ইসলামী শিক্ষা এবং বর্তমান মুসলিম যুগের একটি সমালোচনা মূলক পর্যালোচনা

আশা ও আকাঙ্ক্ষার ওপর ভিত্তি করে জীবন যাপন করাকে প্রজ্ঞা বলা যায় না, কারণ এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড শৃঙ্খলা ও প্রজ্ঞার নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। ইসলাম, যা মানব প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি জীবনব্যবস্থা, আমাদের কেবলমাত্র আল্লাহর ওপর নির্ভর করতে নয়, বরং পরিকল্পনা করা, প্রস্তুতি গ্রহণ করা, বোঝা এবং সচেতন থাকার নির্দেশ দেয়। এই ধর্ম আমাদের চিন্তাভাবনার সাথে বাস্তবিক পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশনা দেয়। ইসলাম আমাদের শেখায় যে, আমরা পরিস্থিতির ঝড়ের মুখোমুখি খালি হাতে হই না; বরং যুক্তি, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, সংকল্প ও সাহসের অস্ত্র নিয়ে তা মোকাবিলা করি।

মুসলিম সেই ব্যক্তি নয়, যে পরীক্ষার মুখে মাথা নত করে; বরং সে নিজেকে এমনভাবে শক্তিশালী, সক্ষম ও মর্যাদাবান করে তোলে, যাতে ইসলাম-বিদ্বেষীরাও তার দৃঢ়তা ও মর্যাদার সামনে মাথা নত করতে বাধ্য হয়। আমাদের আদেশ দেওয়া হয়েছে এমন এক জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে যা জ্ঞান, ন্যায়বিচার, আন্তরিকতা, ত্যাগ ও অন্তর্দৃষ্টির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে। যেন তা শুধুমাত্র নিজেদের রক্ষা করেই না, বরং সমগ্র মানবজাতির জন্য কল্যাণকর হয়। ইসলামী শিক্ষার মূল বক্তব্য হলো—উম্মাহ যেন কেবল দোয়ার মাধ্যমে নয়, বরং পার্থিব উপায়ের যথাযথ ব্যবহার, বুদ্ধিবৃত্তিক সচেতনতা ও ব্যবহারিক প্রজ্ঞার মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করে এবং যুগের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে শুধু তা চিনতে নয়, বরং সাহসের সাথে প্রতিযোগিতাও করে। এটিই প্রকৃত তাওয়াক্কুল, যা বিশ্বাসকে কর্মের সঙ্গে যুক্ত করে এবং দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতার মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন।

وَ اَعِدُّوۡا لَهُمۡ مَّا اسۡتَطَعۡتُمۡ مِّنۡ قُوَّۃٍ وَّ مِنۡ رِّبَاطِ الۡخَیۡلِ تُرۡهِبُوۡنَ بِهٖ عَدُوَّ اللّٰهِ وَ عَدُوَّكُمۡ وَ اٰخَرِیۡنَ مِنۡ دُوۡنِهِمۡ ۚ لَا تَعۡلَمُوۡنَهُمۡ ۚ اَللّٰهُ یَعۡلَمُهُمۡ ؕ وَ مَا تُنۡفِقُوۡا مِنۡ شَیۡءٍ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ یُوَفَّ اِلَیۡكُمۡ وَ اَنۡتُمۡ لَا تُظۡلَمُوۡنَ ﴿۶۰﴾

“আর তোমরা তাদের মোকাবিলার জন্য যথাসাধ্য প্রস্তুত রাখ, শক্তি ও অশ্ব বাহিনী, তা দিয়ে তোমরা ভীত-সন্ত্রস্ত করবে আল্লাহর শক্রকে, তোমাদের শক্রকে এবং এরা ছাড়া অন্যদেরকে যাদেরকে তোমরা জান না, আল্লাহ তাদেরকে জানেন। আর আল্লাহর পথে তোমরা যা কিছু ব্যয় করবে তার পূর্ণ প্রতিদান তোমাদেরকে দেওয়া হবে এবং তোমাদের প্রতি যুলুম করা হবে না।“ (সূরা আনফাল: ৬০)

সাধারণভাবে এই আয়াতে শুধু যুদ্ধের প্রস্তুতির কথাই বলা হয়নি, বরং জীবনের সকল ক্ষেত্রে শক্তি ও সক্ষমতা অর্জনের প্রেরণাও দেওয়া হয়েছে। বিশ্বাসের পরিপক্বতা, নৈতিকতা ও চরিত্রের উন্নতি, আধ্যাত্মিক উৎকর্ষতা, রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা, বাণিজ্য ও শিল্পের উন্নয়ন কিংবা সভ্যতার বিকাশ—প্রতিটি ক্ষেত্রেই শক্তি অর্জন করা জরুরি। সংস্কৃতিকে দৃঢ় করা—এই প্রতিটি ক্ষেত্রেই শক্তিশালী হওয়া প্রয়োজন।

যেহেতু রিসালাতের যুগে ধনুর্বিদ্যা ছিল সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধকৌশল, তাই হযরত উকবা বিন আমির (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) এই আয়াতের ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন।

“সতর্ক হও! শক্তি ধনুর্বিদ্যায় রয়েছে; শুনো! শক্তি ধনুর্বিদ্যায় রয়েছে; শুনো! নিশ্চয়ই শক্তি ধনুর্বিদ্যায় রয়েছে।”

রাসূলুল্লাহ (সা.) এই কৌশল আয়ত্ত করার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন, যাতে মুসলিমরা শত্রুর মোকাবিলায় দুর্বল না হয়ে পড়ে।

মুহাদ্দিসগণ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর এই নির্দেশনার ব্যাখ্যায় লিখেছেন যে, বর্তমান যুগে ধনুর্বিদ্যার উদাহরণ হিসেবে পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রকে উল্লেখ করা যায়, কারণ উভয়ের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো লক্ষ্যে আঘাত হানা। তাই আজকের মুসলিমদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে দক্ষ হতে হবে। বিশেষ করে পারমাণবিক শক্তিতে স্বনির্ভরতা অর্জন করতে হবে, যাতে কোনো জালিম শক্তি এটি দুর্বল জাতিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে না পারে এবং বিশ্বে শান্তি বজায় থাকে।

দুঃখের বিষয় হলো, মুসলিম বিশ্বের মধ্যে অনেক বিজ্ঞানী রয়েছেন যারা পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে দক্ষ, কিন্তু যদি আমাদের ঈমানের উত্তাপ এবং আমলের পরিপক্বতা পারমাণবিক শক্তির সমতুল্য হতো, তবে আজ ফিলিস্তিনের নিরীহ মানুষের রক্ত পৃথিবীর বুকে প্রবাহিত হতো না। আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক, নৈতিক, আধ্যাত্মিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতাই আসলে আমাদের অপমান ও লজ্জার মূল কারণ। এই দুর্বলতাই আমাদেরকে বাধ্য করছে সেই বিশ্বশক্তিগুলোর কাছে মাথানত করতে, তাদের সাথে বাণিজ্যিক চুক্তি করতে এবং তাদের স্বাগত জানাতে, যারা প্রকাশ্যেই ফিলিস্তিনের নির্যাতনকারীদের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।

রাসূলুল্লাহ (সা.) নারীদের সম্মান, পবিত্রতা ও সতীত্বের মুকুট পরিয়েছেন। কিন্তু আফসোস! আজ আমাদের ঈমানের দুর্বলতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, আমরা অমুসলিম অতিথিদের সন্তুষ্ট করার জন্য নারীদের নাচানোর ব্যবস্থা করছি। সেই একই আলেমগণ, যারা আল্লাহর অলী ও তাসাউফের নামে কথা বলতে পিছপা হন না, তারাই আজ এসব ইসলামের পরিপন্থী কার্যকলাপে নীরব বসে আছেন। তাদের এই নীরবতাই প্রমাণ করে যে, আমাদের আধ্যাত্মিক ও ব্যবহারিক শক্তি কতটা দুর্বল হয়ে পড়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যারা ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, আজ গর্বের সঙ্গে দাবি করছে যে তাদের মধ্যস্থতায় ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ বন্ধ হয়েছে। একই যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার ওপর আরোপিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার ঘোষণা দেয়, কিন্তু এসব সে মানবতার স্বার্থে নয় বরং নিজের স্বার্থ রক্ষার জন্যই করে। যদি সে সত্যিই মানবতার প্রতি আন্তরিক হতো, তবে সর্বপ্রথম ফিলিস্তিনে ইসরাইলি বর্বরতা বন্ধ করত। বাস্তবতা হলো—আমেরিকার অন্তরে ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি কোনো আন্তরিকতা নেই।

মুসলমানদের নিন্দা ও অপমানের কারণ হলো, আমরা কুরআনের সেই স্পষ্ট নির্দেশনা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি, যেখানে প্রত্যেক শক্তির ক্ষেত্রে প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আমরা দুনিয়ার ভোগ-বিলাস ও গাফেলতিকে গ্রহণ করেছি। এর ফলাফল স্বরূপ, আজ আমরা বিশ্বশক্তির হাতে খেলনার মতো পরিণত হয়েছি।

এমতাবস্থায়, আমাদের সরকারগুলো আধ্যাত্মিক ও সামরিক শক্তি বৃদ্ধির ব্যাপারে চিন্তিত নয়, এবং অর্থনৈতিক ও শিক্ষাক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা অর্জনের জন্যও কোনো চেষ্টা করছে না। যদি আমরা একাডেমিক ও ব্যবহারিক ক্ষেত্রে শক্তিশালী হতাম, তবে আমাদের প্রিয় স্বদেশে গণহত্যা সংঘটিত হতো না এবং আমাদের বাণিজ্যকে লক্ষ্যবস্তু বানানো যেত না। আমাদের বোনদের মর্যাদা রক্ষিত থাকত, আমাদের মাদ্রাসা, মসজিদ ও খানকাগুলোকেও অপমানিত হতে হতো না। আমরা একাডেমিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ার জন্য আজকের মতো এভাবে সংগঠিত হতাম না।

এই সমস্ত অপমান মূলত কুরআনের সেই আদেশ থেকে বিচ্যুতির মূল্য, যেখানে মুসলিমদের সকল ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এজন্যই আজ ইসলামের শত্রুরা প্রকাশ্যে আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, ইসলামী সরকারগুলোকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে এবং মুসলমানদের ধ্বংসের লক্ষ্যে নির্যাতন চালাচ্ছে। কারণ আমরা ঈমান, আমল, নৈতিকতা, আধ্যাত্মিকতা, রাজনীতি, অর্থনীতি, বাণিজ্য, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানের প্রতিটি ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছি।

কত বছর আগের কথা, মুসলমানরাই ছিল বিজ্ঞান ও শিল্পকলার ইমাম। তারা বিশ্বকে জ্ঞানের আলো দিয়েছিল, গবেষণার পথ দেখিয়েছিল এবং এমন সব আবিষ্কার করেছিল যেগুলোর সুফল আজও বিশ্ব পাচ্ছে। কিন্তু আজ আমরা শিক্ষা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে অন্য জাতির তুলনায় অনেক পিছিয়ে পড়েছি। আমরা ধর্মকে কেবল নামাজ, রোযা, যাকাত ও হজ্জ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি, যদিও ইসলাম বিজ্ঞান ও আধুনিক জ্ঞানের অনুসন্ধানকেও সর্বোচ্চ ইবাদত হিসেবে গণ্য করেছে।

বরং কিছু আলেম বলেন, যদি কোনো মুসলমান আধুনিক বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে মানবতার কল্যাণে কাজ করে, তবে তা ষাট বছর ইবাদতের চেয়েও উত্তম।

আজকের মুসলিম সমাজের একটি বড় দুর্বলতা হলো—আমরা জ্ঞান ও শিল্পকলাকে শুধু চাকরির জন্য অর্জন করছি।

জ্ঞান অর্জনের মূল উদ্দেশ্য ছিল মানুষ যেন নিজেকে চিনতে পারে, তার প্রতিপালককে চিনতে পারে এবং এই দুনিয়ায় মানবতার সেবা করতে পারে। কিন্তু আজ মুসলিম যুবকরা কেবল চাকরির উদ্দেশ্যে জ্ঞান অর্জন করে। জাতির উপকার করার মানসিকতা দুর্বল হয়ে পড়েছে। এজন্যই মুসলিমদের মধ্যে উচ্চ ডিগ্রি থাকা সত্ত্বেও আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বড় কোনো অর্জন দেখা যায় না, অগ্রগতি স্পষ্ট নয়। এটি শুধু একাডেমিক দুর্বলতার নয়, বরং ঈমানের দুর্বলতারও প্রমাণ। মুসলমানরা এখন আর সত্যকে সত্য বলে, ও বলার সাহস রাখে না এবং মিথ্যার সামনে নীরব থাকে।

ইসলাম প্রচার, প্রসার এবং মুসলমানদের ঈমান রক্ষার ক্ষেত্রে ইসলামী মাদ্রাসাগুলোর ঐতিহাসিক ভূমিকা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, আজ অনেক মাদ্রাসাই ব্যক্তিগত স্বার্থের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। তাদের লক্ষ্য কেবল দ্বীনের খেদমত নয়, বরং খ্যাতি অর্জন, অনুদান সংগ্রহ এবং ব্যক্তিগত লাভও হয়ে উঠেছে। প্রায়ই বলা হয়, এসব মাদ্রাসায় বিনামূল্যে শিক্ষা প্রদান করা হয়; কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, এদের ব্যবস্থাপনা চলে জাতির কিছু সম্মানিত ব্যক্তির দান, যাকাত ও সাদাকার ওপর। যদি কোনো মাদ্রাসার বাৎসরিক খরচ এক কোটি টাকা হয় এবং সেখানে মাত্র একশো ছাত্র পড়ে, তাহলে গড়ে একজন দরিদ্র পিতার পক্ষ থেকে বছরে এক লক্ষ টাকা দেওয়া সম্ভব হয় না; বরং এই ব্যয়ভার বহন করে থাকেন জাতির কিছু উপকারক দাতা।

তারপরও, এসব মাদ্রাসা থেকে গ্র্যাজুয়েট হওয়া শিক্ষার্থীরা কোনো উচ্চ বেতনের চাকরি বা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ লাভ করে না; বরং তাদের অধিকাংশকেই মসজিদের মুয়াজ্জিন বা ইমাম হয়ে অতি সাধারণ বেতনে জীবনযাপন করতে হয়। তাদের আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত দুর্বল থাকে, এবং তাদের বেতন কোনো সাধারণ শ্রমিকের চেয়েও কম।

এ কথা বলাটা ভুল হবে না যে, এই ধরনের মাদ্রাসাগুলো মুসলিমদের অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে, যেখানে ধর্মকে সীমিত করে ফেলা হয়েছে। আজ কেউ যদি এসব মাদ্রাসার বিরুদ্ধে কথা বলতে যায়, তাহলে হয় তার জিভ বন্ধ করে দেওয়া হয়, নতুবা তাকে ধর্মের অপবাদ দেওয়া হয়। বাস্তবতা হলো—মুসলিম উম্মাহর অধিকাংশই এই পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন, কিন্তু কেউ কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার সাহস করে না, কারণ আমাদের ঈমান, মর্যাদা ও ধর্মীয় আত্মমর্যাদা দুর্বল হয়ে পড়েছে।

একইভাবে আরেকটি গুরুতর সমস্যা হলো, আজ মুসলিম সমাজে অনেক ভণ্ড পীর ও স্বঘোষিত আলেমের আবির্ভাব ঘটেছে। তাদের বাহ্যিক চেহারা এমন যে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। রঙিন জওয়া, বড় পাগড়ি, লম্বা দাড়ি এবং চমৎকার কথা বলার ক্ষমতা—কিন্তু বাস্তবে তাদের শরিয়তের জ্ঞান নেই, বরং শরিয়তের প্রকৃত পদ্ধতির সাথে তাদের কোনো সম্পর্কই নেই। তাদের প্রকৃত লক্ষ্য হলো কেবল নজরানা সংগ্রহ করা এবং সরল-সহজ মুসলমানদের প্রতারণা করা।

মুসলমানরা তাদের চরিত্র জানার পরও নীরব থাকে, কারণ তাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলার মতো ধর্মীয় সাহস আর অবশিষ্ট নেই। যদি আমাদের ঈমানের শক্তি থাকত, তবে এই মিথ্যা পীর ও আলেমরা এভাবে মানুষকে প্রতারিত করতে পারত না।

রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন—শক্তিশালী মুমিন দুর্বল মুমিনের চেয়ে উত্তম এবং আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়, যদিও উভয়ের মধ্যেই কল্যাণ আছে। এর অর্থ হলো, একজন মুসলমানের উচিত শারীরিক, মানসিক, বৈজ্ঞানিক এবং আধ্যাত্মিক ভাবে শক্তিশালী হওয়া, যাতে সে নিজের ঈমান রক্ষা করতে পারে এবং অন্যদের পথপ্রদর্শন করতে পারে। যদি কোনো মুমিন কেবল বিশ্বাস রাখে কিন্তু জ্ঞান, প্রজ্ঞা, সাহস, শক্তি এবং কর্ম থেকে বঞ্চিত থাকে, তবে সে কেবল নিজের ঈমানের উপকার করতে পারে, অন্যদের উপকার করতে পারে না। পক্ষান্তরে, শক্তিশালী মুমিন অন্যদেরও উপকার করে, তাদেরকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করে জান্নাতের পথ দেখাতে সক্ষম হয়।

আজ আমাদের চারপাশে তাকালে দেখা যায়, আমাদের সমাজ ঈমানের দিক থেকে দুর্বল, বাস্তব জীবনে পশ্চাৎপদ, আধ্যাত্মিক ভাবে শূন্য, নৈতিক বিশ্বাস থেকে বিচ্যুত এবং সামষ্টিকভাবে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন। এই দুর্বলতার কারণেই পাপ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এবং নেকির চর্চা কমে যাচ্ছে। মুসলমানরা পরস্পরের প্রতি হিংসাত্মক, একে অপরের দুর্বলতা কাজে লাগাচ্ছে এবং সত্য থেকে বিচ্যুত হচ্ছে।

আমাদের প্রয়োজন ঈমানকে মজবুত করা; জ্ঞানকে শুধু চাকরির মাধ্যম বানানো নয়, বরং মানুষের সেবা ও উম্মাহর কল্যাণের পথ হিসেবে গ্রহণ করা। যেসব মাদ্রাসা ধর্মের নামে কেবল দান-অনুদান ও ব্যবসার কেন্দ্র হয়ে উঠেছে, সেগুলো সংস্কার করা জরুরি। যেসব ভণ্ড পীর ও স্বঘোষিত আলেম ইসলামের নামে প্রতারণা করছে, তাদের ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। আমাদের সত্য কথা বলার সাহস রাখতে হবে, যত মূল্যই দিতে হোক না কেন।

হে আল্লাহ! আমাদের উপকারী জ্ঞান দান করুন, ঈমানের শক্তি দিন, কর্মে শক্তি দিন এবং আমাদেরকে এমন মুমিন বানান, যারা দুনিয়ার জন্য কল্যাণকর এবং আখিরাতে সফল হবে। হে আল্লাহ! আমাদেরকে উসওয়াতুল হাসানাহ-এর আলোকে জীবনযাপন করার তৌফিক দিন। আমীন।

উপসংহার

বর্তমান মুসলিম বিশ্বের অবস্থা ইসলামের মৌলিক শিক্ষাগুলো নিয়ে গভীর ও জরুরি পুনর্বিবেচনার দাবি জানায়, বিশেষ করে আজকের চ্যালেঞ্জগুলোর প্রেক্ষাপটে। ইসলাম একটি ভারসাম্যপূর্ণ ধর্ম, যা আধ্যাত্মিক ইবাদতের সঙ্গে বাস্তব প্রস্তুতিরও গুরুত্ব দেয়। কুরআনের নির্দেশনা ও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হাদীসে ঈমান, জ্ঞান, চরিত্র ও সামাজিক দায়িত্বের প্রতিটি ক্ষেত্রে শক্তির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মুসলিম সমাজের বর্তমান বুদ্ধিবৃত্তিক, নৈতিক ও অর্থনৈতিক অবক্ষয় এই সামগ্রিক দর্শনকে অবহেলা করারই ফল। মুসলিমদের উচিত জ্ঞান, ন্যায়বিচার, স্বনির্ভরতা ও সত্যনিষ্ঠার প্রতি নিজেদের অঙ্গীকার নতুন করে জাগ্রত করা, মাদ্রাসার মতো প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কার করা এবং ধর্মীয় নেতৃত্বের মুনাফিকতা দূর করা। প্রকৃত তাওয়াক্কুল অর্থ নিষ্ক্রিয়তা নয়, বরং ঈমানের সঙ্গে সঠিক কর্মের সমন্বয়। কেবল আন্তরিক সংস্কার, ঐক্য এবং উৎকর্ষের সাধনার মাধ্যমেই উম্মাহ তার মর্যাদা পুনরুদ্ধার করতে পারবে, বৈশ্বিক উন্নয়নে অর্থবহ অবদান রাখতে পারবে এবং তার আল্লাহ প্রদত্ত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে সক্ষম হবে।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter