ঈশ্বরের প্রতি উৎসর্গ করার বিশেষণে হাসান আল বাসরি
“ওই জাতি কী ভাবে পথভ্রষ্ট হতে পারে যার মধ্যে হাসান আল বাসরির মত কেও নিজেকে ঈশ্বরের প্রতি উৎসর্গ করে দেয়।”
উম্মু সালমা ও শিশু হাসানের সম্পর্ক
এক বার্তাবাহক নাবীজির স্ত্রী উম্মু সালমা কে পরিতৃপ্ত করেন যে তাঁর কৃতদাস খাইরা একটি মিষ্টি শিশু জন্ম দিয়েছে। এই মঙ্গলজনক বার্তাটি যেন উম্মু সালমার হৃদয়কে মুগ্ধ করে দেয় এবং তার মুখমন্ডলের উপর দিয়ে খুশির সাগর প্রবাহিত হয়ে যায়। তিনি এক বার্তাবাহককে পাঠিয়ে দেন সেই জন্মদাতা মা এবং তার ছেলেকে নিজ বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য। তখন খাইরা উম্মুল মু’মিনিনের কাছে অনেক প্রেমাস্পদ ছিলেন, এই জন্য সালমা তার ছেলেকে দেখার জন্য অনেক উতলা হয়ে উঠছিলেন। এগুলো তো কিছুই নয়, এমনকি খাইরা যখন তার ছেলেকে দুই হাতে উঠাইয়া তার সামনে উপস্থিত হয়, তখন যেন তার চোখের তারা দুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠে এবং তার জন্য তার আবেগ এবং ভালোবাসা ক্রমশ বেড়ে উঠে।
আল হাসানের নামকরণ
সেই ছেলেটি এক মনোহর রূপের অধিকারী ছিল এবং তার মুখের অভিব্যক্তি যেন সূর্যের কিরণের সঙ্গে খেলা করছে, তাকে দেখে এমন মনে হচ্ছিলো যে আল্লাহ তাকে সম্পূর্ণরূপে সৃষ্টি করেছেন এবং তার এক ঝলক সবার চোখের খুশির কারণ হয়ে উঠেছে। তারপর উম্মুল মু’মিনীন তার কৃতদাস খাইরার দিকে ঘুরে বলল: তুমি কি তোমার ছেলের নামকরণ করেছ খাইরা?
তখন সে বলল: না এটি আমি তোমার জন্য ত্যাগ করে দিয়েছি, যা পছন্দ হয় তাই নাম দাও। তখন সে বলল: আল্লাহর রহমতের প্রতি আমি তার নাম দিলাম “আল হাসান”। তারপর উম্মুল মুমিনীন তার হাত উত্তোলন করে আল্লাহর কাছে আল হাসানের জন্য পরিতৃপ্ত ভাবে দোয়া করলেন।
কিন্তু এই খুশী শুধুমাত্র উম্মুল মুমিনিনের দরবারে ছিল না, এটি মাদিনাবাসি এক সাহাবী যায়েদ বিন সাবিতের দরবারে পৌঁছেছিল, যিনি ছিলেন নবীজির ওহী লেখক কারণ হাসানের পিতা “ইয়াসার” তার কৃতদাস ছিল, এবং সেখানে ছিল তার জন্য মানুষের প্রেম ভালোবাসা ও সম্মান।
আল হাসান নামে পরিচিত ব্যক্তি নবীর পদস্থলে বেড়ে উঠে এবং তিনি হাসান আল বাসরি নামে বিখ্যাত হয়ে যান। আরো তিনি নবীজির স্ত্রী হিন্দ বিনত সোহেল এর কাফালাতে বেড়ে ওঠেন যিনি উম্মুল মুমিনীন নামে পরিচিত ছিলেন।
উম্মে সালমা ছিলেন এক অধীশক্তিসম্পন্ন আরব শহরের এক অধিপতি, মানবতার সন্ন্যাসী, নবীজির স্ত্রী, এবং ধৈর্যশীল নারী যার শপথ ইসলামের বাণীতে রচিত আছে। বর্ণনা আছে যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীদের জ্ঞান শক্তি বৃদ্ধির কারণ হলো তাদের হাদিসের বর্ণনা। এমনকি যে যুগে নারীরা লিপিবদ্ধ ক্ষেত্রে অনেক কম ক্ষমতা রাখতো, সেই সময় তারা নবীজির কাছ থেকে উম্মুল মুমিনীন উম্মে সালমা ৩৭৮ টি হাদিস বর্ণনা করেন।
একদা হাসানের মা যখন উম্মুল মু’মিনীনের গৃহকর্মের জন্য বাড়ি থেকে বাইরে যায়, তখন তিনি ক্রন্দন শুরু করেন আর তার প্রবল শব্দের কারণে উম্মুল মু’মিনীন তাকে নিজের স্তনে লাগিয়ে দুধ পান করাতে শুরু করেন।
এই হিসাবে উম্মুল মু’মিনিন হাসানের দুই দিকের মা হয়ে যান: একটি উম্মুল মু’মিনীন হিসাবে, আর একটি দুধ-মা হিসেবে।
হাসানের শিক্ষার পথে অগ্রসর হওয়া
আল হাসান এর দিনগুলি সৌরভযুক্ত বাতাবরণের সঙ্গে কাটে। এমনকি তিনি উচ্চপদস্থ সাহাবীদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ লাভ করেন যেমন, ওসমান বিন আফফান, আলী ইবনী আবু তালিব, আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস, আনাস বিন মালিক এবং জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ, ইত্যাদি। এর মধ্যে তিনি সবার বেশি আমিরুল মু’মিনীনদের কাছ থেকে জ্ঞান অনুধাবন করেছেন। এই সময় তার অন্তরে জেগে ওঠে ধর্মের কঠোরতা, ঈশ্বরের প্রতি আকর্ষণ ও দুনিয়ার প্রতি ঘৃণা এবং তিনার চরিত্র ত্রুটিহীন, নির্ভুল এবং আল্লাহর ইবাদতের প্রতি সেজে ওঠে।
যখন হাসানের ১৪ বছর পূর্ণ হয় তখন সে তার পিতা ও মাতার সঙ্গে বাসরায় আগমন হয়। বাসরা হল মসজিদের পুঞ্জ এবং জ্ঞানের নগরী, তাই আল হাসান একটি মসজিদ কে নির্দিষ্ট করে আব্দুল্লাহ বিন আব্বাসের দিকে অগ্রসর হন এবং তিনার কাছ থেকে তাফসীর, হাদিস এবং ইত্যাদি বিষয়ের প্রশিক্ষণ লাভ করেন যেমন, ফিকাহ, ভাষা এবং সাহিত্যের জ্ঞান। এমনকি তিনি একটি মহান ইসলামী শাস্রতবিদ আলিম হয়ে উঠেন। তিনি যখন উম্মতের সম্মুখে বক্তৃতা দিতে শুরু করে তখন বলবান ব্যক্তির হৃদয়ও নরম হয়ে যেত এবং পাপ যুক্ত ব্যক্তির চোখ দিয়ে অশ্রুর সাগর বয়ে যেত। এইরকম ভাবে হাসান সমস্ত মানুষের হৃদয় কে জিতে নেয়, এতদ্বারা রাজারাও তার সন্ধান নিয়ে তার পথকে অনুসরণ করতে থাকে।
খালিদ বিন সাফওয়ান বর্ণনা করেন:
মুসলিম বিন আব্দুল মালিক আমার সাথে ‘হীরা’ শহরে সাক্ষাৎ করল এবং বলল: খালিদ তুমি আমাকে আল হাসান আল বসরির সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিতে পারবে? আমি বললাম: আমি তাকে হাড়ে হাড়ে চিনি কারণ উনার বার্তাবহনের কাজ আমি করেছি এবং আমি তিনার আত্মীয় এবং সঙ্গী। মুসলিম বলল: তুমি তার সমন্ধে যা যেন সমস্তকিছু বলো আমায়। আমি বললাম: উনি এমন ব্যক্তি যার আন্তরিক ও শারীরিক ভাবনা সমান এবং তার কথা কাজের সাম্য, যদি তিনি কাওকে কোনোকিছু আদেশ করতেন তিনি আগে নিজে পালনকারী হতেন এবং যদি মানা করতেন মান্যকারী আগে নিজে হতেন। আমি দেখেছি তিনার কোন মানুষের দরকার নেই কিন্তু মানুষের তিনাকে দারকার। মুসলিম বলল: এটা যথেষ্ট খালিদ।
হাসানের ইরাক যাত্রা এবং বক্তৃতা
যখন ইরাক সাম্রাজ্যে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের রাজ্ শুরু হল চারিদিকে অন্ধকার নেমে এলো এবং অত্যাচারের ভয়াবহ দৃশ্য ভেসে উঠলো। তখন হাসান ছিলেন এমন এক ব্যক্তি যে হাজ্জাজের নিপীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছিলেন এবং তার সত্যতা সবার সামনে তুলে ধরেছিলেন।
এর জন্য হাজ্জাজ নিজে একটি “অসিত” নামক শহর তৈরি করে। শহরে আগ্রাসনের সময় হাজ্জাজ প্রজাদের এক ডাক দিয়ে তার দিকে নিয়ে আসার চেষ্টা চালায়, তখন আল হাসান এগিয়ে আসে এবং বক্তৃতা শুরু করে: নিশ্চয়ই আমরা দৃষ্টিপাত করছি সেই দুষ্কর চরিত্রের প্রতি, আমরা ফেরাউন কে পেয়েছি তারপর আল্লাহ তাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। যদি হাজ্জাজ জানতো যে আকাশবাসী নিশ্চয় তাকে অবজ্ঞা করছে এবং গগনবাসী তার প্রতি প্রতারণা করছে। এতটা শোনামাত্র এক শ্রবণকারী বলল; এটা যথেষ্ট সাঈদের আব্বু। তখন আল হাসান বলল: নিশ্চয় আল্লাহ জ্ঞান অর্জনকারীর উপর চুক্তিকে সংশ্লিষ্ট করেছেন প্রকাশ করার জন্য লুকিয়ে রাখার জন্য নয়।
পরের দিন হাজ্জাজ এক জামায়াতে নিজের করতলে ক্রোধকে স্থান দিয়ে বক্তৃতা শুরু করে: ভিতুর দল! আমি খোদার কসম খাচ্ছি তোমাদেরকে আমি তার রক্তপান করাবো। তারপর হাজ্জাজ অস্ত্র নিয়ে আসার আদেশ দিয়ে, এক জল্লাদকে আহবান করে। তারপর কিছু সৈন্য দিয়ে হাসানকে তার কাছে নিয়ে আসে । এগুলো কিছুই না, যখন হাসান এলো তখন সবার দৃষ্টির ভঙ্গিমা তার দৃষ্টির তারাই প্রকাশ হচ্ছিল এবং সবার হৃদয় যেন তার হৃদয়ের ফুসফুস শব্দের সাথে বিড়বিড় করে কিছু বলছিল। যখন হাসান অস্ত্র দেখলো তখন তার ওষ্ঠ দুটি কেঁপে উঠল এবং সে হাজ্জাজের দিকে অগ্রসর হল। হাজ্জাজ তাকে হুমকি দিয়ে ধর্ম ও জ্ঞানের অনুসারে প্রশ্ন করতে শুরু করল, আর একদিকে হাসান যখন তার সমস্ত জবাবদিহি শেষ করলো তখন হাজ্জাজ তাকে আলিমদের সরদার বলে ঘোষণা করলো।
যখন হাসান ফিরে যাচ্ছিল তখন হাজ্জাজের কিছু যাসুস তার পিছু করে এবং তাকে বলে হাজ্জাজ তোমাকে তার দরবারে উপস্থিত হওয়ার আদেশ দিয়েছে। হাসান তার কথা অনুযায়ী তার দরবারে আসে। সেই সমই হাজ্জাজ আবারও তাকে প্রশ্ন করে যে তুমি যখন আমার কাছে অস্ত্র দেখেছিলে তখন তোমার ওষ্ট দুটি কেঁপে উঠেছিল, তার সমন্ধে তুমি কি বলতে চাও? তখন হাসান উত্তরে বলেন: হে আমার কৃপা প্রদানকারী ঈশ্বর তুমি তার ভয় ও অত্যাচারকে আমার প্রতি হিম ও নিরুত্তাপ করে দাও, যেমন তুমি ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর প্রতি করেছিলে।
হাসানের সত্যতা ও ইসলামের প্রতি আকর্ষণ
এই সময়টির অধিকাংশ হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহু রাজা এবং রাজ্যপালদের সঙ্গে ব্যায় করেছিলেন। এরপর খালিফা ওমর বিন আব্দুল আজিজ আল্লাহর ডাকে সারা দেন তারফলে ইয়াজিদ বিন আব্দুল মালিক কে খালিফা হয়ে নির্বাচিত করা হয় এবং ইরাকে উমর বিন হুরুবাইরা কে অলি বানানো হয়। ইয়াজিদ বিন আব্দুল মালিক ইরাকে উমর বিন হুরুবাইরা কে চিঠির পর চিঠি প্রেরণ করতে থাকলো এবং আদেশ দিল সেই চিঠি অনুযায়ী কাজ করতে, যা ছিল সত্যতার বিরুদ্ধে। তখন সে এবং আমীর বিন শুরাহবিল, আল হাসানের দিকে যায় আর বলে: খালিফা আমাকে চিঠির মাধ্যমে ন্যায়ের বিরুদ্ধে রাজত্ব পরিচালনা করতে হুকুম দিচ্ছেন। এই সুনে আমীর বিন শুরাহবিল বলে, কিন্তু হাসান চুপ করে থাকে এতদা ওমর বলে: এই বিষয়ে আপনার কি মত? তখন হাসান উত্তর দিল: তুমি ইয়াজিদের মধ্যে আল্লাহকে ভয় কর এবং আল্লাহর প্রতি ইয়াজিদকে না। তুমি জেনে রেখো নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাকে ইয়াজীদের কাছ থেকে দূর করেছে, ইয়াজিদ তোমাকে আল্লাহর নিকট হইতে দূর করেনি। তুমি যদি ইয়াজিদের দিকে হয়ে যাও আল্লাহ তোমাকে ওর দিকেই ছেড়ে দিবে। তুমি আর আরো জেনে রেখো, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের প্রতি নৈরাশ হবেন যে তার প্রতি ঈমান হারাবে।
হাসান আল-বাসরি ৮০ বছর দুনিয়ার মধ্যে জ্ঞান অর্জন করেন। একদা ব্যাক্তি তাকে দুনিয়ার অবস্থা জানতে অবস্থা জানত চাইলো, তখন তিনি উত্তরে বললেন: নিশ্চয় দুনিয়া পূর্ব-পশ্চিমের মত, একদিকে বেশি অগ্রসর হলে অন্যদিক দূর হয়ে যাবে।
110 সালে রজব মাসের বৃহস্পতিবার ভোরের রাতে তিনি আল্লাহর ডাকে লাব্বাইক করেন তখন বাসরা এবং সমস্ত আরবি ও আজামি শহরগুলি তাকে হারানোর দুঃখে কেঁপে ওঠে। তারপর তিনাকে গোসল দেওয়া হয় এবং কাফন পরিধান করিয়ে জুমার পরে তাঁর জানাজা নামাজ আদা করা হয়।