শান্তি ও ঐক্যের দূত: শায়খ আহমদ আল-তায়িব
ভূমিকা
ইসলামি বিশ্বে এমন কিছু ব্যক্তিত্ব আছেন, যাঁদের জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও নেতৃত্ব একযোগে সমকালীন সমস্যার সমাধান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। শায়খ আহমদ আল-তায়িব তাঁদের মধ্যেই একজন। তিনি বর্তমান সময়ে আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যান্ড ইমাম, যিনি শুধু একজন ধর্মীয় নেতা নন, বরং একজন শিক্ষাবিদ, চিন্তাবিদ ও মানবতার দূত হিসেবেও পরিচিত। তাঁর বক্তব্য, গবেষণা এবং নীতি-নির্ধারণী কার্যক্রম প্রমাণ করে যে, ইসলামি ঐতিহ্য ও আধুনিক চ্যালেঞ্জের মধ্যে সেতুবন্ধন গড়ে তোলার অসামান্য ক্ষমতা তাঁর রয়েছে। শায়খ আহমদ আল-তায়িবের জীবন কেবল ব্যক্তিগত সাফল্যের গল্প নয়; এটি ইসলামি ঐতিহ্য রক্ষা, জ্ঞান প্রচার এবং উম্মাহর ঐক্য সংহত করার এক ধারাবাহিক সংগ্রামের কাহিনি। তাঁর জীবনী আমাদের শেখায়—নেতৃত্ব মানে কেবল কর্তৃত্ব নয়, বরং সেবামূলক দায়িত্ব।
শৈশব ও শিক্ষা জীবনের ভিত্তি
শায়খ আহমদ আল-তায়িব ১৯৪৬ সালের ৬ জানুয়ারি মিশরের লুক্সর প্রদেশের এক ধর্মনিষ্ঠ ও সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবার ছিল সুফি ঐতিহ্যের ধারক এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ইসলামি শিক্ষা ও আধ্যাত্মিকতার চর্চা সেখানে চলে আসছিল। শৈশব থেকেই তিনি কোরআন মুখস্থ করার পাশাপাশি ইসলামি ফিকহ, হাদিস ও তাফসির অধ্যয়নে আগ্রহী ছিলেন। তাঁর পারিবারিক পরিবেশ তাঁকে ইসলামের আধ্যাত্মিক এবং জ্ঞানভিত্তিক উভয় দিকের প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে।
উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন, যা বিশ্বের প্রাচীনতম এবং অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সেখানে তিনি আকিদা ও দর্শন শাস্ত্রে বিশেষভাবে মনোনিবেশ করেন এবং ১৯৬৯ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর ১৯৭১ সালে স্নাতকোত্তর এবং ১৯৭৭ সালে ইসলামি দর্শনের উপর পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল কোরআনের দর্শনের গভীর বিশ্লেষণ, যা তাঁর চিন্তার গভীরতা ও পাণ্ডিত্যের পরিচায়ক। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি তিনি ফরাসি ভাষা শেখেন এবং ১৯৭৭ সালে ছয় মাসের জন্য প্যারিসের সর্বোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন, যা তাঁকে পাশ্চাত্য দর্শন ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে সাহায্য করে।
একাডেমিক ও প্রশাসনিক অবদান
শিক্ষাজীবন শেষ করার পর শায়খ আহমদ আল-তায়িব আল-আজহারে শিক্ষকতা শুরু করেন। তিনি কাতার, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং পাকিস্তানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন, যা তাঁর আন্তর্জাতিক একাডেমিক পরিচিতি বাড়িয়ে তোলে। ১৯৯৯-২০০০ সালে তিনি পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের উসুল আল-দিন অনুষদের ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
তাঁর যোগ্যতা ও নেতৃত্বগুণের কারণে তিনি আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০২ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত তিনি মিশরের গ্র্যান্ড মুফতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, যা দেশের সর্বোচ্চ ধর্মীয় পদগুলির মধ্যে অন্যতম। এই সময়ে তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় বিষয়ে ফতোয়া প্রদান করেন যা মিশরের সমাজে গভীর প্রভাব ফেলে।
২০০৩ সালে তিনি আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ পান এবং ২০১০ সাল পর্যন্ত এই পদে থাকেন। এই সময়ে তিনি পাঠ্যক্রমে আধুনিক বিষয় সংযোজন, আন্তর্জাতিক একাডেমিক সংযোগ বৃদ্ধি এবং ছাত্র-শিক্ষক বিনিময় কর্মসূচি চালুর মাধ্যমে আল-আজহারের শিক্ষাব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনেন। তিনি ইংরেজি ভাষায় ইসলামি শিক্ষা প্রদানের জন্য একটি বিশেষ বিভাগ খোলেন, যা বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য আল-আজহারে পড়াশোনা সহজ করে তোলে।
ধর্মীয় নেতৃত্ব ও দাওয়াহ কার্যক্রম
২০১০ সালে মিশরের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হোসনি মোবারক শায়খ আহমদ আল-তায়িবকে আল-আজহারের ৪৮তম গ্র্যান্ড ইমাম হিসেবে নিয়োগ দেন। এই পদে থেকে তিনি শুধু মিশর নয়, বরং গোটা মুসলিম উম্মাহর জন্য ধর্মীয় নির্দেশনা ও নৈতিক দিকনির্দেশনা প্রদান করছেন।
তিনি বারবার বলেছেন যে, ইসলাম শান্তি, সহনশীলতা ও মানবতার ধর্ম। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তিনি মুসলিম ও অমুসলিম নেতাদের সঙ্গে সংলাপ করেছেন, যাতে ধর্মীয় বৈরিতা হ্রাস পায় এবং আন্তঃধর্মীয় বোঝাপড়া বৃদ্ধি পায়। তাঁর নেতৃত্বে আল-আজহার শান্তি, ঐক্য ও পরস্পর শ্রদ্ধার বার্তা বিশ্বজুড়ে প্রচার করছে। তিনি মুসলিম বিশ্বের যুবকদের চরমপন্থা থেকে দূরে থাকতে এবং ইসলামের সঠিক ও মধ্যপন্থী ব্যাখ্যা গ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন।
আন্তঃধর্মীয় সংলাপ ও বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা
শায়খ আহমদ আল-তায়িবের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো আন্তঃধর্মীয় সংলাপের প্রসার। তিনি বিশ্বাস করেন যে, বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক স্থাপন করা বিশ্ব শান্তির জন্য অপরিহার্য। এই লক্ষ্যে তিনি বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।
তাঁর সবচেয়ে ঐতিহাসিক পদক্ষেপ ছিল ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে আবুধাবিতে পোপ ফ্রান্সিসের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং "মানব ভ্রাতৃত্বের দলিল" (Document on Human Fraternity) নামক একটি ঐতিহাসিক ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করা। এই দলিলটি বিশ্ব শান্তি এবং বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার একটি শক্তিশালী আহ্বান। এতে ধর্মীয় চরমপন্থা, সন্ত্রাসবাদ এবং সব ধরনের সহিংসতার নিন্দা করা হয়েছে এবং শিক্ষা, ন্যায়বিচার ও করুণার মাধ্যমে একটি শান্তিপূর্ণ বিশ্ব গড়ার কথা বলা হয়েছে। এই দলিলটি আধুনিক ইতিহাসে আন্তঃধর্মীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়।
তিনি মুসলিম কাউন্সিল অফ এল্ডার্স-এর চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন, যা মুসলিম বিশ্বের মধ্যে শান্তি ও ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে।
চরমপন্থা ও সহিংসতার বিরুদ্ধে অবস্থান
শায়খ আহমদ আল-তায়িব চরমপন্থা ও ধর্মের নামে সহিংসতার তীব্র বিরোধিতা করেছেন। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ইসলাম কোনোভাবেই সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করে না; বরং এটি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। তিনি আল-কায়েদা, আইএসআইএস-এর মতো সন্ত্রাসী সংগঠনের মতাদর্শকে ইসলামের বিকৃতি বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং তাদের কর্মকাণ্ডের কঠোর নিন্দা করেছেন। তিনি মুসলিম যুবকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন যেন তারা এই ধরনের সংগঠনের দ্বারা প্রভাবিত না হয় এবং ইসলামের শান্তিপূর্ণ ও মানবিক শিক্ষা গ্রহণ করে।
আধুনিক শিক্ষা ও ঐতিহ্যের সমন্বয়
তিনি বিশ্বাস করেন, মুসলিম উম্মাহর উন্নতির জন্য আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জ্ঞানের পাশাপাশি ইসলামি ঐতিহ্য ও নৈতিক মূল্যবোধ সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর প্রচেষ্টায় আল-আজহারে বিজ্ঞান, চিকিৎসা, প্রকৌশলসহ আধুনিক বিষয়ে গবেষণা আরও সম্প্রসারিত হয়েছে। তিনি মনে করেন, জ্ঞান-বিজ্ঞানে পিছিয়ে পড়া মুসলিমদের অগ্রগতির পথে প্রধান বাধা। তাই তিনি আল-আজহারের পাঠ্যসূচিতে এমনভাবে পরিবর্তন এনেছেন যাতে শিক্ষার্থীরা ধর্মীয় জ্ঞানের পাশাপাশি আধুনিক বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করতে পারে।
শায়খ আহমদ আল-তায়িব নারীদের শিক্ষা ও সমাজে সক্রিয় অংশগ্রহণকে সমর্থন করেন। তাঁর মতে, ইসলামে নারীর মর্যাদা ও অধিকার অত্যন্ত উচ্চ, এবং নারীশিক্ষা জাতির অগ্রগতির অন্যতম শর্ত। তিনি প্রায়শই বলেন যে, নারীদের অধিকার হরণ করা এবং তাদের শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা ইসলামি শিক্ষার পরিপন্থী। তিনি নারীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন, যা একটি সুস্থ ও উন্নত সমাজ গঠনে অপরিহার্য।
উপসংহার
শায়খ আহমদ আল-তায়িবের জীবন ও কর্ম আমাদের শেখায়—একজন প্রকৃত নেতা জ্ঞানের আলোয় আলোকিত, ন্যায়পরায়ণতায় দৃঢ় এবং মানবতার সেবায় নিবেদিতপ্রাণ। তিনি ইসলামের সত্য ও সুন্দর চিত্র তুলে ধরতে নিরলসভাবে কাজ করছেন। বর্তমান বিশ্বে যখন ধর্মীয় বিভাজন ও ভুল ব্যাখ্যার কারণে অশান্তি সৃষ্টি হচ্ছে, তখন তাঁর নেতৃত্ব মুসলিম উম্মাহর জন্য এক অনন্য প্রেরণা। তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে ঐতিহ্যকে অক্ষুণ্ণ রেখেও আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা যায়। তাঁর উত্তরাধিকার কেবল আল-আজহার বা মিশরে সীমাবদ্ধ নয়; বরং সমগ্র বিশ্ব মুসলিম সমাজে তাঁর অবদান দীর্ঘকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আলোর দিশা হিসেবে কাজ করবে।