জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা ও মাহাত্ব
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানব জাতিকে অফুরন্ত ও অগনিত নিয়ামত দান করেছেন। তন্মধ্যে বিদ্যা তথা জ্ঞান একটা অন্য়তম অমূল্য় নিয়ামত। এই জ্ঞানের দ্বারাই মানুষ পশু হতে পৃথক হয়। এরই মাধ্য়মে মানুষ নিম্ন স্তর থেকে উচ্চ স্তরে পৌঁছে যায়, মান-সম্মানের শীর্ষ স্থানে অধিষ্ঠিত হয়। এই জ্ঞানের দ্বারাই মানুষ, মাথা উঁচু করে গর্বে আপ্লূত হয়ে মানুষ সুউচ্চ পাহাড়কে পদদলিত করে শৃঙ্গে পৌঁছে তার গর্বতে খর্ব করে জয়ের পতাকা গেড়ে দেয়। ভয়ঙ্কর গভীর সমুদ্রের বুকচিরে একদেশ থেকে অন্য় দেশে পাড়ি দেয়। লাগামহীন অনিয়ন্ত্রিত পশুকে নিয়ন্ত্রন করে নিজেদের অধীনস্থ করে বিভিন্ন কাজে লাগায়। এরই দৌলতে নিজের কর্তৃত্ব মানিয়ে জনসাধারণের ওপর রাজ করা যায়। এরই মাধ্য়মে অকল্পনীয় অভেদ্য় বায়ুমন্ডলকে ডিঙিয়ে চন্দ্রে পৌঁছে বিজয় উৎসব পালন করা সম্ভব হয়। এরই সাহায্য়ে নানান অভিনব জিনিস আবিস্কার করে মানব জীবনযাত্রাকে সহজ ও সুগম করে তোলা যায়। তাই জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা ও মাহাত্ব অপরীসিম ও অতুলনীয়।
এহেন অমূল্য় ও অতুলনীয় নিয়ামতের প্রতি ইসলাম ধর্ম তেমন কোন বিশেষ গুরুত্ব দিবেনা তা ভাবাই যায়না। বরং ইসলাম ধর্মের মতো একটি সম্পুর্ণ জীবণ বিধান তার প্রতি বিশেষ লক্ষ দিবে এটাই তো স্বাভাবিক। এজন্য়ই তো আমাদের প্রীয় নবী হজরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের ওপর আল্লাহর যে মহা গ্রন্থ কোরান শরীফ নাজিল হয়েছিল তার প্রথম শব্দটিই হলো ‘ইকরা’ অর্থাৎ পড় বা পড়ুন। এক গণনা অনুযায়ী পবিত্র কোরাণ শরীফে ব্য়বহৃত ৭৮ হাজার শব্দের মধ্য়ে প্রথম শব্দ এটিই। এই আয়াতের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যেতেই পারে যে ইসলাম ধর্মের শুভ সূচনাই হয়েছে জ্ঞান চর্চা দিয়ে। কিছু গবেষকের গবেষণা অনুযায়ী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দুই মিলিয়ে প্রায় ৮০০ জায়গায় বিভিন্ন রূপে জ্ঞান বা তার সমার্থক শব্দ ব্য়বহার হয়েছে। এহতে আমরা বুঝতে পারি ইসলাম ধর্মের মাহাত্ব কত।
একথা সর্ব জনবিদিত যে মানবজাতির সৃষ্টির প্রারম্ভে আল্লাহ তাআলা ফেরেস্তাগণকে সমস্ত জিনিসের নাম বলতে বলেন তখন ফেরেশ্তারা অজ্ঞতা প্রকাশ করেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানবকুলের আদি পিতা হজরত আদম আলায়হিস সালাম কে নাম বলতে বলেন। হজরত আদম আলায়হিস সালাম সমস্ত জিনিসের নাম বলে দেন। তাই হযরত আদম আলায়হিস সালামের সম্মানার্থে সমস্ত ফেরেশ্তাদের হুকুম দেওয়া হয় তাঁরা যেন তাঁকে সেজদা করেন। ইবলিস শয়তান ছাড়া সমস্ত ফেরেশ্তারা হজরত আদম আলায়হিস সালামকে সেজদা করেন।
কোরানে বিদ্য়ার মাহাত্ব :-
জ্ঞানের গুরত্ব ও মহাত্ব প্রকাশ করতঃ কোরান মাজীদে একাধীক স্বাতন্ত্র আয়াত নাজিল হয়েছে। তন্মধ্যে দু-একটি আয়াত আপনাদের আত্মা শান্তির জন্য পেশ করা হচ্ছে। আল্লাহ বলেন, "এবং আরয করুন, হে আমার প্রতিপালক ! আমাকে জ্ঞান বেশি দাও। (সূরা ত্বহা-আয়াত নং-১১৪)
আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন, "আপনি বলুন, জ্ঞানীরা ও অজ্ঞলোকেরা কি সমান ? উপদেশ তো তারাই মানে যারা বোধ শক্তি সম্পন্ন”। অর্থাৎ, জ্ঞানী আর অজ্ঞ কখনই এক সমান হতে পারে না।
আল্লাহ তাআলা অন্য এক জায়গায় জ্ঞানী বাক্তিদের সম্মান বর্দ্ধন করতঃ এরশাদ করেন - "আল্লাহ তোমাদের মধ্যে ঈমানদারদের ও তাদেরই যাদেরকে জ্ঞান প্রদান করা হয়েছে মর্যাদা সমুন্নত করবেন।
বিদ্যা অর্জনের সহজ উপায়ের হদিস দিয়ে অন্য এক জায়গায় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন - "সুতরাং হে লোকেরা ! যা তোমরা জানোনা তা জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নাও"। (সূরা নাহল, আয়াত নং-৪৩)
হাদীসের আলোকে বিদ্যার গুরুত্ব :-
যেহেতু আমাদের নবী আখেরী নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন আল্লাহর প্রিয়তম নবী ও রসূল তথা শ্রেষ্ঠ দূত। এবং তাঁকে সমগ্র জগতের কল্যানের জন্য এই ধরার বুকে পাঠানো হয়েছে সেহেতু তিনিও নিজের মতো করে বিভিন্ন ভাবে বুঝিয়ে, রকমারী ফজিলত ও নেকির শুভ সংবাদ শুনিয়ে মানুষকে জ্ঞান অর্জনের প্রতি উদবুদ্ধ করেছেন। এই সংক্রান্ত প্রচুর হাদীস, হাদীসের গ্রন্থাদিতে বিদ্যমান।
হাদীস শরীফ- "হজরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ফরজ। জ্ঞান অর্জন কারীর জন্য সমস্ত জিনিস মাগফিরাতের দুআ করে। এমনকি সমুদ্রের মাছেরাও তার জন্য মাগফিরাতের দুআ করে"।
হাদীস শরীফ - "এক মুহুর্ত জ্ঞান অম্বেষন করা সারা রাত ইবাদত করার চেয়েও উত্তম। এবং একদিন জ্ঞান অম্বেষন করা তিন মাস রোজা রাখার চেয়েও বেশি ভাল"। (মুসনাদুল ফিরদাউস)
হজরত মানজেরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, "উলামাগণ হচ্ছেন নবীদের উত্তরাধিকারী"। (ইবনে নাজ্জার)
হাদীস শরীফ - "হজরত জাবির বিন আব্দুল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, অজ্ঞতার পীড়া থেকে আরোগ্য লাভ করার উপায় হচ্ছে জিজ্ঞাসা করা। (আবু দাউদ)
ইসলামের ইতিহাসে প্রথম যুদ্ধ 'বদরের যুদ্ধ' এই যুদ্ধে আলহামদুলিল্লাহ মুসলমানরা জয়ী হন। প্রতিপক্ষের ৭০ জনকে যুদ্ধপরাগী হিসেবে বন্দি করা হয়। তাদের মধ্যে যারা গৃহস্থ ছিল ফিদিয়া (মুক্তিপণ) দিয়ে মুক্তি পায়। আর যারা গরীব ছিল, ফিদিয়া দেওয়ার সামর্থ তাদের ছিল না নবীজি তাদেরকেও এই শর্তে মুক্তিদেন যে, তারা প্রত্যেক দশ-দশ জন মুসলমানকে লেখা পড়া শিখিয়ে দেবে। নবীজির এই মহান সিদ্ধান্ত আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে লেখা পড়া প্রাণ তুল্য। সুবহানাল্লাহ সুবহানাল্লাহ !
পরিসমাপ্তিঃ-
অবশেষে মাননীয় পাঠকবর্গ তথা মুসলিম সমাজকে বলতে চাইব যে পূর্বোল্লোখিত লেখনী হতে আপনারা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন যে, আমাদের ইসলাম ধর্ম বিদ্যা অর্জন করাকে কতটা গুরুত্ব দিয়েছে। অধমের জানা মতে কোনো জিনিসের বৃদ্ধির দুআ করার শিক্ষা দিতে স্বয়ং কোরানের আয়াত নাজিল হয়েছে জ্ঞান ছাড়া আর অন্য কোন বস্তু নেই। কোরানের মধ্যে এক মাত্র জ্ঞান বৃদ্ধির দুআ করার শিক্ষাই নবীজিকে দেওয়া হয়েছে। আর শিক্ষাই নয় বরং আদেশ দেওয়া হয়েছে তিনি যেন এই ভাবে দুআ করেন- হে আমার প্রতিপালক ! আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করুন। সুনহানাল্লাহ ! তাহলে জ্ঞান কতটা মূল্যবান বস্তু। কিন্তু হায়রে মুসলিম সমাজ ! যে ধর্ম জ্ঞানকে এত মূল্য দিয়েছে সেই ধর্মের অনুসারীরাই আজ কতটা পিছিয়ে রয়েছে। পিছিয়ে রয়েছে তাই নয় বরং জ্ঞান শূণ্য হয়েগেছে বললে বোধ হয় বেশি ভাল হবে।
জ্ঞান ও বিদ্যার গুরুত্ব বোঝানোর জন্য এত যত্নসহকারে কোরানে আয়াত নাজিল হয়েছে, নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদীস বর্ণনা করেছেন, কিন্তু আমরা মুসলমান হয়েও কোরান ও হাদীসের অমীয় বাণীগুলোর প্রতি কর্ণপাত করলাম না। জ্ঞান অর্জন করতে উদ্যত হলাম না। বরং অলসতা ও গাফিলতির কোলে শান্তির ঘুম ঘুমতে লাগলাম। ফলতঃ যাদের অধীনস্থ হওয়ার কথা ছিল তারা আজ কর্তা। আজ আমরা অধীনস্থ, অপমানিত, লাঞ্ছিত, অত্যাচারিত, অপরের ওপর নির্ভরশীল।
হে মুসলিম সমাজ! আর কত দিন অলসতা? কত দিন অক্ষমতা? বিলাসিতা, অকর্মন্যতা আর কত দিন? না, না, ঢের হয়েছে আর না। এবার জেগে উঠুন। কোরান ও হাদীসের ওপর আমল করুন। এগিয়ে আসুন কোরান ও হাদীসকে সামনে রেখে বিদ্যার পথ ধরুন, এগিয়ে চলুন।