালে ইসলামিক রাষ্ট্রকে আরবীয় রাজত্ব থেকে বিশ্বশক্তিতে রুপান্তরিত করে।
ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু মক্কার কুরাইশ গোত্রের উমাইয়া বংশের একজন সদস্য ছিলেন এবং এই ভাবেই তিনি উমাইয়া প্রতিষ্ঠা করেন। মোহাম্মদের সাঃ মৃত্যুর পর ওমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু নিশ্চিত করেছিলেন যেন সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর কাছে যায়।এই প্রচেষ্টা মক্কা এবং মদিনা বাসীদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধতা নিয়ে আসে।
ইসলামের সম্প্রসারণ
উল্লেখযোগ্য সম্প্রসারণের পিছনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু সাধারণ নীতি নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন যা পরবর্তী মুসলিম সাম্রাজ্যের জন্য সহজ করে। ওমর প্রথম দিওয়ান (যোদ্ধাদের পেনশন দেওয়ার রেজিস্টার) প্রতিষ্ঠা করে যা আস্তে আস্তে শক্তিশালী সরকারের সংস্থায় বিকাসিত হয়ে ওঠে। তিনিই প্রথম হিজরী ক্যালেন্ডারের বিকাশ ঘটায়, বিচারক অফিস এ ছাড়াও মিশরের আল ফুসতাত এবং ইরাকের বাসরা ও কুফাহের গ্যারিসন শহর গুলি প্রতিষ্ঠা করে। মোহাম্মদ সাঃ এর ওহীর ষষ্ঠ বছর পর তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তারপর ১৮ বছর তিনার সঙ্গে অতিবাহিত করে। তিনি ২৩শে আগস্ট ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে খলিফা আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর উত্তরাধিকারী হিসেবে খালিফা পদে নিয়োজিত করা হয়। তিনার শাসনকালে ইসলামিক রাষ্ট্র আরব রাজত্ব থেকে বিশ্বশক্তিতে পরিবর্তন হয়। পশ্চিমে সাসানিদ-পারস্য সাম্রাজ্যের সমগ্র অঞ্চল এবং পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি নিয়ন্ত্রণ করেন।
সাহসী কৌশলবিদ
ওমারের রাঃ আইন প্রণয়ন এবং প্রশাসনিক ক্ষমতা দ্রুতই ছড়াতে লাগে এবং মাত্র দুই বছরের মধ্যে বিশাল পারস্য সাসানিদ সাম্রাজ্যকে কব্জা করে তাই তিনি একজন বিচক্ষণ রাজনৈতিক ও কৌশলবিদের খ্যাতি লাভ করেন। এই উল্লেখযোগ্য সম্প্রসনের সময় ওমর রাঃ সাধারণ নীতি প্রণয়ন করতেন। পরবর্তীকালের ইসলামিক নীতি হচ্ছে তার দূরদর্শিতা এবং প্রজ্ঞার ফল ।একজন শক্তিশালী শাসক, অপরাধীদের জন্য কঠোর ন্যায়বিচারক ও সমস্ত কর্তৃত্বের জন্য সর্বজনীনভাবে সম্মানিত ছিলেন। সাহসিকতা, উদারতা, ব্যবহারিক প্রজ্ঞা ও কঠোরতার জন্য আরব বাশি তিনাকে ‘মুরুয়া’ নামে আখ্যায়িত করতেন। ওমার রাঃ একজন বিশুদ্ধতার সমর্থক ছিলেন যিনি অশ্লীলতা, জুয়া খেলা, অনুপযুক্ত পোশাক এবং রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির অপব্যবহার করা থেকে দূরে থাকতেন।
৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে এক পারস্য খৃষ্টান ক্রীতদাস আবু লুহ হযরত ওমার রাঃ কে এক যুদ্ধে আক্রমণ করে, সঠিক তিন দিন পর তার মৃত্যু ঘটে। বিদায়ের সময় ছয় সদস্যের কাউন্সেলিং আয়োজিত করেছিলেন যারা পরবর্তীতে ওসমান বিন আফ্ফনকে উত্তরাধিকারী হিসেবে নির্বাচিত করে। রোমান সম্রাট তার মৃত্যুর কথা শুনে বলে “পৃথিবী এক অমূল্য মতি হারিয়েছেন, সত্যিকারের অবাক লাগে যার পদতলে দুনিয়ার সমস্ত ভোগবিলাস ত্যাগ করে আল্লাহর জন্য সাধারণ জীবন কাটিয়েছিলেন“।
অনেকেই ওমরকে রাঃ ইতিহাসের অন্যতম সেরা রাজনৈতিক প্রতিভাশীল এবং ইসলামিক সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বলে মনে করা হয় যিনার নেতৃত্বে সাম্রাজ্য এক অবিশ্বাস্য গতিতে সম্প্রশীলত হয়, অনেক ইসলামিক রাজনৈতিক নীতি ও কানুন প্রণয়ন করে। একজন আইনবিদ হিসেবে তিনি ইসলামিক আইনকে সংহিতাবদ্ধ করতে শুরু করে এবং হিজরতের প্রথম বছর পরে ইসলামিক ক্যালেন্ডারের গননা করার আদেশ দেন।
ওমরের কাজগুলি আরো উল্লেখযোগ্য কারণ জন্মগতভাবে সম্পদের অভাব অনুভব করেছিলেন যা অন্যান্য সাহাবাদের মধ্যে ছিল না। তিনি কুরাইশদের এক দরিদ্র বানি-আদ গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং রাখাল ছিল, যে প্রায়ই তার ভেড়া হারাত। কিন্ত কে ভাবতে পারে যে এরকম নর্ম ব্যক্তি পরবর্তীকালে রোম সাম্রাজ্যের ওপর শাসন করবেন! সুলাইমান আলাই সালাম এর বুদ্ধি এবং ইউসুফ আলাইহিস সাল্লাম এর বিচক্ষণতা দুটিই তার মধ্যে ছিল।
ওমর রাঃ জ্ঞান ও ঈমানের কারণে নবী সাঃ তিনার। প্রশংসা করেছিলেন। একদা নবী সাঃ সায়িত অবস্থায় দেখতে পেলেন যে লোকদেরকে তিনার সামনে পেশ করা হচ্ছে, সবার পোশাকের দিকে দেখে তো বুক কাউরের হাটু পর্যন্ত, কিন্তু ওমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর পোশাক দেখেন পুরোপুরি মাটি পর্যন্ত শুয়ে আছে। তখন সাহাবাগণ জিজ্ঞাসা করলেন, যে এটার কি ব্যাখ্যা দিবেন? তখন নবী সাল্লাল্লাহু সালাম উত্তর বলেন ঈমান। (আল বুখারী)
যখন তিনার শিক্ষার সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করা হল। নবী সাঃ জবাব দেন, যে আমি সায়িত অবস্থায় ছিলাম তখন আমাকে পান করতে দিল অতঃপর আমার নখ থেকে ঝরনা বর্ষিত লাগলো। সেই ঝর্ণা থেকে আমি ওমরকেও কিছু দিলাম। এটার কি ব্যাখ্যা দেন জিজ্ঞাসা করলেন? বলেন জ্ঞান। নবী সাঃ আরো বলেন, আমার পর যদি কেউ নবী হতো তো সেটা হচ্ছে ওমার রাঃ।
ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু ১০ জান্নাতের সুখবর প্রাপ্তকারীর মধ্যে একজন ছিলেন।তিনি আল্লাহর উপাসনায়, উম্মতের ভক্তিতে সারা জীবন অতিবাহিত করেন। নবী সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম উম্মতকে উপদেশ দিতেন, এক ব্যক্তি প্রকৃত মুমিন হতে পারে না যতক্ষণ না পর্যন্ত সে তার ভাইয়ের জন্য তা পছন্দ করবে যা নিজের জন্য পছন্দ করে। ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু একদা সালমানকে জিজ্ঞাসা করেন যে আমি এক রাজা না খালিফা? তিনি উত্তরে বলেন যদি আপনি মুসলিমদের জমিন বা দীরহাম অবৈধভাবে ব্যবহার করেন তাহলে আপনি রাজা। এটা শুনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহূ কাঁদতে শুরু করেন। ওমরের রাঃ মাত্র একটি জামা ও একটি সাল ছিল।
ওমরের অর্জন সত্যিকারেই চিত্তকার্ষক। মোহাম্মদ সাঃ এর পরেই তিনি ছিলেন আরব বিস্তৃতের প্রধানতা। সরলতা, দরিদ্রতা এবং ন্যায়বিচার এই তিনটি গুণ মুসলিমকে এক আরব মরুভূমি থেকে রোম ও পারস্য সাম্রাজ্যের প্রাসাদে নিয়ে এসেছিলেন। অবশ্যই, তার শাসনকালে বিজিত অঞ্চলগুলির মধ্যে অধিকাংশই আরব ছিল। নবী সাঃ ছিলেন প্রধান প্রবর্তক, কিন্তু ওমরের অবদান অতুলনীয়। নবী সাঃ যে জিনিসটি শুরু করে গিয়েছিলেন সেই মোমেন্টাম তিনি কখনো হাত ছাড়া করেনি।