শিক্ষা ও সংস্কৃতি
শিক্ষার সাথে অশিক্ষা এবং সংস্কৃতির সাথে অপসংস্কৃতির কথা বলতে বা শুনতে অভ্যাস্থ। তাহলে এদের মধ্যে বিভেদকারী বা লক্ষণ রেখা কি? কোন কিছু নির্ধারণের জন্য রেফারেন্স মানতে হয়। যেমন আন্তর্জাতিক ভাবে একতাল লৌহপিণ্ডকে এক কেজি ধরে অন্য বস্তুর ওজন নির্ধারণ করা হয়। এভাবে কোন জিনিসের দৈর্ঘ্য মাপতে মিটার বা গজের একটা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড আছে। সেভাবেই শিক্ষা-অশিক্ষা এবং সংস্কৃতি–অপসংস্কৃতির মধ্যে বিভেদ-রেখা বা লক্ষণ রেখা কি হবে, তা ভাবতে হবে। না নিজের খিয়াল অনুযায়ী চলব এবং বলব! এ হয় যদি তবে দেখা যাবে, আমার কাছে যা শিক্ষা অন্যের কাছে তা অশিক্ষা। একই ভাবে আমার কাছে যা সংস্কৃতি অন্যের কাছে তা অপসংস্কৃতি।
আমরা মানুষ। আমাদের মধ্যে বিভিন্নতা আছে, আছে দর্শনে কর্তব্য। মানুষ মানেই মৌলিক। মানুষের এই মৌলিকত্বের চরম উৎকর্ষতা হল যা তাকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসিয়েছে, তা হল তার মানবিকতা। এটা ছাড়া মানুষ সবার নীচে। সবার উপরে হতে হলে হতে হবে সব চাইতে মানবিক। যে শিক্ষা ও সংস্কৃতি মানবিকতাকে পুষ্ট করে তাহায় সুশিক্ষা ও সুস্থ সংস্কৃতি, অন্য কথায় মানবতা পরিপন্থী শিক্ষা বা সংস্কৃতি অশিক্ষা বা অপসংস্কৃতি। মানবতায় হোক মানদণ্ড শিক্ষা-অশিক্ষার এবং সংস্কৃতি-অপসংস্কৃতির ভেদের বিচার ব্যবস্থা। এর আলোকে যদি আলোকপাত করা যায় তবে শিক্ষা ও সংস্কৃতি আজ কোথায় তা অনুমেয়। বড়ো দুর্দিন।
শিক্ষা যদি আলো হয় এবং তা যদি অন্ধকার দূর করার পাথেয় হয়। তবে আজকের শিক্ষা কি সত্যই শিক্ষা? আলোর যে বৈশিষ্ট্য তা হল তার অন্ধকার দূর করে। এতে সে ভেদাভেদ করে না, না উঁচু নিচুতে, না মানুষে মানুষে। বলতে গেলে আলোকিত করে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে। প্রকৃতি শিক্ষিত হবে মানবিকতার পূজারী। তখন জীবন হবে জীবনের জন্য। এটাই মানবিকতার চরম বিকাশ।
শিক্ষা দানে শিক্ষক, আমাদের জীবনে শিক্ষার ক্ষেত্রে মূলত চার-শ্রেণীর শিক্ষক থেকে শিক্ষা লাভ করি। প্রথম শিক্ষক মা ও বাবা যারা প্রাথমিক শিক্ষক। এখানে মায়ের ভূমিকা বড়। মায়ের কোলে দুলেছি সবাই, মা হতে মাতৃভাষা মাতাই হল প্রথম মূলধন। জীবনের প্রথম ভীত আর ভীত মজবুত হলে বাকিটা মজবুত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই মা যদি ভাল হয় তবে সন্তান ভাল হয়ীর সম্ভাবনা বেশি সমাজে ভাল মায়েরও প্রয়োজন আছে। মায়েরা ভাল সমাজ গড়তে পারবেন, সমাজ কে ভাল সন্তান উপহার দিয়ে মায়েদের কুর্নিশ করি আর প্রার্থনা করি সুসন্তান উপহার দিয়ে সমাজ গড়ুন। দ্বিতীয় শিক্ষক হল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক। এই জায়গাটা কতটা নড়বড়ে তা শিক্ষক মহাশয় হতে সমাজের সুধীজন জানেন। বললে কম বলা হবে। তৃতীয় শিক্ষক সমাজ এটা একজন শিশুর কাছে বৃহত্তর পরিবার। তার ছোট পরিবার (ফ্যামিলি) যা শিক্ষা দেয় তা যদি সমাজে গিয়ে লালন করার পরিবেশ না থাকে তবে তা অঙ্কুরে বি-নিষ্ঠ হবে। আজকের সমাজ আমাদের শিশুদের ভাল কিছু শিক্ষা দেওয়া তো দূরের কথা। বাইরে পা রাখতে গিয়ে কুশিক্ষা, কুকথা, কুসংস্কার ছাড়া আর কিছুই নেই। এমনটাই আজ হচ্ছে শিক্ষক হিসেবে সমাজের ভূমিকা। শিশুর বিকাশের জন্য আজকের সমাজ কতটা সহায়ক তা ভাবতে হবে। সমাজ সুন্দর না হলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও সুন্দর হতে পারবে না। আমরা চোখ বুজে আছি এবং সমাজের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছি এবং সমাজের চাহিদা অনুযায়ী অর্থকড়ি দৃষ্টিভঙ্গি রেখে নিজেকে গড়ার চেষ্টা করছি। সমাজের পরিবর্তন কথা ভেবে সমাজ সংস্কারক বা সমাজ সেবী তৈরিতে আগ্রহী নয়। অর্থ যেখানে আমি সেখানে অর্থকড়ি সমাজ ব্যবস্থায় পৃষ্ঠ আমরা। কবে আমরা মানুষ তৈরির কথা ভাবব? কতদিন আর মানবতা-হীন জীবন কাটাব? কতদিন নিজেকে প্রতারণা করব। বাকী থাকে আমি ছাড়াও অনন্ত সৃষ্টি। জীব ও জড়। জানা ও অজানা কত কি। এদের বাদ দিয়ে আমরা বাঁচতে পারিনা। এদের নিয়েও ভাবার আছে যা অহরহ আমাদের জীবন প্রবাহের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। এরাও আমাদের শিক্ষক। শিক্ষক হিসেবে বর্তমান নৈতিক অবক্ষয়ই অবমূল্যায়ন ও মানবতা-হীন আমরা নিজের জন্য ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আদর্শহীন করেছি নিজেদের হারিয়েছি শিক্ষকতার দক্ষতা ও মাধুর্য। সব কিছু বিসর্জিত এই আমি। কে শেখাবে আমাকে? কে বলবে আমাকে এই অধঃপতন কথা। আমি শিক্ষক হতে পারিনি আমার না আমার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের। আমিতো প্রয়োজনে কাকের ডাক ডাকি প্রয়োজনে কোকিলের ডাক ডাকি। আমি শিক্ষক হিসেবে ব্যর্থ তাই আমার দ্বারা পরিচালিত সমাজ ও ব্যর্থ। বাকী রইলো অনন্ত সৃষ্টি। দেখি, শিখি , ভাবি কি বলে তা আমাকে। বিশেষ জ্ঞান মানুষ কে মৌহমুক্ত করে। আর বিশেষ জ্ঞানের ভাণ্ডার এই প্রকৃতি। স্ব-মহিমায় উদ্ভাসিত আমার চোখের সামনে। একে পড়তে হবে, জানতে হবে, বুঝতে হবে তার মাঝের শৃঙ্খলা ও সৌন্দর্য। বৃহত্ততা ও সৌন্দর্য ক্ষুদ্রতা ও অসুন্দর কে নির্মূল এ সহায়ক।বৃহত্ততা ও ক্ষুদ্রতার গণ্ডীকে ভেঙে চুরমার করতে পারে। ক্ষুদ্রতা থেকে উদ্ভূত অহংকে চূর্ণ করে। আমি যখন কোন সমুদ্র সৈকতে দাঁড়িয়ে তখন তার বৃহত্তর জলরাশি আমার ক্ষুদ্রতাকে কষাঘাত করে। অবনত হই আমি ।নির্বিকার হয়ে চেয়ে থাকি ভুলে যায় নিজেকে আমার আহংকে। আত্মীক বোধোদয়। ভাবতে শেখায় জীবনকে- জীবনের উদ্দেশ্য কে। আমিত্ব-হীন আমি। জল তরঙ্গের আহব্বান মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ও ভালোবাসা। যখন অনন্ত সৃষ্টির গভীরে অবগাহন করবো তখন দেখবো আরও বড়ো সৌন্দর্য। এর ভুলে ব্যতিক্রমই শৃঙ্খলা বা অর্ডার (Order)। প্রকৃতিতে প্রতিটি সৃষ্টি নিপুণ ভাবে মেনে চলেছে নিয়ম- শৃঙ্খলা। নেই কোথাও তার ব্যতিক্রম। আর ব্যতিক্রম বিহীন অনুশীলনই বিজ্ঞান (Science)। আর বিজ্ঞানের জ্ঞানই আমাদের প্রত্যয় ও দৃঢ়তা। আমি ছাড়া অন্য সৃষ্টি জীব ও জড় নিয়মে বাঁধা এবং তা তার সত্তা-গত মৌলিক ধর্ম। যেমন আলো সরল রেখায় চলে। সূর্যের আলোর ফোটন-কণা গাছের পাতায় রান্নাঘরের প্রধান উপকরণ। সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে উদ্ভিদের শিকড় হতে তোলা জলের হাইড্রোজেন ও বাতাসের কার্বনডাই অক্সাইড দ্বারা কার্বোহাইড্রেট তৈরি করে চলেছে। তা রূপান্তর হতে গাছের ফল হয়ে তা আমাদের পাতে আসে। আবার উদ্ভিদ হতে প্রাণী জগত হয়ে আমাদের পাতে আসে। আবার গাছ হতে আপেল আকাশে না গিয়ে মাটিতে পড়ে। সৃষ্টি এই সত্তা-গত অহরহ ঘটে চলেছে আমাদের চোখের সামনে। এই অপরিবর্তনীয় নিয়ম- শৃঙ্খলা-বাধ্যবাধকতাই সৌন্দর্যের মূল। আর এমন নিয়ম- শৃঙ্খলা-বাধ্যবাধকতা আমাদের জীবনে সৌন্দর্য বয়ে আনবে। আরও দেখলে দেখা যায় কই নিঃশ্বাসে নেওয়া অক্সিজেন তো দেহের ভিতরে গিয়ে নাইট্রোজেন হয় না।এই দৃঢ়তা আমাদের নেই প্রয়োজনে আমি বিভিন্ন রূপে বহুরূপী। তাই আমি পরিচয় বিহীন। আমাকে চেনা যায় না কিন্তু অন্য সৃষ্টি কে চিনতে ভুল হয়না কারণ তারা একই নিয়মে বাঁধা-একই বাঁধনে বাঁধা- একই কথাই একীভূত আমারও এমন হওয়ার কথা কিন্তু আমি আমাতে বিভোর। আরও দেখি একই মাটিতে পাশাপাশি আম গাছ আম তাল গাছ তাল ফলিয়ে চলেছে। দ্বন্দ্ব নেই। কি সাম্যের বাত্রা দেয় আমাকে। আরও কতকি ভাবলে লজ্জাই মাথাহেঁট হয়। আর এ বুঝতে অক্ষম আমি মাথা উঁচু করে দম্ভভরে রাস্তা চলি সে আম গাছ ও তালা গাছের পাশ দিয়ে। এসবকে অস্বীকার সংস্কৃতি নয় বরঞ্চ তার অপলাপ। তা স্বীকার ও আয়োজনই সংস্কৃতি। জীবন বিনোদন (এন্টারটেন্টমেন্ট) নয়- জীবন পরীক্ষা। আর পরীক্ষায় পাশ হল বিনোদন। পরীক্ষার পেক্ষাপট মানবিকতা। মানবতার ঝান্ডা তুলে ধরা এবং এর তলে লড়াই ও কামিয়াবি হবে পাশ ও ফেলের মানদণ্ড। সংস্কৃতি জীবন বোধ এবং সৃজন শক্তি তুলে ধরার ক্ষেত্র । সংস্কৃতি দেশ ও কাল ভেদে প্রকাশে আলাদা তবে মুলে থাকে জীবন বোধের ছবি যা মানবিকতা কে তুলে ধরে এর চর্চা বলবে একটা দেশ বা জাতি কতটা উদার, সহনশীল, সৃজনশীল, মননশীল। অন্য কথায় সংস্কৃতি বলবে একটা জাতি কতটা মানবিক। তাই প্রকাশে আলাদা হলেও মূলে একই যা মানবিকতা । আর মানবিকতার মানদণ্ড হল জীবন হবে জীবনের জন্য। এটা কি করে বিনোদন সংলাপ সম্বলিত? এতে থাকবে আত্মার অভিব্যক্তি। রিপুর-ঝংকারে শামিল হয়ে আনুরিত কোন অনুনাদ নয় পরম আত্মা কে শক্তিশালী করার রিহারসউ এমনটা কি মানি না মানি না? না চালিয়ে যায় মন যেটা চালায়। তক্কা করিনা কাউকে। নিজের হাতেই সাড়ে তিন হাত। এমনটা হলে তো সবজায়গায় একই দাপট চায়। অক্সিজেন ব্যাতি রেখে বাঁচা। বিনা জলে জীবন যাপন। উত্তর তো না তবে কেন এই আত্মভরীতা। কবে হবো সৌন্দর্যের পূজারী। লীন হবো সৃষ্টির সত্তাতে।কবে আজকের সামাজিক মূল্যবোধকে কষাঘাত করে অকপটে ভাবব-সমাজ থেকে আমি কি পেলাম তার চাইতে সমাজ কে কি দিলাম। কবে আমার স্বক্ষমতার কথা না ভেবে হাজারো অক্ষমতার কথা। উপকারীর কাছে কৃতজ্ঞতা কামনা না করে কৃতজ্ঞ হবো।