জিকির: কুরআন ও হাদিসের আলোকে এর মর্যাদা
ভূমিকা
আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নানা ভুল কাজ করে ফেলি, যার ফলে আমাদের গুনাহের পরিমাণ প্রতিদিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। কিন্তু আমাদের প্রভু (আল্লাহ) অত্যন্ত দয়ালু ও পরম করুণাময়। তিনি আমাদের জন্য প্রচুর দোয়া ও জিকিরের কথা তাঁর পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করেছেন এবং তাঁর প্রিয় নবী (সাঃ) কে হাদিস শরীফে তা বলার নির্দেশ দিয়েছেন, যার মাধ্যমে আমরা জান্নাত লাভ করতে পারি এবং আল্লাহকে সন্তুষ্ট রাখতে পারি।
এই আলোচনায় আমরা জিকির সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করব। আমরা জানব, কোন জিকির করলে কী হয়, যেমন: ঘুমাতে যাওয়ার সময় কী জিকির পড়া উচিত ইত্যাদি।
শব্দার্থ ও পরিভাষাগত অর্থ
জিকির সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে, আমাদের এর লুগাতি অর্থ (শব্দার্থ) এবং ইস্তিলাহী অর্থ (পরিভাষাগত অর্থ) জানা প্রয়োজন, যা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
শব্দার্থ
আরবি ভাষায় "জিকির" শব্দের লুগাতি অর্থ হলো কাউকে স্মরণ করা। এটি "ذِكْر" শব্দ থেকে এসেছে, যার মানে হলো স্মরণ করা।
পরিভাষাগত অর্থ
জিকিরের ইস্তিলাহী অর্থ হলো একমাত্র আল্লাহকে হৃদয়ের গভীরতা থেকে স্মরণ করা, যার ফলে আল্লাহ সেই জিকিরকারীর প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে জান্নাত দান করেন। এই ধরনের স্মরণ বা জিকিরকেই জিকির বলা হয়।
কুরআন ও হাদিসের আলোকে এর মর্যাদা
আল্লাহ তায়ালা তাঁর পবিত্র কুরআনের সূরা জুমা-এর ১০ নম্বর আয়াতে ইরশাদ করেছেন:
وَاذْكُرُوا اللَّهَ كَثِيرًا لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
অর্থ: "আর তোমরা আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করো, যাতে তোমরা সফল হতে পারো।"
এই আয়াত থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, আল্লাহ নিজেই আমাদেরকে তাঁর জিকির করার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহর এই নির্দেশ পালন না করার অর্থ হলো জাহান্নামের দিকে ধাবিত হওয়া। তাই আমাদের উচিত অধিক পরিমাণে আল্লাহর জিকির করা।
আমরা প্রায়ই ভাবি, কোন জিকির করলে ভালো হয়? এর উত্তরে আমাদের নবী (সাঃ) বিভিন্ন হাদিসে নানা জিকিরের কথা বলেছেন। যেমন, একটি হাদিসে তিনি বলেন:
كَلِمَتَانِ خَفِيفَتَانِ عَلَى اللِّسَانِ، ثَقِيلَتَانِ فِي الْمِيزَانِ، حَبِيبَتَانِ إِلَى الرَّحْمَٰنِ: سُبْحَانَ اللَّهِ وَبِحَمْدِهِ، سُبْحَانَ اللَّهِ الْعَظِيمِ
অর্থ: "দুইটি হালকা শব্দ জিহ্বার উপর, কিন্তু কিয়ামতের দিন তার ওজন খুব ভারী, এবং এটি আল্লাহর কাছে প্রিয়। সে দুটি হলো: 'সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি, সুবহানাল্লাহিল আজিম।'"
আরেকটি হাদিসে নবী কারিম (সাঃ) জিকির সম্পর্কে বলেন:
الطُّهُورُ شَطْرُ الْإِيمَانِ، وَالْحَمْدُ لِلَّهِ تَمْلَأُ الْمِيزَانَ، وَسُبْحَانَ اللَّهِ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ تَمْلَآنِ أَوْ تَمْلَأُ مَا بَيْنَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ
অর্থ: "পরিচ্ছন্নতা হলো অর্ধেক ঈমান, 'আলহামদুলিল্লাহ' মিযান (তুলা) পূর্ণ করে, এবং 'সুবহানাল্লাহ' ও 'আলহামদুলিল্লাহ' আসমান ও জমিনের মধ্যবর্তী স্থান পূর্ণ করে।" (সাহিহ মুসলিম)
এই হাদিস থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, এই ছোট ছোট জিকির যেমন 'সুবহানাল্লাহ' ইত্যাদির কতটা মর্যাদা আল্লাহ তায়ালার কাছে রয়েছে। শেষ পর্যন্ত আমরা আল্লাহর কাছে এই দোয়া করি যে, তিনি আমাদেরকে সঠিকভাবে তাঁর জিকির করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
জিকির সম্পর্কে একটি বিখ্যাত গল্প
এই ঘটনা একটি হাদিসে আবু সাঈদ খুদরি (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে:
নবী করীম (সাঃ)-এর কাছে একটি কাফেলা বা সমাজ আসে এবং তারা প্রশ্ন করতে থাকে:
"হে আল্লাহর রাসূল! আমরা দেখছি যে, ধনী লোকেরা (আহলে দুনিয়া) নেক আমলের ক্ষেত্রে আমাদের থেকে এগিয়ে যাচ্ছে। তারা আমাদের মতোই নামাজ পড়ে, রোজা রাখে, কিন্তু তারা আমাদের থেকে বেশি দান করতে পারে এবং হজ করতে পারে, কারণ তাদের কাছে প্রচুর সম্পদ রয়েছে। তাহলে, হে নবী! আমরা কী করব? আমাদের তো এত সম্পদ নেই।"
তখন নবী করীম (সাঃ) বলেন:
"আমি কি তোমাদের এমন একটি বিষয় জানাব না, যার মাধ্যমে তোমরা তাদের থেকে বেশি সওয়াব অর্জন করতে পারবে? তা হলো: 'সুবহানাল্লাহ', 'আলহামদুলিল্লাহ' এবং 'আল্লাহু আকবার' ৩৩ বার করে পাঠ করা।"
প্রিয় বন্ধুরা, আমরা এই গল্প থেকে বুঝতে পারি যে, একজন ব্যক্তি যদি হজ করে এবং জাকাত দেয়, আর অন্য একজন ব্যক্তি যদি এইসব জিকির করে, তাহলে উভয়ের কাজের সওয়াব সমান হতে পারে। সুবহানাল্লাহ! তাই, আমরা বুঝতে পারি জিকিরের কতটা মর্যাদা রয়েছে। আল্লাহ তায়ালার কাছে শেষ পর্যন্ত এই দোয়া করি যে, তিনি আমাদেরকে অধিক পরিমাণে জিকির করার তাওফিক দান করুন। আমিন।