খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)-এর প্রশাসনিক সংস্কার ও ন্যায়বিচার
ভূমিকা:
মানব-সভ্যতার ইতিহাসে এমত বহু মহান ব্যক্তিত্ব রহিয়াছেন, যাঁহাদের প্রজ্ঞা ও নেতৃত্ব কেবল এক জাতি নহে, বরঞ্চ সমগ্র বসুধার নিমিত্ত শিক্ষণীয় হইয়া উঠিয়াছে। তাঁহাদের শীর্ষাসনে অধিষ্ঠিত রহিয়াছেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা, হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)। তাঁর খিলাফত-কাল (৬৩৪-৬৪৪ খ্রিঃ) ছিল এক অবিস্মরণীয় যুগ, যখন মুসলিম উম্মাহ কেবল রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক দিগন্তেই নহে, বরং সামাজিক 'আদল' (ন্যায়), অর্থনৈতিক স্থিতি এবং প্রশাসনিক নিযামের (সংস্কার) ক্ষেত্রেও এক নবতর উচ্চতায় আসীন হইয়াছিল। অধুনা-যুগের প্রশাসন ও বিচার-ব্যবস্থায় যে সকল মূলনীতি অনুসৃত হইয়া থাকে, উহার বহুলাংশের ভিত্তিমূল আমরা উমর (রাঃ)-এর পুণ্যময় শাসনকালেই সন্দর্শন করিতে পারি।
পরিচয়:
উমর ইবনুল খাত্তাব (৫৮৪–৬৪৪ খ্রিঃ) ছিলেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ও আস্-সাবিকুন (প্রথম) সাহাবীগণের অন্যতম। আবূ বকরের (রাঃ) ইন্তেকালের পর তিনি দ্বিতীয় খলিফা রূপে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েন। উমর (রাঃ) ইসলামি শরিয়াহ ও আইনের একজন প্রাজ্ঞ ফকীহ্ (আইনজ্ঞ) ছিলেন। হক (সত্য) ও বাতিলের (মিথ্যা) মধ্যে সুস্পষ্ট পক্ষাবলম্বন করিবার কারণে তাঁহকে 'ফারুক' (আরবি: الفاروق; সত্য-মিথ্যার প্রভেদকারী) উপাধি প্রদান করা হয়। 'আমিরুল মুমিনীন' উপাধিটি সর্বপ্রথম তাঁর ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হইয়াছে। ইতিহাসে তাঁহাকে 'প্রথম উমর' রূপেও উল্লেখ করা হইয়া থাকে। নামের সামঞ্জস্যবশত, পরবর্তী কালের উমাইয়া খলিফা উমর বিন আব্দিল আযীযকে 'দ্বিতীয় উমর' বলিয়া সম্বোধন করা হয়। সাহাবীগণের মর্যাদার মাপকাঠিতে, আহলে সুন্নাতের নিকট আবূ বকর (রাঃ)-এর পরেই উমর (রাঃ)-এর স্থান। (শিয়া সম্প্রদায় উমরের এই সমুচ্চ অবস্থান স্বীকার করেন না)। তদুপরি, তিনি ছিলেন ইসলামের নবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর শ্বশুর। উমর (রাঃ)-এর কন্যা হাফছাহ বিন্ত উমর (রাঃ) ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আহলিয়া (স্ত্রী)।
উমর (রাঃ)-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী:
উমর (রাঃ) ৫৮৩ খ্রিস্টাব্দে কুরাইশ গোত্রে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। ইসলামের প্রাথমিক যুগে তিনি দ্বীন-গ্রহণে কিঞ্চিৎ অনীহা প্রকাশ করিয়াছিলেন, কিন্তু আল-কুরআনের অমোঘ বাণী এবং মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর অনুপম ব্যক্তিত্ব তাঁহাকে ইসলাম গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে। ইসলাম কবুলের পর তিনি মুসলিম উম্মাহর অন্যতম শক্তিশালী স্তম্ভে পরিণত হয়েন। তাঁর অটল ব্যক্তিত্ব, ইস্পাত-কঠিন ন্যায়পরায়ণতা, শৌর্য এবং দূরদর্শী প্রজ্ঞা তাঁহাকে নেতৃত্বের যোগ্য করিয়া তুলিয়াছিল। হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর ওফাতের পর মুসলিম জনতা সর্বসম্মতিক্রমে তাঁহাকে খলিফা নিযুক্ত করিল।
ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ ও উমর (রাঃ)-এর অন্তরের পরিবর্তন:
ইসলামের ইতিহাসে হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণের ঘটনাটি এক বিস্ময়কর অধ্যায়। প্রাথমিক যুগে তিনি ছিলেন ইসলামের অন্যতম কঠিনতম দুশমন। ৬১০ খ্রিস্টাব্দে যখন নবী মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর তাওহীদ (একত্ববাদ) ও আদলের দাওয়াত প্রচার আরম্ভ করিলেন, তখন উমর (রাঃ) কুরাইশ গোত্রের ঐক্য রক্ষার নামে ইসলামের বিরোধিতা করিতে লাগিলেন। তাঁর মনে ধারণা ছিল—এই নতুন ধর্ম কুরাইশ সমাজে বিভেদ পয়দা করিতেছে। ফলস্বরূপ, তিনি মুসলিমগণের উপর নির্যাতন চালাইতেন এবং এক পর্যায়ে নবী (সাঃ)-কে কতল (হত্যা) করিবারও পরিকল্পনা করিয়াছিলেন।
তবে আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছায় সেই বিদ্বেষের আগুন একদিন আলোকে পরিণত হইল।
একদিন উমর (রাঃ) রোষে-ক্ষোভে নবী (সাঃ)-কে হত্যা করিবার মানসে নির্গত হইলেন। পথে তাঁর বন্ধু নাইম ইবনু আবদুল্লাহর সহিত সাক্ষাৎ হইল। নাইম তখন গোপনে মুসলমান হইয়াছিলেন। তিনি উমরকে বলিলেন, “তুমি অগ্রে নিজ পরিবারের তত্ত্বাবধান কর, তাহারা তো ইসলাম গ্রহণ করিয়াছে।” এই কথা শুনিয়া উমর ক্রুদ্ধ হইয়া স্বীয় ভগ্নী ফাতিমা ও ভগ্নিপতি সাঈদের গৃহের দিকে রওয়ানা হইলেন।
গৃহের বাহিরে পৌঁছিয়া তিনি শুনিতে পাইলেন, ঘরের ভেতর কেহ কুরআনের আয়াত তিলাওয়াত করিতেছে — তাহা ছিল সূরা ত্বাহা। ক্রোধে তিনি দ্বারদেশে ধাক্কা দিলেন, গৃহে প্রবেশ করিয়া তাঁহাদের উপর রোষ প্রকাশ করিলেন এবং হস্তস্থিত পাণ্ডুলিপি লুকাইয়া ফেলিতে বলিলেন। কিন্তু যখন তাঁর ভগ্নীর চক্ষে আঘাত লাগিল, তখন তাঁর হৃদয়ে এক প্রচণ্ড ঝাঁকুনি লাগিল — ক্রোধের স্থলে গভীর অনুতাপ ও দুর্নিবার কৌতূহল জন্মিয়া গেল।
তিনি শান্ত স্বরে বলিলেন, “আমাকে সেই পাণ্ডুলিপি দেখিতে দাও।” ভগ্নী উত্তর দিলেন, “তুমি অপবিত্র রহিয়াছ; অগ্রে গোসল সমাপন কর, অতঃপর পাঠ করিতে পারিবে।” তিনি নির্দেশ মতো গোসল করিলেন এবং অতঃপর সেই আয়াতসমূহ পাঠ করিতে আরম্ভ করিলেন—
طه ﴿١﴾ مَا أَنزَلْنَا عَلَيْكَ الْقُرْآنَ لِتَشْقَى ﴿٢﴾
“ত্বাহা, আমি তোমার প্রতি কুরআন নাযিল করি নাই তোমাকে ক্লেশ দিবার জন্য...” (সূরা ত্বাহা, ১–২)
এই আয়াতসমূহ তাঁর হৃদয়ে গভীর প্রভাব বিস্তার করিল। তাঁর অন্তরে বোধ হইল, এই বাণী কোনও মানবের কথা নহে; ইহা স্বয়ং আল্লাহর কালাম।
সেই মুহূর্তে উমর (রাঃ)-এর অন্তর পরিবর্তিত হইল। তিনি ছুটিয়া নবী করিম (সাঃ)-এর খিদমতে উপস্থিত হইলেন এবং ঘোষণা করিলেন, “আমি সাক্ষ্য প্রদান করিতেছি, আল্লাহ ব্যতীত আর কোনও উপাস্য নাই, এবং মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর রাসূল।”
ইসলাম গ্রহণের পর তিনি সাহসিকতার সহিত তাঁর নতুন পরিচয় ঘোষণা করিলেন। প্রথমে আবু জাহলকে গিয়া সংবাদ দিলেন, “আমি ইসলাম গ্রহণ করিয়াছি।” অতঃপর মুসলিমগণকে লইয়া প্রকাশ্যে কাবার প্রাঙ্গণে সালাত আদায় করিলেন। সেইদিন নবী (সাঃ) তাঁহাকে উপাধি প্রদান করিলেন — “আল-ফারুক”, অর্থাৎ যিনি সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করেন।
তাঁর ইসলাম গ্রহণে মুসলিমদের রূহানী শক্তি ও মনোবল বহুগুণ বৃদ্ধি পাইল। হযরত আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ) বলিয়াছেন—
"ما زلنا أعزة منذ أسلم عمر"
“উমর ইসলাম গ্রহণ করিবার পর হইতেই আমরা মর্যাদার সহিত বাঁচিতে শিখিয়াছি।”
এই ঘটনাই প্রমাণ করে, আল্লাহ যাহাকে ইচ্ছা করেন, তিনিই তাহার হৃদয়ে হেদায়েতের আলো প্রজ্বলিত করেন। যে ব্যক্তি একসময় ইসলামের শত্রু ছিলেন, তিনিই পরে সেই ধর্মের অন্যতম রক্ষাকবচে পরিণত হইলেন — যাঁহার শাসন আজও ন্যায়, সততা ও মানবতার প্রতীক হইয়া রহিয়াছে।
প্রশাসনিক সংস্কার ও ন্যায়বিচার:
উমর (রাঃ)-এর খিলাফতের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁর প্রশাসনিক সংস্কার ও 'আদল' (ন্যায়বিচার) প্রতিষ্ঠা। তিনি ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে ছিলেন আপসহীন। তিনি বিশ্বাস করিতেন যে, আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান, তিনি খলিফা স্বয়ং হউন বা একজন সাধারণ প্রজা। একদা জনৈক খ্রিস্টান ব্যক্তি তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করিলে, উমর (রাঃ) স্বয়ং আদালতে হাজির হইয়া কাজীর (বিচারক) সম্মুখে দণ্ডায়মান হইলেন। কাজী উমর (রাঃ)-এর পক্ষে কোনও প্রকার পক্ষপাত প্রদর্শন করেন নাই। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, উমর (রাঃ)-এর আমলে ন্যায়বিচার বাস্তবিক অর্থেই প্রতিষ্ঠিত ছিল।
তিনি অতিশয় সতর্ক ছিলেন, যাহাতে শাসনকর্তাগণ (ওয়ালী) জনগণের হক বা অধিকার ক্ষুণ্ণ করিতে না পারে। একদা বাইতুল মাল (রাষ্ট্রীয় কোষাগার) হইতে একটি উট হারাইয়া গেলে তিনি স্বয়ং তাহা খুঁজিতে বাহির হইলেন। তাঁর এই অতুলনীয় ন্যায়পরায়ণতার কারণে সাধারণ প্রজা হইতে আরম্ভ করিয়া শাসক শ্রেণি পর্যন্ত সকলেই আইনের প্রতি আস্থাশীল হইয়া উঠিল। তিনি আদালত ও বিচারব্যবস্থাকে “বিচারকের পূর্ণ স্বতন্ত্রতা” নিশ্চিত করিয়া বিন্যস্ত করিয়াছিলেন—বিচারকগণ খলিফার নিকট হইতেও প্রভাবমুক্ত থাকিতেন।
সামাজিক ন্যায় ও নারীকল্যাণ:
তিনি নারীজাতির অধিকার সংরক্ষণে বিশেষ নজর রাখিতেন—যথা “মহিলাদের ‘মাহর’ সংক্রান্ত সিদ্ধান্তে স্বাধীন মতামত”কে সম্মান করিতেন। বিধবা ও এতিমদের নিমিত্ত স্থায়ী ভাতার ব্যবস্থা করিয়া সমাজে “নারী ও শিশু কল্যাণের ভিত্তি” রচনা করিয়াছিলেন। তদুপরি, তিনি “অভিযুক্তের আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার” সুনিশ্চিত করেন—যাহা আজকের মানবাধিকার ভাবনার সহিত বহুলাংশে সাদৃশ্যপূর্ণ।
দারিদ্র্য বিমোচন ও কল্যাণমূলক নীতি:
উমর (রাঃ)-এর খিলাফত-কালে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হইয়াছিল। তিনি খাদ্য ও বস্ত্রের নিশ্চয়তা প্রদান করিলেন, যাহাতে কেহই অনাহারে না থাকে। ক্ষুধার্ত ও অসহায় মানুষের সাহায্যের জন্য তিনি নিজ হস্তে খাদ্য বহন করিতেন। এমনকি দুর্ভিক্ষের সময় তিনি স্বীয় জন্য মাংস ও দুগ্ধ ভক্ষণ নিষিদ্ধ করিয়াছিলেন, যাহাতে তিনি সাধারণ প্রজার দুঃখকষ্ট উপলব্ধি করিতে পারেন। “একদা এক দরিদ্র মাতা স্বীয় সন্তানদের ঘুম পাড়াইবার নিমিত্ত শূন্য হাঁড়ি উনুনে চড়াইয়াছিল। উমর (রাঃ) স্বয়ং নিশীথ রাত্রে সেই গৃহে খাদ্যদ্রব্য পৌঁছাইয়া দিলেন।” তাঁর শাসনামলে এতিম ও বিধবাদের জন্য বিশেষ ভাতা চালু করা হইয়াছিল। এইরূপে তিনি সমাজে একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের রূপরেখা দাঁড় করাইলেন, যাহাকে অধুনা-যুগের 'কল্যাণরাষ্ট্র' ধারণার পূর্বসূরী বলা যাইতে পারে।
উমর (রাঃ)-এর প্রশাসনিক দক্ষতার আরও দিক:
তিনি রাত্রিকালীন টহল-ব্যবস্থা চালু করিলেন, যাহাতে জনগণের সমস্যা সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা যায়। “উমর (রাঃ) প্রায়শঃ রাত্রে ছদ্মবেশে নগর-পথে বাহির হইতেন, যেন তিনি স্বচক্ষে প্রজাকুলের অবস্থা দেখিতে পারেন। তাঁর এই রাত্রিকালীন টহল ব্যবস্থা ছিল আধুনিক ‘ফিল্ড ইনস্পেকশন’ ধারণারই সূচনাস্বরূপ।” তিনি অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা ব্যবস্থা (দাগ) প্রতিষ্ঠা করিলেন, যাহাতে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের কর্মকাণ্ডের ওপর নজর রাখা যায়। তিনি আদালত ও বিচারব্যবস্থাকে বিচারকের স্বতন্ত্রতা নিশ্চিত করিয়া বিন্যস্ত করিয়াছিলেন—বিচারকগণ খলিফার নিকট হইতেও প্রভাবমুক্ত থাকিতেন।
অর্থনৈতিক সংস্কারে বিস্তারিত:
“তিনি ‘খাজনা’ (রাজস্ব) সংগ্রহের নূতন নিযাম” প্রবর্তন করিলেন, যাহাতে কৃষক ও ব্যবসায়িগণ ন্যায্য হারে কর প্রদান করে। “ ‘দিওয়ান’ ব্যবস্থা” চালু করিলেন—ইহা ছিল সরকারি হিসাব-রক্ষণের দপ্তর, যাহা পরবর্তীতে সমগ্র মুসলিম জাহানে বিস্তার লাভ করিয়াছিল। তিনি “ভূমি সংস্কার আইন” প্রবর্তন করিলেন: বিজিত অঞ্চলের জমি রাষ্ট্রীয় মালিকানায় (বাইতুল মাল) রাখিয়া কৃষকদের ব্যবহারের সুযোগ প্রদান করিলেন, যেন জুলুম বা অন্যায়ের মাধ্যমে কেহ ভূমি দখল করিতে না পারে।
শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারে অবদান:
উমর (রাঃ)-এর আমলে শিক্ষার প্রভূত প্রসার ঘটিল। তিনি মসজিদকে কেবল ইবাদতের স্থান নহে, বরং শিক্ষা ও সামাজিক কার্যকলাপের প্রাণকেন্দ্র রূপে গড়িয়া তুলিলেন। কোরআন শিক্ষার পাশাপাশি গণিত, চিকিৎসা ও অন্যান্য জ্ঞানচর্চাকেও উৎসাহিত করা হইত। তিনি সামাজিক নৈতিকতা অটুট রাখিতে কঠোর ছিলেন। মদ্যপান, সুদখোরি এবং তাবৎ অনৈতিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে কঠোর 'হদ' (দণ্ড) গ্রহণ করা হইত। তাঁর শাসন ছিল আল্লাহভীতির (তাকওয়া) উপর ভিত্তি করিয়া, যাহা সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করিয়াছিল।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও পররাষ্ট্রনীতি:
তাঁর খিলাফত-কালে মুসলিম সাম্রাজ্য ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করিল (মিসর, সিরিয়া, পারস্য)। কিন্তু তিনি কদাপি “অন্য জাতির উপর জুলুম বা অন্যায্য দখল” অনুমোদন করেন নাই। তিনি বিজিত অঞ্চলের জনগণের ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষা করিয়াছিলেন—যেরূপ জেরুসালেমের খ্রিস্টানদের নিরাপত্তা চুক্তি।
প্রশাসনিক নীতিতে আল্লাহভীতি ও দায়িত্ববোধ:
তাঁর শাসনের মূলনীতি ছিল: “যদি ফোরাত নদীর তীরে একটি ছাগলও ক্ষুধায় প্রাণত্যাগ করে, তবে (হাশরের ময়দানে) উমরকে তাহার জবাবদিহি করিতে হইবে।”
সমসাময়িক শিক্ষা: আধুনিক রাষ্ট্রের জন্য পাঠ:
আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনায়: স্বচ্ছতা, মানবিক শাসন, দারিদ্র্য বিমোচন ও আইনের সমতা”—এই চারিটি স্তম্ভ উমর (রাঃ)-এর রাষ্ট্র-দর্শন হইতে অনুপ্রাণিত। “আজকের বিশ্বে যখন প্রশাসনিক দুর্নীতি ও ক্ষমতার 'ইফরাত' (অপব্যবহার) এক বৃহৎ সমস্যা, তখন উমর (রাঃ)-এর শাসন আমাদিগকে এই শিক্ষাই প্রদান করে যে, ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য একজন রাষ্ট্রনায়কের ব্যক্তিগত তাকওয়া (খোদাভীতি) ও সততা কী পরিমাণ অপরিহার্য।”
আধুনিক বিশ্বে প্রাসঙ্গিকতা:
উমর (রাঃ)-এর প্রশাসন শুধু তাঁর যুগেই সীমাবদ্ধ নহে, বরং আধুনিক বিশ্বের জন্যও সমভাবে প্রাসঙ্গিক। আজকের গণতন্ত্র, জবাবদিহিতা, কল্যাণনীতি ও ন্যায়বিচার তাঁর আমল হইতে শিক্ষণীয়। বিশেষ করিয়া রাষ্ট্রের প্রতি জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য যে স্বচ্ছতা প্রয়োজন, তাহা তিনি প্রতিষ্ঠা করিয়া গিয়াছেন।
উপসংহার:
হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)-এর খিলাফত-কাল ছিল ন্যায়, সাম্য ও কল্যাণের এক স্বর্ণালী অধ্যায়। তাঁর শাসন প্রমাণ করে যে, আল্লাহভীতি ও দায়িত্বশীলতা থাকিলে রাষ্ট্র পরিচালনা কী প্রকারে একটি জাতিকে সমৃদ্ধি ও শান্তির পথে লইয়া যাইতে পারে। আজকের পৃথিবী যখন অন্যায়, দুর্নীতি ও বৈষম্যে জর্জরিত, তখন উমর (রাঃ)-এর প্রশাসনিক সংস্কার ও ন্যায়বিচারের শিক্ষা আমাদের জন্য অমূল্য দিকনির্দেশনা। “হযরত উমর (রাঃ) কেবল ইসলামি ইতিহাসের নহেন, তিনি সমগ্র মানব ইতিহাসের এক অনন্যসাধারণ প্রশাসক। তাঁর নেতৃত্ব আধুনিক বিশ্বের শাসনব্যবস্থার জন্যও এক চিরন্তন অনুপ্রেরণা। যদি বর্তমান বিশ্বের রাষ্ট্রনায়কগণ তাঁর আদর্শ কিঞ্চিৎমাত্রও অনুসরণ করিতেন, তবে ধরাতল হইতে অন্যায়, দুর্নীতি ও বৈষম্য বহুলাংশে হ্রাস পাইত।”