মুসলিম সাহিত্যক হিসেবে কাজী নজরুল ইসলামের অবদান

 মানুষের মধ্যে এখনো রয়েগেছে আমাদের কবি কাজী নজরুল ইসলাম।  আমরা হয়তো বাল্যকাল থেকেই পড়ি আসছি তিনার উত্তেজিত কবিতা অসহায় মানুষের উপর ব্রিটিশ সরকারের চরম অত্যাচার এর বিরুদ্ধে ও তিনার জীবন কাহিনী । তিনি শুধু কেবল সমাজের উপর তিনার কবিতা প্রকাশ করেননি বরং  ইসলামেও  তিনার অসংখ্য অবদান রয়েছে যে গুলো  প্রায় আজ মুসলিম সমাজ ভুলতে চলেছে। এই নিবন্ধতে ইসলামের প্রতি তিনার যে কবিতার অবদান রয়েছে 

 সেগুলো তুলে ধরা হয়েছে।  তার  পূর্বে  তিনার সংক্ষিপ্ত জীবনী  আলোচনা করা হলো। 

জন্ম প্রাথমিক জীবন

১৮৯৯  খ্রিষ্টাব্দে ২৪ মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন।  তার বাবা ফকির আহমদ ছিলেন স্থানীয় মসজিদের এমাম এবং মাজারের কাশেম। নজরুলের তিন ভাইয়ের মধ্যে কনিষ্ঠ কাজী আলী হোসেন এবং দুই বোনের মধ্যে সবার বড় কাজী সাহেবজান ও কনিষ্ঠ উম্মে কুলসুম। নজরুল গ্রামের স্থানীয় মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ করেন।   কুরআন, ইসলাম ধর্ম, দর্শন এবং ইসলামী ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন শুরু করেন। ১৯০৮ সালে তার পিতার মৃত্যু হয়, তখন তার বয়স মাত্র নয় বছর। পিতার মৃত্যুর পর পারিবারিক অভাব-এর কারণে তার শিক্ষাজীবন বাধাগ্রস্ত হয় এবং মাত্র দশ বছর বয়সে জীবিকা অর্জনের জন্য কাজে নামতে হয় তাক। এই ভাবে তিনার পড়াশোনা চলতে থাকে। বাল্যকালে    লেটো (বাংলার রাঢ় অঞ্চলের কবিতা, গান ও নৃত্যের মিশ্র আঙ্গিক চর্চার ভ্রাম্যমাণ নাট্যদল) যোগ দেন।  কিন্তু তিনি ১৯১০ সালে লেটো দোল ছেড়ে ছাত্র জীবন এ ফিরে আসেন।  তার এর নতুন ছাত্র জীবনে প্রথম স্কুল ছিল রাণীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ্ স্কুল, এর পর তিনি ভর্তি হন মাথরুন উচ্চ ইংরেজি স্কুলে যা পরবর্তীতে নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউশন নাম পরিচিত লাভ করে।  অভাবের কারণে তিনার পড়াশোনা ঠিক মতো করতে পারেনি ........।

  কাজী নুজরুল ইসলাম যে ভাবে সমাজ কে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সবাইকে জাগরণ করেছেন তেমনি ইসলামী ভাবধারার মর্মমূলে জাতিকে দাঁড় করতে চেয়েছেন সর্বাধিক।  তিনার কবিতার মধ্যে অসংখ্য কবিতায় ইসলামী চেতনা ও ঐতিহ্যের পাওয়া যাই।  কাজী নুজরুল ইসলাম মুসলিম জাতির জন্য অসংখ্য কবিতা, ইসলামী গজল, হামদ, নাত গেয়েছেন ।

 

 জিঞ্জীরকাব্যের একটি উল্লেখযোগ্য কবিতা হলঈদ মোবারকযেখানে তিনি মুলসিম সাম্যের জয়গান গেয়েছেন  তিনি বলেন

(ইসলামে বলে, সকলের তরে মোরা সবাই,

সুখ দুখ সম-ভাগ রে নেব সকলে ভাই)

 

ইসলাম কখনো বড়-ছোট , ধোনি -গরীবের মধ্যে কোনো রকমের ব্যবধান করেনা, বরং ছোট - বড়র মধ্যে সমান ও সহাবস্থান সৃষ্টি করে।  তিনি আরো বলেন

(আজি ইসলামী-ডঙ্কা গরজে ভরিজাহান,

নাহি বড় ছোট-সকল মানুষ এক সমান)

ঈদ মুসলিমদের জন্য একটি বড় উৎসব এবং আত্মর মিলন।  এই ঈদে ধোনি গরিব সকলের আনন্দ করার অধিকার রয়েছে।

 

তিনি যাকাত এর সম্পর্কে বলেছেন :-

(বুক খালি রে আপনারে সাজ দাও যাকাত,

রো না হিসাবী, আজি হিসাবের অঙ্কপাত!)

 

মুসলমানদের মুনাফেকী চরিত্র দেখে নজরুল আক্ষেপ করে বলেছিলেন,

‘‘খালেদ!খালেদ! সবার অধম মরা হিন্দুস্তানী,

হিন্দু না মোরা মুসলিম তাহা নিজেরাই নাহি জানি!

সকলের শেষে হামাগুড়ি দিই,-না, না, সে সে শুধু

মুনাজাত রি, চোখের সুমুখে নিরাশ সাহারা ধূ ধূ!

দাঁড়ায়ে নামাজ ড়িতে পারিনা, কোমর গিয়াছে টুটি,

সিজদা করিতেবাবাগোবলিয়া ধূলিতলে পড়ি লুটি’!

পিছন ফিরিয়া দেখি লাল-মুখ আজরাইলের ভাই,

আল্লা ভুলিয়া বলি, ‘‘প্রভু মোর তুমি ছাড়া কেউ নাই’’

মহান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা বিশ্বাস রেখে নিঃশঙ্কচিত্তে নজরুল গেয়েছেন,

আল্লাহ আমার প্রভু, আমার নাহি নাহি ভয়

আমার নবী মোহাম্মদ; যাঁহার তারিফ জগৎময়।।

আমার কিসের শঙ্কা,

কোরআন আমার ডঙ্কা,

ইসলাম আমার ধর্ম, মুসলিম আমার পরিচয়।।

আলাহু আকবরধ্বনি

আমার জিহাদ-বাণী।।

 

অলস মুসলিম জাতির হীনমন্যতা, আন্তঃকলহ সঠিক আক্বীদা-আমল থেকে বিচ্যূত হয়ে শিরক-বিদআতে লিপ্ত হওয়ার অদ্ভুত মহড়া দেখে ব্যথিত কবি তাই লেখেনখালেদশিরোনামে এক বিশাল কবিতা এই কবিতায় তিনি লিখেছেন,

 

তাওহীদের হায় চির সেবক —  ভুলিয়া গিয়াছো সে তাকবীর

দূর্গা নামের কাছাকাছি প্রায়দরগায় গিয়া লুটাও শীর

ওদের যেমন রাম নারায়ণমোদের তেমন মানিক পীর

ওদের চাউল কলার সাথেমিশিয়া গিয়াছে মোদের ক্ষীর

ওদের শিব শিবানির সাথেআলী ফাতেমার মিতালী বেশ

হাসানরে করিয়াছি কার্তীক আরহোসেনরে করিয়াছি গজ গনেশ

বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছেআমরা তখনও বসে,

বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজেছিফেকা হাদিস চষে!

হানাফী ওহাবী লা-মজহাবীরতখনো মেটেনি গোল,

এমন সময় আজাজিল এসেহাঁকিলতলপী তোল’!

ভিতরের দিকে যত মরিয়াছি  — বাহিরের দিকে তত

গুনতিতে মোরা বাড়িয়া চলেছিগরু ছাগলের মত!

 

নজরুল পবিত্র কালামের মাহাত্ম্য বর্ণনা করে এর ফযীলতের কথা স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যেমন-

কালেমা শাহাদতে আছে খোদার জ্যোতি

ঝিনুকের বুকে লুকিয়ে থাকে যেমন মোতি।।

কলেমা জপে যে ঘুমের আগে,

কলেমা জপিয়া যে প্রভাতে জাগে,

দুখের সংসার সুখময় হয় তার-

মুসিবত আসে না কো, হয় না ক্ষতি।।

 

মানুষকে যাকাত প্রদানে উৎসাহ দিয়ে ইসলামী রেনেসাঁর কবি নজরুল বলেছেন-

দে জাকাত দে জাকাত, তোরা দে রে জাকাত

তোর দিল্ খুলবে পরে, অরে আগে খুলুক হাত।।

দেখ পাক কোরআন, শোন নবীজীর ফরমান

ভোগের তরে আসেনি দুনিয়ায় মুসলমান

তোর একার তরে দেননি খোদা দৌলতের খেলাত্।।

তোর দর-দালানে কাঁদে ভুখা হাজারো মুসলিম,

আছে দৌলতের তোর তাদেরও ভাগ-বলেছেন রহীম

বলেছেন রহমানুর রহীম, বলেছেন রসুলে করীম,

 

মুসলিম উম্মাহ্ আজ বিভিন্ন দল, মত, ইজম, মতবাদে ক্ষত-বিক্ষত মুখে মুখে আল্লাহর আধিপত্য স্বীকার করলেও তারা ইসলামের রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধারণ না করে ইসলাম থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছে আজ আজ মুসলিম জাতি রজ্জু ধরেছে আমেরিকার, রাশিয়ার, ব্রিটেনের, কেউ আবার রজ্জু ধরেছে তন্ত্র-মন্ত্র কিংবা মানব রচিত বস্তাপঁচা গলিত মতবাদসমূহকে ফলে তারা পরিণত হয়েছে এক দুর্দশাগ্রস্ত জাতিতে তাই কবি দুঃখ করে বলেছেন-

জাগে না সে জোশ য়ে আর মুসলমান

করিল জয় যে তেজ লয়ে দুনিয়া জাহান।।

নাহি সাচ্চাই সিদ্দিকের,

উমরের নাহি সে ত্যাগ আর,

নাহি সে বেলালের ঈমান,

নাহি আলীর জুলফিকর,

নাহি আর সে জেহাদ লাগি বীর শহীদান।।

নাহি আর বাজুতে কুওত্,

নাহি খালেদ মুসা তারেক,

নাহি বাদশাহী তখত্ তাউস

ফকির আজ দুনিয়ার মালেক,

ইসলাম কেতাবে শুধু, মুসলিম গোরস্থান।।

 

মুসলিম জাতি আজ ঘুমিয়ে আছে সুপ্ত পুষ্প কুঁড়ির মত এখন সময় তার জেগে ওঠার প্রবল ইচ্ছাশক্তির টানে নজরুল আহবান জানিয়েছেন পিছিয়ে পড়া শেষের বেঞ্চের মুসলিমদেরকে তিনি বলেন-

আনো আলীর শৌর্য, হোসেনের ত্যাগ,

ওমরের মতো কর্মানুরাগ,

খালেদের মতো সব অসান্য

ভেঙে করো একাকার।।

ইসলামে নাই ছোট বড় আর

আশরাফ আতরাফ,

এই ভেদ জ্ঞান নিষ্ঠুর হাতে

করো মিসমার সাফ

চাকর সৃজিতে চাকুরী করিতে

ইসলাম আসে নাই পৃথিবীতে?

মরিবে ক্ষুধায় কেহ নিরন্ন,

কারো ঘরে রবে অঢেল অন্ন-

জুলুম সহে নি ইসলাম,

সহিবে না আজও আর।।

 

অনুরূপভাবে মৌলভী তরিকুল আলম কাগজে এক প্রবন্ধ লিখে বললেন কুরবানীতে অকারণে পশু হত্যা করা হয়, এমন ভয়াবহ রক্তপাতের কোন মানে নাই নজরুল তার জওয়াবে লিখলেনকোরবানীকবিতা তাতে তিনি বললেন-

ওরে, হত্যা নয়, সত্যগ্রহ শক্তির উদ্বোধন,

দুর্বল ভীরু চুপ রহো, ওহো খামখা ক্ষুদ্ধ মন

এই দিনই মীনা ময়দানে

পুত্র স্নেহের গর্দানে

ছুরি হেনে খুন ক্ষরিয়ে নে

রেখেছে আববা ইবরাহীম সে আপনা রুদ্র পণ,

ছি,ছি, কেঁপো না ক্ষুদ্র মন

 

ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ এলো রে দুনিয়ায়, এই কবিতাটি আজ প্রায় মুসলমানগণ গেয়ে থাকেন   আজ আমরা কাজী নুজরুল ইসলামের লেখা মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম এর উপর  একটি কবিতা শুনে থাকি যেটি আমাদের মন কে মোহাম্মদ এর প্রতি ভালোবাসার আহ্বান জানায় কবিতা টি হলো :

ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ

এলো রে দুনিয়ায়

আয় রে সাগর আকাশ বাতাস, দেখবি যদি আয়।।

ধূলির ধরা বেহেশ্তে আজ,

জয় করিল দিলরে লাজ;

আজকে খুশির ঢল নেমেছে ধূসর সাহারায়।।

দেখ্ আমিনা মায়ের কোলে

দোলে শিশু ইসলাম দোলে,

কচি মুখে শাহাদাতের বাণী সে শোনায়।।

আজকে যত পাপী তাপী

সব গুনাহের পেল মাফী,

দুনিয়া হতে বে-ইনসাফী

জুলুম নিল বিদায়।।

 

কাজী নুজরুল ইসলামের লেখা আর একটি কবিতা "মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই"  এই কবিতাটি নজরুল তিনার মুনের ইচ্ছা কে প্রকাশ করেছেন যেন মৃত্যুর পর তিনার কবর মসজিদ এর পাশে হয় যাতে কবর থেকে কোরানের সেই পবিত্র কালাম শুনতে পায়  

 

মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই

যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।।

আমার গোরের পাশ দিয়ে ভাই নামাজীরা যাবে,

পবিত্র সেই পায়ের ধ্বনি বান্দা শুনতে পাবে

গোর-আজাব থেকে গুনাহগার পাইবে রেহাই।।

কত পরহেজগার খোদার ভক্ত নবীজীর উম্মত

মসজিদে করে রে ভাই, কোরান তেলাওয়াত

সেই কোরান শুনে যেন আমি পরান জুড়াই।।

(Samiurl Islam is a Research Scholar at Darul Huda Islamic University, Kerala)

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter