ইসলামী পরিবারের গঠন ও ভাঙনের কারণ: সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

ইসলামি চিন্তাধারায় পরিবারকে সমাজের মৌলিক ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পরিবার হলো সমাজের ধারক ও বাহক, যেখানে ধর্মীয় শিক্ষা, নৈতিকতা এবং মূল্যবোধ প্রজন্মান্তরে প্রেরিত হয়। কোরআনে বলা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা মানুষের মধ্যে থেকে স্বামী-স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন যাতে তাতে শান্তি ও প্রেম স্থাপিত হয়। অর্থাৎ দাম্পত্যের মধ্যে আল্লাহর সৃষ্ট আন্তরিকতা (‘মাওয়াদা’) এবং সহানুভূতি (‘রাহমা’) হলো ঐক্যের মূল ভিত্তি। এই আল্লাহ-বান্ধব সম্পর্কের দায়িত্ব ও কাঠামো ইসলামী শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু।


ইসলামি দৃষ্টিতে বৈবাহিক বন্ধন একটি পবিত্র শৃঙ্খলা ও চুক্তি। কোরআনে স্ত্রী ও স্বামীর মধ্যে পারস্পরিক অধিকার-দায়িত্বের সমতা নির্দেশিত হয়েছে। সূরা বাকারা (২:২২৮) আয়াতে উল্লেখ আছে, “নারীরও স্বামীর সমপরিমাণ অধিকার রয়েছে, তবে পুরুষের নারীর ওপরে সামান্য কর্তৃত্ব আছে”। এখানে কর্তৃত্ব বলতে বোঝানো হয়েছে স্বামীর বোঝাপড়া ও পরিবার-পরিচালনার দায়িত্ব। অর্থাৎ ইসলামী ফিকহ অনুযায়ী স্বামী গৃহের রক্ষক ও দেখভালকারী (পোষক) হিসেবে ভূমিকা পালন করে, আর স্ত্রী পরিবারকে আদর্শবাসা ও ধর্মীয় শিক্ষার কেন্দ্র করে তোলার দায়িত্ব পালন করে। তদুপরি ইসলাম পিতামাতার মর্যাদা এবং তাঁদের কেয়ামতপূর্ণ অধিকারকে সবচেয়ে প্রাধান্য দিয়েছে। সুরা ইসরা (১৭:২৩) আয়াতে রয়েছে, “আপনার পালনকর্তা আপনাদের আদেশ দিয়েছেন, ‘তুমি তাঁকে ছাড়া আর কাউকে পূজা করো না; এবং পিতামাতার সঙ্গে সদাচরণ কর’”। অর্থাৎ সন্তানের দৃষ্টিতে পিতামাতার প্রতি সন্তুষ্টি ও সম্মান অপরিহার্য, যা ইসলামী পারিবারিক গঠনের অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ।


পারিবারিক ঐক্য ও সংহতির গুরুত্ব


একটি মজবুত পরিবার গড়ে উঠতে পারস্পরিক আন্তরিকতা, বৃত্তিমূলক দায়বদ্ধতা ও শ্রদ্ধা অপরিহার্য। ইসলাম মানবিক সম্পর্কের মাধুর্য এবং ঐক্যের ওপর জোর দিয়েছে। কোরআন তথা রাসূল (সঃ)-এর হাদিসে পরিবারের প্রতি ভালোবাসা ও সহমর্মিতার গুরুত্ব বারবার উল্লেখ আছে। যেমন হাদিসে বর্ণিত আছে, “তোমাদের মধ্যে সেরা সেই, যে তার পরিবারের প্রতি সর্বোৎকৃষ্ট; আর আমি আমার পরিবারের মধ্যে সেরা”। অর্থাৎ পারিবারিক সদস্যের প্রতি সৎ আচরণ ও সহানুভূতি ইসলামে সর্বোচ্চ পুরস্কৃত বিষয়। পরিবারের অভ্যন্তরে মমত্ববোধ, সংযম এবং ইতিবাচক মিথস্ক্রিয়া রক্ষাই ঐক্য নিশ্চিত করে। ইসলামে ঘরের বাইরে যেমন পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বের শিক্ষা রয়েছে, তেমনি পরিবার-পরিদির্বণ্টিত থাকতে হলে গৃহের সদস্যদেরও পরস্পরকে সম্মান ও ভালোবাসার সঙ্গে সামলাতে হবে। অহিংসা, মিথ্যাচার ও গোপন দ্বন্দ্ব পরিবারে ভাঙন আনে; তাই কোরআন ও সুন্নাহে এ সব থেকে বিরত থাকার গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।

সমাজতত্ত্বের দৃষ্টিকোণে দেখা গেছে, যখন পরিবারে বোঝাপড়া ও ভালোবাসা থাকে, তখন সামাজিক বন্ধনও দৃঢ় হয়। তাই ইসলামী আদর্শে ‘মাওয়াদা ও রাহমা’ (মমত্ব ও মায়া) পরিবার সুরক্ষার অন্যতম উপাদান হিসেবে বিবেচিত। পরিবারের বৃদ্ধ সদস্য, শিশু, অক্ষমতাজনিত দায়–ওসমূহ পূর্ণ করাও ঐক্য রক্ষার অংশ। নবী করীম (সঃ) মা-বাবার গুরুত্ব সম্পর্কে নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, “আপনার মায়ের প্রতি তিনবার সেবায় শ্রেষ্ঠত্ব আছে, বাবা সর্বশেষে” (সহিহ বুখারি)। এ নির্দেশনার মাধ্যমে পরিবারের সব সদস্যের দায়িত্ব ও পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মনোভাবের গুরুত্ব বিশেষভাবে ফুটে ওঠে।
পরিবার ভাঙনের কারণ: ধর্মীয় ও আধুনিক প্রেক্ষাপট


ইসলামী অনুশাসনে পারিবারিক সংঘাত সর্বদা অনিষ্টজনক বিষয়। কোরআন ও হাদিসে বিবাহবিচ্ছেদকে সর্বশেষ উপায় হিসেবে ধরা হয় এবং পুরুষকে ধৈর্যধারণে উৎসাহিত করা হয়। তথাপি ইসলাম তালাককে অনুমোদন করেছে, তবে তা শুধুমাত্র অত্যন্ত জরুরি প্রয়োজনে এবং আদব-বিধি মেনে ব্যবস্থা গ্রহণের শর্তে। সমাজতত্ত্বের অধ্যয়নগুলো দেখায়, তালাক প্রক্রিয়া পরিবারে স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত করে এবং আল্লাহর অপ্রসন্নতার কারণ হতে পারে। তাই ইসলামে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মিথস্ক্রিয়া ও অধিকারসমূহ রক্ষা করা নির্দেশনা। উদাহরণস্বরূপ, আইন অনুযায়ী তালাকের পরস্থর তালাক (তালাক-উল্লা, তালাক-সানিয়া) আরব সামাজিক ব্যবস্থায় বিশুদ্ধ পদ্ধতির মাধ্যমে সম্পন্ন হতো (সূরা বাকারা ২:২২৯), যেখানে পুনর্মিলনের সুযোগ ছিল। হাদিসে পরিবারবর্হিভাব, পরকীয়া, কিংবা স্ত্রীর প্রতি অবমাননাকর আচরণ কঠোরভাবে দণ্ডনীয় হিসেবে উল্লেখ নেই, বরং পরিবার রক্ষায় সতর্ক থাকার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। ইসলাম স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সমতা ও ন্যায় নিশ্চিত করার জন্য পরিবার ভেঙে যাওয়ার মূল কারণগুলো এড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে।
আধুনিক সমাজতত্ত্বের বিশ্লেষণে দেখা যায় যে পরস্পরবিরোধ, আর্থ-সামাজিক চাপে পরিবার ভেঙে যাওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, এক গবেষণা তুলে ধরে যে বাংলাদেশের বিবাহবিচ্ছেদের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে ডাউরি দাবিতে সহিংসতা, স্বামীর নেশা ও অন্য মহিলার সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক ইত্যাদি। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায় স্বামী বা স্ত্রীর বেকারত্ব বাড়লে বিবাহবিচ্ছেদের ঝুঁকি বেড়ে যায়; স্বামীর আয়ের উচ্চতা এই ঝুঁকি কমায়, কিন্তু স্ত্রীর উঁচু আয় এটি বাড়িয়ে দেয়। অর্থনৈতিক অস্থিরতার পাশাপাশি নারীর শিক্ষাগত ও পেশাগত অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাওয়াও এক গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে পাওয়া গেছে। উদাহরণস্বরূপ ২০১৯ খ্রিস্টাব্দের এক গবেষণা অনুযায়ী, তৈরী পোশাক শিল্পসহ বিভিন্ন খাতে নারীর কর্মসংস্থানের বৃদ্ধির সাথে স্ত্রীদের তালাকের হারও বাড়ছে। পাশাপাশি গবেষণায় দেখা যায় বহুবিবাহের অনৈতিক ব্যবহার, পারিবারিক বন্ধন-বিচ্ছিন্নতা ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ও বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে কাজ করছে। 


পরিবার ভাঙনের কারণ অনেক রয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আর্থিক চাপ ও কর্মসংস্থান, যার কারণে দাম্পত্যে দুজনের বেকারত্ব আর আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে বিভাজনের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এবং পারিবারিক সহিংসতা ও অপব্যবহারও কারণ হয়ে দাঁড়ায় যেখানে স্বামী বা তার পরিবারের পক্ষ থেকে ডাউরি দাবিতে নির্যাতন, মাদকাসক্তি, অবৈধ সম্পর্ক ইত্যাদি বড় ধরনের সংঘাতের সৃষ্টি করে। আর নারীর আধুনিকীকরণ টাও কারণ হতে পারে, যেটি দ্বারা শিক্ষিত এবং কর্মমুখী নারীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় পরিবারে দায়িত্ব-ভাগাভাগির পরিবর্তন ঘটছে, যা কখনো সামাজিক পরিবর্তনের সাথে সঙ্গতি না পেয়ে বিবাহবিচ্ছেদকে ত্বরান্বিত করছে। এই সব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কারণগুলো পরিবার ভাঙনে অবদান রেখেছে; ইসলামে এ সব আচরণ (যেমন নির্যাতন, অবিচার, দ্বন্দ্ব) নিষিদ্ধ এবং পারস্পরিক সম্মান-দায়িত্ব পালনের গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।


উপসংহার


সংক্ষেপে বলা যায়, ইসলামী দৃষ্টিতে পরিবার হলো আল্লাহর অনুদান, যেখানে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রেম ও মায়ার মাধ্যমে সমাজের শান্তি রক্ষার অনুপম প্রক্রিয়া আবর্তিত হয়। পরিবারের প্রতিটি সদস্যের নিয়ন্ত্রিত দায়িত্ব ও অধিকার রক্ষার মধ্য দিয়ে পারস্পরিক ঐক্য ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হয়। পরিবার ভাঙনের ক্ষেত্রে ইসলামী নীতিতে সংশোধনের প্রচলন থাকলেও সাম্প্রতিক গবেষণা দেখাচ্ছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গৃহপালিত সহিংসতা, আর্থ-সামাজিক চাপ এবং মূল্যবোধের পরিবর্তনই মূল দুষ্প্রভাব। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ইসলাম পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সহানুভূতি ও দায়িত্ববোধে ফেরার পরামর্শ দেয়। বর্তমান সমাজে পারিবারিক সংহতি রক্ষায় ধর্মীয় মূল্যবোধের সঙ্গে বাস্তবসম্মত সামাজিক নীতি কাজ করার মধ্য দিয়ে পরিবারের অভ্যন্তরীণ সুসংগঠিততা এবং সমাজের মঙ্গলের সামঞ্জস্য অর্জন সম্ভব।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter