জাতীয়তাবাদ হল প্রচলিত আসাবিয়ার হালনাগাদ সংস্করণ যা নবী মুহাম্মদ (ﷺ) নির্মূল করেছিলেন

দেশ, রাষ্ট্র এবং জাতি - যদিও কখনও একে অপরের স্থানে ব্যবহৃত হয় - বাস্তবে তাদের জ্ঞানতত্ত্বে অনেক পার্থক্য আছে। প্রথমটি ভৌগোলিক, দ্বিতীয়টি রাজনৈতিক এবং শেষেরটি তাত্ত্বিক বা অনুভূতি সংক্রান্ত ক্ষেত্রসমূহে ব্যবহারের জন্য বিশেষিত। তিনটি ধারণাকে ইংরেজিতে বহুত পরিচালিত যথাক্রমে Country, State, Nation শব্দে বলা হয়।

জাতীয়তাবাদ একটি মনস্তাত্ত্বিক ধারণা

রাষ্ট্রবিজ্ঞানে, জাতি হল একটি নির্দিষ্ট দেশ বা ভূখণ্ডে বসবাসকারী সাধারণ বংশোদ্ভূত, ইতিহাস, সংস্কৃতি বা ভাষা দ্বারা একত্রিত মানুষের একটি বৃহৎ সংস্থা। আইরিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং ইতিহাসবিদ, বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসনের মতে এটি একটি 'কল্পিত’ (Imagined Community) বিষয়, আবার বিশ্ব রাজনীতির পন্ডিত পল জেমস জাতি কে এক বিমূর্ত সম্প্রদায় (Abstract Community) হিসেবে সংগায়িত করেছেন। অর্থাৎ, জাতি থেকে জাতীয়ত্ব (Nationalism) শুধুমাত্র মনোবিজ্ঞানে (Psychology) বিদ্যমান যা পরবর্তীতে একটি শক্তিশালী আদর্শিক (Ideological) শক্তির রূপ নেয়। এই তত্ত্ব মানসিক পার্থক্যের দিকে পরিচালিত করে যা আজ সমস্ত বিভাজনের মূল কারণ। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী এবং রাজনৈতিক কর্মী জোসেফ স্ট্যালিন যেরকম জাতিকে ঐতিহাসিকভাবে গঠিত এবং স্থিতিশীল সম্প্রদায় হিসেবে ব্যাখ্যা করে, অনুরূপ জাতির পিছনে জাতীয়তার আগুন নিয়ে বেশ ইতিহাস আছে।

বিভাজন ক্রিয়া

জাতীয়তাবাদের ধারণা, যা অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে রাষ্ট্রহীন ইউরোপে জোহান হার্ডারের দ্বারা উদ্ভূত হয়েছিল এবং পরে ইতালীয় জোসেফ ম্যাজিনি দ্বারা প্ররোচিত হয়, সারা বিশ্বে বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে, এমনকি সম্পূর্ণ মহাদেশটিকে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেশে বিভক্ত করা থেকে বিশাল অটোমান সাম্রাজ্যকে বিচ্ছিন্ন করে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার পিছনেও কোথাও না কোথাও জাতীয়তাবাদের উস্কানি দেখা যায়। আজ প্রযন্ত বিশ্বের বহু চৌহদ্দে সংঘটিত অবিরাম সংঘর্ষের পিছনে কোনো না কোনো দিক দিয়ে জাতীয়তাবাদের অবদান আছে।

জাতীয়তাবাদের বিভাজন ক্রিয়া এখনও চলছে - ধর্ম (পাকিস্তান), ভাষা (বাংলাদেশ), মতাদর্শ (ফ্রান্স), জাতি (জার্মানি, বলকান দেশসমূহ) ইত্যাদির নামে। আবার কি স্ববিরোধী বাপ্যার, মাঝে মাঝে জাতীয় সংহতির নামে এই ধরনের বিচ্ছিন্নতা দাবিয়ে দেওয়া হয়। তাছাড়া, এই ধরনের প্রচেষ্টাকে বিচ্ছিন্নতাবাদ, দেশদ্রোহিতা ইত্যাদি অবমাননাকর শব্দে চিহ্নিত করা হয়। এই অর্থে, জাতীয়তাবাদ একটি মানবসৃষ্ট ব্যর্থ এবং স্ব-বিরোধী ধারণা। জাতীয়তাবাদ কখনো সর্বজনীন হতে পারে না।

ইতিবাচক এবং নেতিবাচক

অবশ্যই জাতীয়তাবাদ কিছু ইতিবাচক বৈশিষ্ঠের সঙ্গেও যুক্ত যেমন একটি সমষ্টিগত পরিচয়, ঔপনিবেশিক বিরোধী চেতনা, লক্ষ্যযুক্ত উন্নয়ন এবং জাতীয় গর্ব। যাইহোক, এইসব উদ্দেশসমূহ অন্যভাবেও অর্জন করা যেতে পারে। অস্বীকারের বিষয় হল উগ্র-জাতীয়তাবাদ সর্বজনীনতার সামগ্রিক সহাবস্থানকে উপড়ে ফেলে এবং মনের অনুভূতিকে সীমাবদ্ধ করে দেয়। সামগ্রিক মানবতার মধ্যে বৈষম্য এবং বিভাজন সৃষ্টি করে। জাতীয়তাবাদ নিছক জাতীয় স্বার্থের সাথে আবদ্ধ যেখানে এটি জাতীয় অসুবিধার সময়ে মানবতাবাদী মূল্যবোধকে ভুলে যায় এবং তা উপেক্ষা করে বসে (বর্তমান রাশিয়া-ইউক্রেন এবং ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের মধ্যে চলমান যুদ্ধ এই কঠোর বাস্তবতার প্রমান)।

আরবের আসাবিয়া

জাতীয়তাবাদ হল আরবদের মধ্যে প্রচলিত আসাবিয়ার হালনাগাদ সংস্করণ যা নবী মুহাম্মদ (ﷺ) আল্লাহ-প্রদত্ত নির্দেশনার মাধ্যমে নির্মূল করে সমগ্র অঞ্চলকে একই সরলরেখায় এনেছিলেন। বৈশিক ব্যাবস্থার জন্য বৈপ্লবিক বাণী দিয়েছেন - “সমগ্র মানুষ আদম-সন্তান, আর আদম মাটি থেকে [সৃষ্ট]” (জামী' তিরমিযি), “হে লোক সকল! তোমাদের প্রতিপালক এক, তোমাদের পিতা এক। শোনো! আরবীর উপর অনারবীর এবং অনারবীর উপর আরবীর, কৃষ্ণকায়ের উপর শ্বেতকায়ের এবং শ্বেতকায়ের উপর কৃষ্ণকায়ের কোন শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা নেই। শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা আছে তো কেবল ’তাক্বওয়া’র ভিত্তিতেই,” (মুসনাদে আহমদ) আরও অনেক।

ইসলামের পরিবর্তনমূলক বিকল্প

ইসলাম সামাজিক সংহতি, একতা দেশপ্রেম এবং স্বজনপ্রীতি সমর্থন এবং প্রচার করে কিন্তু পক্ষপাতিত্ব বা সত্য-মিথ্যা নির্বিশেষে নিজ পরিবার, দল, দেশ বা সমাজের প্রতি আনুগত্য পালন করার আদেশ দেয়না বরং বলে - “হে ঈমানদারগণ। ন্যায় বিচারের প্রতি দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাও আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে সাক্ষ্য প্রদানকারী অবস্থায়, যদিও তাতে তোমাদের নিজেদের ক্ষতি হয় অথবা মাতাপিতার কিংবা আত্মীয়-স্বজনের; যার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দাও সে বিত্তবান হোক কিংবা বিত্তহীন, সর্বাবস্থায় আল্লাহ্ই সেটার ইখতিয়ার রয়েছে। সুতরাং প্রবৃত্তির অনুগামী হয়োনা যাতে সত্য থেকে আলাদা হয়ে পড়ে; এবং যদি তোমরা হেরফের করো অথবা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে আল্লাহ্র নিকট তোমাদের কর্ম সমূহের খবর রয়েছে।” (সূরা নিসা: ১৩৫ - আয়াতটির একটি অংশ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি অফ ল (আইন স্কুল) প্রবেশ পথের দেয়ালে লাগানো হয়) ইসলাম বিচার, সত্যের পক্ষে এবং অত্যাচার ও মিথ্যার বিরুদ্ধে। সত্য মিথ্যার মধ্যে কোনো প্রতিরোধমূলক সীমা দাঁড়াতে পারেনা - কি সর্বজনীন ন্যায়বিচার!

আরব সমাজে প্রচলিত আসাবিয়্যাহ বর্তমানে এই সব নামে বলা যেতে পারে যদিও তা রক্ত ও গোত্র কেন্দ্রিক ছিল। নবী স্পষ্টভাবে তা অস্বীকার করেছেন। ওয়াসিলাহ ইবনুল আসকা’ (রাঃ)-এর কন্যা সূত্রে বর্ণিত। তিনি তার পিতাকে বলতে শুনেছেন আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আসাবিয়্যাত (পক্ষপাতিত্ব) কি?’ তিনি বললেনঃ “তুমি তোমার কওমকে অত্যাচার করার জন্য সহযোগিতা করলে।” (সুনান আবূ দাউদ) জুবায়র ইবন মুতঈম (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ “সে ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয় যে আসাবিয়ার আহ্বান দেয়, সে ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয় যে আসাবিয়ার কারণে যুদ্ধ (লড়াই) করে, সে ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয় যে আসাবিয়ায় (পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে) মারা যায়।” (সুনান আবূ দাউদ)

আত্ম-অহংকার, ঘৃণা, হিংসা, ঈর্ষায় গঠিত আসাবিয়া নির্মূল করে অন্য বিকল্পে নবী সেই সমাজকে এক নব জীবন বিধান প্রদান করেন যা সার্বজনীন - ইয়ায ইবনে হিমার (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, “মহান আল্লাহ আমাকে প্রত্যাদেশ করেছেন যে, তোমরা পরস্পরের প্রতি নম্রতা ও বিনয় ভাব প্রদর্শন কর। যাতে কেউ যেন অন্যের প্রতি অত্যাচার না করতে পারে এবং কেউ কারো সামনে গর্ব প্রকাশ না করে।” (মুসলিম)

তবুও ইটা সামাজিক বাস্তবতা যে ভাষার, সংঙ্কারের, জাতির বিভিন্নতা বিদ্যমান। কিন্তু এই বিভিন্নতা বিভাজনের জন্য নয় বরং সহযোগিতা, পারস্পরিক বোঝাপড়া, সৌহার্দ্য এবং সহিংসতা নির্মাণের জন্য। আল্লাহ বলেন: “হে মানবকুল। আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে শাখা-প্রশাখা-ও গোত্র-গোত্র করেছি, যাতে পরস্পরের মধ্যে পরিচয় রাখতে পারো। নিশ্চয় আল্লাহ এর নিকট তোমাদের মধ্যে অধিক সম্মানিত সে-ই, যে তোমাদের মধ্যে অধিক খোদাভীরু। নিশ্চয় আল্লাহ জানেন, খবর রাখেন।” (সূরা আল-হুজারাত, আয়াত ১৩)

অবশেষে, সার্বজনীন কাঠামোর ওপর নির্মিত নবীও শিক্ষায় ইসলামের উম্মতি দৃষ্টিভঙ্গিকে কার্যকরীভাবে প্রদর্শন করা বিশেষ করে বিভক্ত মুসলিম সমাজের একটি সাময়িক প্রয়োজনীতা।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter