যুহুদ: কুরাআন, হাদিস এবং তাসাউফের আলোকে তার মর্যাদা
ভুমিকা :
ইমাম জাইনুদ্দিন আল মাখদুম আল কবির বিন আলি আল মা'বারি আল মালাবারি আল শাফি (রহঃ) তিনার গ্রন্থ “হিদায়াতুল আযকিয়া ইলা তারিকিল আউলিয়া” তে বর্ণনা করছেন, যে ব্যাক্তি তাসাউফের পথে আসতে চায় তাকে ৯ টি ওয়সিয়াত কে মেনে চলত হবে। আশ্চর্যের বিষয় হলো এই, যে যুহুদও হল সে ৯ ওয়সিয়াতের মধ্যে একটি ওয়াসিয়াত।
যুহুদের আভিধানিক অর্থ হল خلاف الرغبة ويقال زهد في الشيئ وعنه: اي لم يرغب অর্থাৎ ইচ্ছার বিপরিত এবং বলা হয় যে একটা জিনিস থেকে যুহুদ করা মানে তাকে না চাওয়া। অন্যান্য স্থানে বলা হয়ছে যে যুহুদের মানে হল ترك الدنيا অর্থাৎ দুনিয়া কে ত্যাগ করা। শরিয়তে তার অর্থ হল فقد علاقة القلب بالمال وليس هو فقد المال অর্থাৎ টাকা থকে হৃদয় বন্ধন না থাকা কিন্তু যুহুদ মানে টাকা না থাকা এটা না, কিন্তু টাকার সাথের বন্ধন না থাকা এটা হল যুহুদ। আমাদের মনে একটা প্রশ্ন সর্বদা আসে যে সবচে উত্তম যুহুদ কি? অথবা সবথকে বড় যুহুদকারি কে ?
তার হল উত্তর ইমাম জাইনুদ্দিন আল মাখদুম আল কবির বিন আলি আল মা'বারি আল মালাবারি আল শাফির (রহঃ) উক্তি, তিনি বলছেন যে
ان نبينا سليمان عليه السلام لم يكن زاهد في الدنيا بل هو أزهد الزاهدين إذ كان يأكل الخبز الشعير ويطعم العام الأطعمة لذيذة وهو أحسن الزهد
অর্থ:
“নিশ্চয়ই আমাদের নবি সুলেমান (আঃ) তিনি শুধু একটা যুহুদকারি ছিলেন না, তার সাথে সাথে তিনি সবচে উত্তম যুহুদকারি ছিলেন, যখন তিনি খাবার খেতেন তখন তিনি একটা সাধারন রুটি ভক্ষণ করতেন কিন্তু যখন মানুষদের কে খাবার ভক্ষণ করাতেন তখন ভাল ভাল খাবার ভক্ষণ করাতেন এটাই হল সবচে উত্তম যুহুদ” ।
এখান থেকে আমদের প্রশ্নের উত্তর আমরা পাই, তাহালে আমরা এখান থেকে এটা বুঝলাম যে মানুষদের সাথে ভাল ব্যাবহার এবং তাদের কে ভাল করে ভক্ষণ করাতে হবে যদি আমরা উত্তম যুহুদ করতে চাই, যদিও বা আমাদেরকে নিচু পর্যায়ের খাবার খেতে হোক না কেন, সেটাই হল সবচে উত্তম যুহুদ।
যুহুদের তাৎপর্য ও মর্যাদা:
যুহুদের মর্যাদা ও ফজিলতের সম্বন্ধে নানা স্থানে নানা ধরনের কুরাআন শরিফের আয়াত এবং নানান হাদিসে বর্ণনা হয়েছে, যেমন আল্লহ তাল কুরাআন শরিফের সুরাহ ইমরানের ১৪ নং আয়াতের বর্ণনা করেছেন যে:
زُيِّنَ لِلنَّاسِ حُبُّ الشَّهَوَاتِ مِنَ النِّسَاءِ وَالْبَنِينَ وَالْقَنَاطِيرِ الْمُقَنطَرَةِ مِنَ الذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ وَالْخَيْلِ الْمُسَوَّمَةِ وَالْأَنْعَامِ وَالْحَرْثِ ۗ ذَٰلِكَ مَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا ۖ وَاللَّهُ عِندَهُ حُسْنُ الْمَآبِ
অর্থ:
“মানবকূলকে মোহগ্রস্ত করেছে নারী, সন্তান-সন্ততি, রাশিকৃত স্বর্ণ-রৌপ্য, চিহ্নিত অশ্ব, গবাদি পশুরাজি এবং ক্ষেত-খামারের মত আকর্ষণীয় বস্তুসামগ্রী। এসবই হচ্ছে পার্থিব জীবনের ভোগ্য বস্তু। আল্লাহর নিকটই হলো উত্তম আশ্রয়” ।
এ আয়তে আল্লহ তালা যুহুদের সম্বন্ধে বলছেন যে সমস্ত দুনিয়ার জিনিস হল একটা ফুর্তি কিন্ত আসল স্থান হল আল্লাহর কাছে, অর্থাৎ এই দুনিয়া থেকে উত্তম আখিরাত।
নবি মুহাম্মেদ (সাঃ) দুনিয়া এবং আখিরাতের উদাহরণ দিয়ে একটা হাদিসে বর্ণনা করছেন যে মুস্তাওরিদ বিন শাদাদ রাজি আল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত যে নবি মুহাম্মেদ (সাঃ) বলছেন
ما الدنيا في الاخرة إلا مثل ما يجعل أحدهم أصبعه في اليم فلينظر بما يرجع
অর্থ:
নবি মুহাম্মেদ (সাঃ) বলছেন যে একটা মানুষ যে নিজের আঙুল কে একটি সমুদ্র তে রাখে এবং বের করে তাহলে যত তার আঙুল থেকে জল আসবে তার মত হল দুনিয়া আখিরাতের কাছে অর্থাৎ একটা মানুষ যদি নিজের আঙুল কে একটি সমুদ্রতে রাখে এবং তাকে বাহির করে তখন সে একবারে কম জল পাবে তাহালে দুনিয়াও একটি আঙুলের জলের মত, এখানে দুনিয়া কতটা আখিরাতের কাছে কম মর্যাদাশীল তার সম্বন্ধে এ হাদিসটি এসেছে।
আমাদের নবি (সাঃ) কত বড় যুহুদকারি ছিলেন তার সম্বন্ধে একটি হাদিস বর্ণিত আছে যে জুয়াইরিয়া বিন্ত আল হারিস উম্মু আল মুমিনিন রাজি আল্লাহ আনহা বলছেন যে
ما ترك رسول الله عند موته دينارا ولا درهما ولا عبدا ولا أمة ولا شيئا إلا بغلته البيضاء التي كان يركبها وسلاحه وأرضا جعلها لإبن السبيل صدقة. (رواه البخاري)
অর্থ :
জুয়াইরিয়া বিন্ত আল হারিস উম্মু আল মুমিনিন রাদিয়া আল্লাহ আনহা বলছেন যে আমাদের নবি (সাঃ) তিনার মৃত্যুর সময়ে দিনার, দিরহাম, গুলাম, চাকরানি এবং কিছুও রেখে যাননি, শুধু একটি সাদা গাধা ছাড়া যার উপর তিনি যাত্রা করতেন এবং একটি যুদ্ধ অস্ত্র এবং একটি স্থান যেটা মানুষের জন্য সাদকা করে দিয়ে ছিলেন।(সাহিহুল বুখারিতে বর্ণিত)
যুহুদের সম্বন্ধে অন্যতম হাদিস হল আব্দুল্লাহ বিন মাসুদ রাজি আল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত যে
نام رسول الله صلى الله عليه وسلم على حصير فقام وقد أثر فى جنبه, قلنا: يا رسول الله لو انخذنا لك وطاء فقال: ما لي وللدنيا؟ ما أنا في الدنيا إلا كراكب استظل تحب الشجرة ثم راح وتركهاز.
অর্থ :
আব্দুল্লাহ বিন মাসুদ রাজি আল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত যে তিনি বলছেন আমাদের নবি (সাঃ) একটা সময় একটি খারাপ চাদরের উপর ঘুমিয়েছিলেন যখন তিনি দাঁড়ালেন সেই সমায় তিনার দেহের উপর দাগ বসে গিয়েছিল, তারপর আমরা বললাম আমাদের আকা আমদের নবি (সাঃ) আমরা যদি আপনার জন্য একটা আরামদায়ক চাদর নিয়ে আসলে ভাল হয় না? সেই সময় আমদের নাবি বলেন কোথায় আমি আর কোথায় দুনিয়া? আমি এই দুনিয়া তে একটা ভ্রমণকারীর মত এসেছি যে একটা গাছে আরাম করার জন্য আসে এবং আরাম করার পরে তাকে ছেড়ে দেয়।
এখান থেকে আমরা বুঝলাম যে আমাদের নবি দুনিয়ার সমস্ত দ্রব্য ও সম্পদকে কত তুচ্ছ ভাবতেন।
যুহুদের মর্যাদা ও ফজিলতের সম্বন্ধে একটি কবিতা তে ইমাম জাইনুদ্দিন আল মাখদুম আল কবির বিন আলি আল মা'বারি আল মালাবারি আল শাফি (রহঃ) বলছেন যে
وازهد أحسن منصب بعد التقى
وبه ينال المقام أرباب العلى
অর্থ :
এবং তোমরা যুহুদ করো কারণ এটি তাকওয়ার পরে সবথেকে উত্তম স্থান
এবং এটা দ্বারায় আল্লার নিকটবর্তীর মর্যাদা হওয়া সম্ভব
হাদিসের আলকে যুহুদের ফজিলতের সম্বন্ধে বিখ্যাত গল্প:
দুনিয়া কতটা আল্লাহর কাছে নিচে তার সমন্ধে অন্যতম হাদিস দ্বারা বর্ণিত আছে যে জাবির বিন আব্দুল্লাহ রাদিয়া আল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত যে একদিন আমাদের নবি (সাঃ) একটা বাজার থেকে যাত্রা করছিলেন এবং তিনি একটা ছাগল যার ছোট কান অর্থাৎ তার কান কাটা ছিল এবং সে মরে গিয়েছিলো। নবী কারীম ছাগলটির কাছে গিয়ে তার কান কে ধরেন এবং বাজারমুখী হয়ে প্রশ্ন করেন:
أن يكون هذا له بدرهم؟ أيكم تحبون
“তোমাদের মাঝে কে এই ছাগলটি এক দিরহামের পরিবর্তে কিনে নিবে?”
মানুষরা উত্তর দিল আমরা চাইনা যে এটা আমদের হোক আমরা এটা নিয়ে কী বা করবো? তার পরে নাবি কারিম (সাঃ) আবার প্রশ্ন করেন أتحبون أنه لكم؟ তোমরা কি চাও যে এটা তোমাদের হোক? আবার মানুষরা উত্তর দিলেন والله لو كان حيا عيبا, إنه أسك فكيف وهو ميت؟ আল্লাহর নাম নিয়ে বলছি যে যদি এটা জীবিত থাকত তাও তার মধ্যা একটা আয়ব আছে কিন্তু এর মৃত্যু হয়ছে এবং তার কানও ছোট তাহালে কেমন করে সম্ভব? সেই সময় আমাদের নবি (সাঃ) বলেন যে
فوالله للدنيا أهون على الله من هذا عليكم
আল্লাহর কসম খেয়ে আমি বলছি যে দুনিয়া এই ছাগল যার কান কাটা এবং মৃত্ তার থেকেও নিচ অর্থাৎ তার মর্যাদা একটা খারাপ ছাগলের মত তার মর্যাদা থেকে কম মর্জাদাশীল হল দুনিয়া।
এই গল্প থেকে আমরা বুঝতে পারলাম যে দুনিয়া আল্লাহর নিকটে কতটা নিচে। তাহলে আমাদেরকে যুহুদ করা উচিত কেননা এই দুনিয়া আল্লাহর কাছে খুবই তুচ্ছ।