এডওয়ার্ড সাঈদ এর জীবন ও তার বই পর্যলোচনা

ভূমিকা: - 

এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদের জন্ম ১৯৩৫ সালে, ফিলিস্তিনের জেরুজালেমে এক এপিসকোপ্যালিয়ান খ্রিস্টান পরিবারে হয়। ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর উদ্বাস্তুর নিয়তি মেনে কিশোর বয়সে পরিবারের সাথে চলে যান মিশরে। কিছুকাল কায়রোর ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। ওখানে মাউন্ট হারমান স্কুল প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি এবং হাভার্ড ইউনিভার্সিটিতে পাঠ শেষে ১৯৬৩ সালের যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। ওখানেই আজীবন ইংরেজি তুলনামূলক সাহিত্য পড়িয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইংল্যান্ডের বহু বিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসরের দায়িত্ব পালন করেন

ফিলিস্তিনি মুক্তি আন্দোলনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন সাঈদ ১৯৭৭ সালে প্রবাসী ফিলিস্তিন পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হয়ে প্রায় ১৪ বছর ধরে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১ সালে ইসরাইল- ফিলিস্তিন চুক্তি সংক্রান্ত - মতবিরোধে পদত্যাগ করেন তিনি।

এডওয়ার্ড সাঈদ সম্পর্কে কিছু তথ্য:- 

গত শতকের অস্থির, দ্রুত পরিবর্তনমুখী বুদ্ধিবৃত্তিক আবহে এডওয়ার্ড সাঈদ ছিলেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টিশীল চিন্তাবিদদের একজন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রভাবশালী সমর্থক ছিলেন যিনি ফিলিস্তিনিদের রাজনৈতিক অধিকার এবং স্বাধীনতার জন্য প্রচারণা চালিয়েছিলেন। তিনি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে ছিলেন। তাকে ফিলিস্তিনিদের জন্যসবচেয়ে শক্তিশালী কণ্ঠস্বর বলা হত।

প্রধান কাজ :-  যে কাজের জন্য তিনি সবচেয়ে পরিচিত সেটি হল ১৯৭৮ সালের প্রকাশিতঅরিয়েন্টালিজম এই একটি গন্থের জন্য সাঈদ অমর হয়ে থাকবেন এখন পর্যন্ত গ্রন্থটি মানববিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তার গভীরতর প্রভাব অব্যাহত রেখেছে। গ্রন্থে সাঈদ অঙ্গীকার করেন মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোর ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর রাজনৈতিক, সামাজিক, নৃ-তাত্ত্বিক, আর্থিক আধিপত্যের সাংস্কৃতিক প্রস্তুতি প্রতিফলন- প্রাচ্যের ওই অঞ্চলের ওপর পশ্চিমের কর্তৃত্বের আরোপণ।

ওই কর্তৃত্বের বা আধিপত্যের পেছনে কার্যকর সাংস্কৃতিক মনোভঙ্গি ব্যাখ্যা করার জন্য সাঈদ ব্যবহার করেনঅরিয়েন্টালিজমবাপাচ্যতত্বপরিভাষাটি, “প্রাচ্যতত্ত্বব্যাখ্যা করতে গিয়ে সাঈদ বলেন, প্রাচ্য হল পশ্চিমের জ্ঞানজগতের নির্মাণ ; পশ্চিমের কাছে প্রাচ্য ছিল দূর অজানা।  প্রাচ্য”-বাস্তব প্রাচ্য নয় পশ্চিমের সৃষ্টি মাত্র।

তার লিখিত বইগুলির সারসংক্ষেপ :-

অরিয়েন্টালিজম” - এমন এক রচনা, যা প্রাচ্য পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক - রাজনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ক চিন্তার প্রেক্ষিত অভিমুখ চিরতরে পাল্টে দিয়েছে। 

অন্যদিকে তার স্রষ্টাকে পরিণত করেছে কিংবদন্তিতুল্য মানুষে। পশ্চিমের আধিপত্যবাদী জ্ঞান সংস্কৃতি যখন সারা পৃথিবীতে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত, তখন,অরেন্টালিজম এক ধীরগতির বিস্ফোরণ, যা আক্রান্ত করেছে সেই আধিপত্যের মূল প্রক্রিয়া কৌশলসমূহকে। ইউরোপ আমেরিকান শক্তি প্রাচ্যের মানুষের মন, আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি সাংস্কৃতিক স্বভাবের ওপরও আধিপত্য করেছে নিজেদের ইচ্ছেমতো রূপান্তরিত, বিকৃত পরিবর্তন করেছে তাদের মনোজগৎ এবং বাইরের ইমেজকে - তা জানার জন্যঅরিয়েন্টালেজামএর বিকল্প নেই।

সাঈদের দৃঢ় চুক্তি সহ বক্তব্য, তীক্ষ্ণ নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ, ক্ষমতা সংস্কৃতির সম্পর্ককে যথাযথভাবে শনাক্ত করণের সক্ষমতাঅরিয়েন্টালিজমকে পরিণত করেছে আধিপত্য সংস্কৃতির তাত্ত্বিক আলোচনার অনিবার্যে আদর্শে।

বিশ শতকের আধিপত্যের রাজনীতির সর্বগ্রাসী ছায়ায় আড়ষ্ট পৃথিবীতে বহুদিকগামী বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করেন সাঈদ। একাধারে সাহিত্য সমালোচনা, সংস্কৃতি,সমাজতত্ত্ব, সংগীত,রাজনীতি - সমস্ত বিষয়ে লিখেছেন। কুড়িটির বেশি প্রকাশিত গ্রন্থে অভিব্যক্ত তার ভাবনায় ক্ষমতা আধিপত্যের নানার দিকের প্রতিভাস মেলে। তা রচিত গ্রন্থগুলো হল :- “জোসেফ কনরাড অ্যান্ড দ্য ফিকশন অফ অটোবায়োগ্রাফি” “বিগিনিংস; ইনটেশন অ্যান্ড মেথডস; “অরিয়েন্টালিজমরিঅ্যাকশন অ্যান্ড কাউন্টার রেভ্যুলিউশন ইন দা কনটেম্পোরারি আরাব ওয়ার্ল্ডদ্য কোশ্চেন  অব প্যালেস্টাইনলিটারেচার অ্যান্ড দ্য সোসাইটিকভারিং ইসলাম; “দ্য টেক্সট এন্ড দ্য ক্রিটিক” “আফটার দা লাস্ট স্কাই; স্পারিয়াস স্কলার্শিপ অ্যান্ড দ্য  প্যালেস্টাইনিয়ান কোশ্চেন; “ কালচার অ্যান্ড ইম্পোরিয়ালিজম”  “দ্য স্ট্যাগল ফর প্যালেস্টাইনিয়ান সেলফ ডিটারমিনেশন ক্রিটিসিজম বিটুইন কালচার অ্যান্ড সিস্টেম” “আউট অব প্লেসইত্যাদি।

জোসেফ কনরাড অ্যান্ড দ্য ফিকশন অফ অটোবায়োগ্রাফি দি ওয়ার্ল্ড দ্য টেক্সট অ্যান্ড দ্য ক্তিটিকএবং  “মিউজিক্যাল ইলাবোরেশনক্ষমতার রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষত সংশ্লিষ্ট নয়। অনেকগুলো সরাসরি ইসরাইলি দখলদারী এবং ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে সম্পর্কযুক্ত। প্রচলিত সাহিত্য সমালোচনার কার্যকারিতা এবং টেক্সটের পরিপ্রেক্ষিত- বিষয়ক প্রশ্নে সাঈদীর গুরুত্বপূর্ণ রচনাদা ওয়ার্ল্ড” “দ্য টেক্সট এন্ড দা ক্রিটিকপ্রকাশিত হয় ১৯৭৯ সালে। এতে সাহিত্য সমালোচনায় অন্যতর চিন্তাভঙ্গির প্রস্তাবনা পণ্ডিতদের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে, সাঈদের মতে, টেক্সট বা রচনা গণসংশ্লিষ্ট একটি জিনিস।

১৯৮০ সালে প্রকাশিত দ্য কোশ্চেন অফ প্যালেস্টাইনআমাদের সময়ের সবচেয়ে তীব্র রক্তক্ষয়ী আন্তর্জাতিক সংঘাতের রাজনীতির ওপর আলোকপাত। ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কারণে দেশচ্যুত, রাষ্ট্রচ্যুত ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার জীবন্ত চিত্র এই গ্রন্থটি। লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনে আজ ছড়িয়ে আছে সারা পৃথিবীতে। তাদের দেশ নেই, ভোট নেই, নাগরিক অধিকার নেই, এডওয়ার্ড সাঈদ প্রশ্ন রাখেন, এসব ফিলিস্তিনির দায় নেবে কে ?

আফটার দা লাস্ট স্কাই ১৯৮৬ সাঈদীর তীব্র রাজনীতি সচেতন রচনা। মূলভাবগত অর্থে এটাদ্য কোশ্চেন অব প্যালেস্টাইনএরই   বিস্তৃতি। এখানে সাঈদ খুঁজে দেখেছেন সমকালে একজন ফিলিস্তিনি হওয়ার অর্থ কি, একজন ফিলিস্তিনি হিসেবে কি পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় তাকে সাঈদ বলেন, পশ্চিমে এমন একটি দিনও পার হয় না যেদিন ফিলিস্তিনিরা প্রধান প্রধান সংবাদে অন্তর্ভুক্ত থাকে না কিন্তু প্রচার মাধ্যমে তাদের যে ইমেজ সৃষ্টি করেছে, সাঈদ দেখান তা খুনি সন্ত্রাসী অপহরণকারী অথবা সর্বহারা শরণার্থীর। ফিলিস্তিনারা আজ পশ্চিমা প্রচারমাধ্যমের ওই কৃত্রিম, জঘন্য রাজনৈতিক ইমেজে বন্দি। ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কারণে ফিলিস্তিনিরা কিভাবে তাদের দেশ হারিয়েছে, ঘরবাড়ি হারিয়েছে উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছেসেই মর্মান্তিক বিবরণ দেন এডওয়ার্ড সাঈদ

দ্যা পলিটিক্স অফ ডিসপজিশন: দ্য স্টাগল ফর ক্লাস প্যালেস্টাইনিয়ান সেলফ ডিটারমিনেশন ১৯৯৪ ফিলিস্তিন সমস্যার ওপর লিখিত প্রবন্ধের সংকলন এতে ১৯৬৯ সাল থেকে 1994 পর্যন্ত ফিলিস্তিনিদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রক্তাক্ত স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাবিবরণী তুলে ধরেছেন সাঈদ। ১৯৯৪ সালে ইসরাইলের সাথে সম্পাদিত শান্তিচুক্তি আলোচনায় এসেছে, যাকে সাঈদ অন্যত অভিহিত করেছেনশান্তি প্রচেষ্টার সমাপ্তিহিসেবে।

কভারিং ইসলাম:- এর প্রথম প্রকাশ ১৯৮১ সালে।অরিয়েন্টালিজামলিখে সাঈদ প্রাচ্যতাত্ত্বিক বুদ্ধি জীবীবৃত্তে ধস নামিয়েছিলেন, সৃষ্টি করেছিলেন অসংখ্যা - বুদ্ধি ভিত্তিক শত্রু।কভারিং ইসলাম তিনি পশ্চিমা প্রচারমাধ্যমের সাম্রাজ্যবাদী সম্প্রদায়িক রূপটি উন্মোচন করেন। যা হোক কভারিং ইসলাম সাঈদ প্রতিদিনের সংবাদ পরিবেশন, ফিচার,প্রবন্ধ, নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার ঘেঁটে দেখান পশ্চিমের প্রচারমাধ্যমে দীর্ঘদিনে ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মুসলমানদের খুনি সন্ত্রাসী অপহরণকারী হিসেবে চিত্রিত করে আসছে।

রিপ্রেজেন্টেশন অফ দা ইন্টেলেকচুয়াল:- ১৯৯৪  সাঈদের আরেকটি উল্লেখযোগ্য রচনা। সারা পৃথিবীর জনগোষ্ঠীর এক বিরাট অংশ যখন তথ্য ব্যবস্থায় জড়িত অথবা সংশ্লিষ্ট, তখন বুদ্ধিজীবী পরিভাষাটি কি অর্থ বহন করে, কারা বুদ্ধিজীবী, কি তার চরিত্র,কীতার দায়িত্ব - এসব প্রশ্নের জবাব সন্ধান করা হয়েছে আলোচ্য গ্রন্থে। রিপ্রেজেন্টেশন অফ দা ইন্টেলেকচুয়াল আমাদের বুদ্ধিভিত্তিক জগতে এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন।

কালচার এন্ড ইম্পেরিয়ালিজম ১৯৯৩  গ্রন্থে সাঈদের চিন্তা প্রথা চর্চার সীমানা পেরিয়ে পশ্চিমে সংস্কৃতির এমন এক দিক উন্মোচিত করে, যার সাথে সম্পর্কিত আধিপত্য,দমন ক্ষমতা রাজনীতি। ইউরোপীয় এবং সামগ্রিকভাবে পশ্চিমের সংস্কৃতির ইতিহাসের অনেক পেছনে আধিপত্যবাদী চিন্তা ভাবনার প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। কালচার অ্যান্ড  ইম্পেরিয়ালিজম, তিনি দৃষ্টি ইঙ্গিত দেন যে পৃথিবীর সকল প্রাক্তন উপনিবেশে যেখানে ঔপনিবেশিক শক্তি কখনো না কখনো তাদের সাম্রাজ্যবাদী আগ্যাসন চালিয়েছিল। এর মধ্যে আছে,আফ্রিকা, পাক - ভারত উপমহাদেশ, দূর প্যাচের অংশবিশেষ - অস্ট্রেলিয়া ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের বিভিন্ন দেশ।

মৃত্যু :-

এক পুত্র এক কন্যাসন্তানের পিতা সাঈদ এডওয়ার্ড  প্রায় এক যুগ ধরে ব্লাড ক্যান্সারে ভুগছিলেন। গত ২৪ শে সেপ্টেম্বরে ২০০৩ সালে আমেরিকার এক হাসপাতালে চিকিৎস্বাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন এই মহান মানুষটি। তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত সর্বশেষ গ্রন্থ ফর্ম আসলো টু ইরাক অ্যান্ড দ্য রেডম্যাপ ২০০৪ এর সংকলিত ৪৬ টি অসাধারণ নিবন্ধে সাঈদ মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে আমেরিকা ইসরাইলের তৎপরতা সম্পর্কে এমন সব তথ্য প্রকাশ করেছেন যেগুলো কোনো দিন মার্কিন প্রচার মাধ্যমের মুখ দেখেনি।

উপসংহার :-

এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদ ছিলেন পন্ডিত, নন্দনতাত্ত্বিক সমালোচকের এক বিরল মেধাবী সংশ্লেষ। সাংস্কৃতিক আত্মানুসন্ধানে নিয়ত উন্মুখে নতুন প্রজন্মের কাছে তিনি প্রেরণা আদর্শ। সাঈদ পশ্চিমের বুদ্ধিভিত্তিক জগতের সকল ক্ষেত্রেই প্রভাব বিস্তার করে গেছেন। ক্ষমতা কর্তৃত্বের কাছে তিনি কোনো দায় অনুভব করেননি, তার দায় ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক চৈতন্যের নিকটযা তিনি নিজেই  চিহ্নিত করেছেন। মধ্যপ্রাচ্য ইসলামী দেশগুলোর জনগোষ্ঠীর পক্ষে কথা বলার কারণে তাকে কম দুর্ভোগ পোহাতে হয়নি তবুও মানবতা ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রশ্নে তার ছিল সক্রিয় ভূমিকা প্রথা প্রতিষ্ঠান বিরোধী ক্ষমতাবিরোধী এমন সৃষ্টিশীল মানুষের জন্য নোবেল পুরস্কার অপেক্ষা করার কথা নয় তার প্রয়োজনও ছিল না, এডওয়ার্ড সাইড ক্ষমতা কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে জাগ্রত করে গেছেন আমাদের চৈতন্যকে।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter