মাতঙ্গিনী হাজরা (গান্ধী বুড়ি)
মাতঙ্গিনী হাজরা তিনি একজন ভারতীয় বিপ্লবী এবং স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী মহিলা যিনাকে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান পুলিশরা ২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে তামলুক পুলিশ স্টেশনের সামনে গুলি করে হত্যা করেছিল। শেষ নিঃশাস ত্যাগ করা পর্যন্ত তিনি ভারতের পতাকা নিচে পরতে দেননি। তিনি পাঁচটি বিদ্যুৎ বাহিনী ভলান্টিয়ার্স পরিচালনা করেন, যেটি ২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে তমলুক থানা দখল করার জন্য গঠিত করেন। তিনাকে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া পুলিশ দ্বারা তামলূক পুলিশ স্টেশনের সামনে গুলি করা হলে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের মেদিনীপুর থেকে প্রথম শহীদ হন তিনি। তিনাকে স্নেহের সঙ্গে গান্ধী বুড়ি নামে জানা যেত। তিনি ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে গান্ধীবাদী হিসেবে সক্রিয় ও অনুরাগী হয়ে ভারতীয় বিপ্লবী এবং স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
মেদিনীপুরে স্বাধীনতা আন্দোলনের এক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহন। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে, তিনি অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন এবং ব্রিটিশদের সাল্ট এক্ট ভঙ্গ করার ফলে তিনাকে গ্রেফতার করা হয়। তিনাকে শীঘ্রই মুক্তি করা হয় এবং পরে পরেই তিনি ট্যাক্স বিলুপ্ত করার উদ্দেশ্যে আন্দোলন চালিয়ে যান। এর জন্য তিনাকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয় এবং ছয় মাসের জন্য বহরমপুর জেলে কারারুদ্ধ করা হয়। মুক্তি পাওয়ার পরে তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস-এর এক সক্রিয় সদস্য হয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত থাকেন। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে সেরামপুরে মহকুমা কংগ্রেস সম্মেলনে অংশগ্রহন করেন এবং সেখানে তিনি পুলিশের লাঠি চার্জের কারণে তিনি আহত হয়।
জন্ম এবং প্রাথমিক জীবন
মাতঙ্গিনী হাজরা ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে তমলুক শহরের নিকটবর্তী গ্রাম হোগলাই জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি একজন গরিব কৃষকের মেয়ে ছিলেন যার এমনকি প্রাথিমিক শিক্ষারও সামর্থ্য ছিলেন না। ১২ বছর বয়সে মেদিনীপুরের এলিনান গ্রামের ৬০ বছরের ত্রিলোচন হাজরা নামক ব্যাক্তির সঙ্গে বিবাহ করেন। তিনি ১৮ বছর বয়সে সন্তান ছাড়াই বিধবা হয়ে যান। তিনার স্বামীর মৃত্যুর পরেই তিনি তিনার জীবন সমাজ সেবায় উৎসর্গ করে দেন।
ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে মাতঙ্গিনী হাজরার উৎসাহ ও উৎসর্গ-এর উদাহরণ দেওয়া হয়। তিনি বয়স ও শারীরিক ঝুঁকির সম্মুখীন হয়েও স্বাধীনতার জন্য অটল স্থিরতা দেখিয়ে ভারতীয় প্রজন্মের জন্য উনুপ্রেণা হয়ে আছেন। এই উৎসাহের কারণ হল তিনার নির্যাতন ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়া।
মাতঙ্গিনী হাজরার উৎসর্গ স্থায়ী উত্তরাধিকার হিসেবে আমাদের মধ্যে রয়ে গেছে। তিনি ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহনে মহিলাদের প্রতীক হয়ে স্মরণীয়। তিনার নামে ভারতের বিভিন্ন স্কুল, রাস্তা এবং প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি এই উৎসর্গের স্বীকৃতি।
স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রবেশ
তিনি পুরুষ, মহিলা সকলকে একত্রিত করে এই আন্দোলনে অংশগ্রহন করেন। তিনি মহাত্মা গান্ধীর আদর্শ ও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ক্রিয়াকলাপ দেখে প্রভাবিত হয়ে ছিলেন।
১৯০০ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহন করেন। ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে অহিংস নাগরিক অবাধ্যতায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।
মাতঙ্গিনীর মহাত্মা গান্ধীর পথ অনুসরণ
কুড়ি শতক পার হতেই, ভারত মহাদেশে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের আকর্ষণ আরম্ভ হয়। মানুষের মধ্যে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতাপ সজাগ করার জন্য গান্ধীজি ব্যাপকভাবে বিভিন্ন অঞ্চলের উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিমে যাত্রা করেন। মাতঙ্গিনী হাজরা হাজার মহিলাদের মধ্যে এক যিনি মহাত্মা গান্ধীর অনন্য সাধারণ প্রতিভা ও বার্তাকে সবার কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। 'কোড নাম গড' (Code Name God, ২০০৫) বইয়ে ভারতীয়-মার্কিন পন্ডিত এবং লেখক মানি ভৌমিক যিনি তামলুকেই বড় হন বলেন যে, “মহাত্মা গান্ধীর উপর তিনার ভালোবাসা ছিল খুব বিশিষ্ট তাই তিনি তিনার গ্রামে গান্ধীবুড়ি নামে পরিচিত হন - বৃদ্ধ গান্ধীবাদী মহিলা।”
স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং গ্রেফতার
তিনাকে ৬১ বছর বয়সে, ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে আইন অমান্য আন্দোলনে অংশগ্রহন করার জন্য গ্রেফতার করা হয়। আসলে, এই আন্দোলনটিকে নেতৃত্ব করার জন্য তিনি খুব স্বল্প মেয়াদ কারাগারে বন্দি থাকেন। তিনার গ্রেফতারের কিছু সময়ের মধ্যে তিনি জামিন পেয়ে যান। এই সময়টি ছিল সেই সময় যখন মাতঙ্গিনী হাজরা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের এক সক্রিয় সদস্য হয় পরিচয় দেন।
লেখক ভৌমিক তিনার লিখিত বইয়ে মাতঙ্গিনী হাজরার এক দৃশ্য ব্যাখ্যা করেন, “এক ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের গনগনে দুপুরে, জেলা রাজধানীতে একটি স্বাধীনতা মিছিল অনুষ্ঠিত করা হয়। এটার গন্তব্যস্থান ছিল রাজ্যপালের ভবন পর্যন্ত...। স্বাধীনতা আন্দোলনের পতাকা উঁচুতে ধরে তখন মাতঙ্গিনী প্যারেড ভ্যানগার্ডে মিছিল করছিলেন...। রাজ্যপাল ভবনে সামনে পৌঁছালে, "গো ব্যাক, লাট সাহেব" বলে চিৎকার দিতে থাকেন। যতক্ষণ না সৈন্যরা তাঁকে নিচে নামায় ততক্ষন তিনি চিৎকার করতেই থাকেন।”
সেই দুপুরে, ব্রিটিশ পুলিশ তিনাকে লাঞ্চিত করেন। তিনাকে গ্রেফতার করা হয় এবং তিনাকে দণ্ডিত করা হয় যে তিনি ছয় মাস কারাগারে কঠিন শ্রম করতে হবে। তিনার কঠোর শব্দে তখন তিনি খুব দুর্বল হয়ে যান কিন্তু তবুও তিনি এই আন্দোলন থেকে সরে যাননি। জামিনের পরে পরেই আবার তিনি দেশ ও সামাজিক কর্মে যুক্ত হন।