মরক্কো আল- কারাউইয়িন বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচীনতম উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
মরক্কোর আল-কারাউইয়িন বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের প্রাচীনতম উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড অর্জন করেছে এবং এটি এই মর্যাদায় সর্বজনস্বীকৃত। ৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে ফাতিমা আল-ফিহরি নামে এক মুসলিম নারী এটি একটি মসজিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে ১৯৬৩ সালে এটি মরক্কোর আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হয় এবং আজও মুসলিম শিক্ষাব্যবস্থার অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ফাতিমা ও তাঁর বোন মারিয়াম তাঁদের পিতার মৃত্যুর পর প্রাপ্ত সব সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় দান করেছিলেন, যার ফলেই আজকের বিখ্যাত আল-কারাউইয়িন বিশ্ববিদ্যালয়ের গোড়াপত্তন সম্ভব হয়েছে। সময়ের সাথে সাথে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকাঠামো ও শিক্ষার মানে ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়টি মূলত আরবি ভাষা ও ইসলামী সাহিত্যকেন্দ্রিক হলেও এর পাঠ্যক্রমে বিজ্ঞান, গণিত এবং বিভিন্ন ভাষাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ধ্রুপদী আরবি ব্যাকরণ, ভাষাতত্ত্ব এবং মালিকি মাজহাবভিত্তিক শরিয়াহ শিক্ষা এর প্রধান আকর্ষণ হলেও এখানে ইসলামবহির্ভূত বিষয়েও শিক্ষাদান করা হয়। মরক্কো এবং পশ্চিম আফ্রিকার মুসলিম অঞ্চল ছাড়াও বিদেশ থেকেও শিক্ষার্থীরা এখানে পড়তে আসেন। ১৯৪০-এর দশকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষার্থীদেরও ভর্তি কার্যক্রম শুরু হয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই প্রতিষ্ঠানটি বিস্তৃতি লাভ করেছে এবং বহু অভিজাত পৃষ্ঠপোষকের সাহায্যে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। ১৩৪৯ সালে মেরিনিড সুলতান আবু ইনান আল-ফারিসি এখানে একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে আজও অনেক মূল্যবান পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ইমাম মালিক রচিত আল-মুওয়াত্তা এবং ইবনে রুশদের আল-বায়ান ওয়াত-তাহসিল—যা মালিকি ফিকহের উপর লেখা এক ঐতিহাসিক গ্রন্থ।
এই প্রতিষ্ঠানটি অসংখ্য পণ্ডিত তৈরি করেছে, যারা মুসলিম বিশ্বের বৌদ্ধিক ও একাডেমিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ইবনে রুশদ আল-সাবতি, আবু ইমরান আল-ফাসি, ইবনে আল-খাতিব ও ইবনে খালদুন প্রমুখ। অধিকাংশ ঐতিহাসিক একমত যে, আল-কারাউইয়িন ছিল বিশ্বের প্রথম ডিগ্রি প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান এবং এটি ছিল বৈজ্ঞানিক বিতর্ক ও বৃত্তির এক শীর্ষস্থানীয় কেন্দ্র। অনেক পণ্ডিতের মতে, তৃতীয় ও চতুর্থ হিজরি শতকে আল-কারাউইয়িন ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ উভয় শিক্ষার ক্ষেত্রে তার সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছেছিল। ধর্মীয় আইনশাস্ত্র (ফিকহ) ও ধর্মতত্ত্ব (কালাম) ছাড়াও দর্শন ও বিজ্ঞানচর্চায় এ প্রতিষ্ঠান ছিল অন্যতম শ্রেষ্ঠ।
তবে ১৮ শতকে এসে এর পাঠ্যক্রম ধীরে ধীরে সংকুচিত হতে থাকে। ১৭৮৯ সালে ফেজ শহরের সুলতান আলাউই মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এর ফলে চিকিৎসাবিজ্ঞান, দর্শন ও অনেক মূল্যবান পাণ্ডুলিপি ধ্বংস বা হারিয়ে যায়। একসময় যেখানে ১৬০০টি পাণ্ডুলিপি ছিল, তা কমে মাত্র ৪০০-তে এসে দাঁড়ায়। এমনকি আজও বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ এই লাইব্রেরিতে আসেন শুধু প্রাচীন পাণ্ডুলিপি দেখার জন্য। এটি প্রমাণ করে যে, এই প্রতিষ্ঠান শুধু প্রাচীনতা নয় বরং এক মহামূল্যবান ঐতিহ্য ও জ্ঞানের ভাণ্ডার।
আধুনিক উচ্চশিক্ষার ধারণার ভিত্তি ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে নিহিত। ফাতিমা আল-ফিহরি এমন একটি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন যেখানে দার্শনিক ও বিজ্ঞানীরা একত্র হয়ে জ্ঞানচর্চা করতে পারেন এবং তা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দিতে পারেন। ইউরোপের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেমন বোলগনা (১০৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত) ও অক্সফোর্ড (১০৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত) অনেকাংশেই আল-কারাউইয়িন-এর শিক্ষাব্যবস্থাকে অনুসরণ করেছে।
উপসংহার:
মরক্কোর ফেজ শহরে অবস্থিত আল-কারাউইয়িন বিশ্ববিদ্যালয় কেবল গিনেস রেকর্ডধারী প্রাচীনতম উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানই নয়, বরং মুসলিম শিক্ষাব্যবস্থার বিকাশে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করে আসছে। এই ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠানটি যুগে যুগে তার জ্ঞানভাণ্ডার ও শিক্ষাগত ঐতিহ্য দিয়ে বিশ্বসভ্যতাকে সমৃদ্ধ করে চলেছে।