আফগানিস্তানে নারীশিক্ষা ও ইসলাম
আফগানিস্তানে তালিবানরা বিশ্বমোড়ল আমেরিকার নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটকে দীর্ঘ দুই-দশকের লড়াই-এ পরাস্ত করেছে। ভিয়েতনামের পর (১৯৫৫-১৯৭৩) এটি আমেরিকার দ্বিতীয় বড় পরাজয়। এই অসাধ্যসাধারণের সত্বেও যে তারা পশ্চিমা সভ্যতা সংস্ক্তিকে লালন-পালন করবে না বা প্রশ্রয় দিবে না এটাই স্বাভাবিক। এ পর্যন্ত ঠিকই ছিল। কিন্তু তারা প্রথম থেকেই যেভাবে নারীশিক্ষা প্রতি বৈষম্য ও অনীহা প্রকাশ করে চলেছে বা সীমাবদ্বতা চাপিয়ে দিতে চায়ছে– তাতে অন্যরা দূরে থাকুক , তাদের প্রতি সহানুভুতিপ্রবণ মুসলিম দেশ গুলিকেও ভাবিয়ে তুলছে। সম্প্রতি তারা সে দেশর বিশ্ববিদ্যালয়ের দেউড়িতে মহিলাদের প্রবেশধিকার বন্ধের যে ঘোষণা দিয়েছে তাতে মুসলিম –বিশ্বের ক্ষোভ তিব্রভাবে প্রকাশ পেয়েছে।
প্রশ্ন হল, যে ইসলামের নামে সেখানকার নারীদের উচ্চশিক্ষায় লাগাম পরিয়ে লক্ষনরেখা টানা হচ্ছে সেই ইসলাম তাদের এই সিদ্বান্তকে কতটা সমর্থ করে? পবিত্র কুরানের অবতীর্ণ প্রথম আয়াত হল,”ইকরা” যার আর্থ হচ্ছে ‘পড়’ । (সুরা আলাক,আয়াত-১)। প্রভুর নাম সহকারে পড়ার এই যে নির্দেশ বা উপদেশ আছে। নাবি কারিম (সাঃ) হাদিস শরিফে ইরশাদ করেন যে :- “জ্ঞান অর্জন করা প্রতিটি মুসলিম পুরুষ ও নারীর জন্য অপরিহার্য “। আমরা এই হাদিস থেকে বুঝতে পারি যে,যেমন করে পুরুষদের উপর জ্ঞান অর্জন করা অপরিহার্য তেমন ভাবে নারীদের উপরেও জ্ঞান অর্জন করা অপরিহার্য তাতে কোন সন্দেহ নেয়। আর হাদিসে বর্ণিত আছে যে , “জ্ঞানসাধকের দোয়াতের কালী শহিদের রক্তের চাইতেও পবিত্র” বা “রাতে কিছুক্ষণ জ্ঞানসাধনা করা সারা রাত জেগে নফল ইবাদাত করার চাইতেও উত্তম। তখন কি তাতে নারীদের উপর কোনও প্রতিবন্ধকতা আরোপ করা হয়েছে? তাই বলতেই হয়, আফগানিস্তান যে ইসলামের দোহাই দিয়ে নারীদের উচ্চশিক্ষার প্রতি প্রতিবন্ধতা আরোপ করতে চাইছে তা ইসলাম কখনও সমর্থ করে না । পিছেয়েপড়া দেশ হিসেবে এই ভাবনা ভাবতে পারছে বলে মনে হয় । আমাদের দেশও একসময় নারীদের শিক্ষা নিয়ে তুলকালাম করেছে একই কারণে। আশার কথা এই যে, সইদি আরব ,কাতার,আরব আমিরাত, তুরেস্কের মতো মুসলিম দেশগুলি আফগানিস্তানে নারীদের বিশ্ববিদ্যালিয়ে প্রবেশধিকারে প্রতিবন্ধকতা আরোপের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ জানিয়েছে । এ ক্ষেত্রে মনে হয়, তালিবানদের কোনও মহল ভুল বোঝাচ্ছে ।
উপযুক্ত পরিমাণ বিশ্ববিদ্যালয় যদি না থাকে বা তার উপযুক্ত পরিকাঠমো না থাকে তাহলে কেন নারীরাই বঞ্চিত হবে – এ প্রশ্ন তো স্বাভাবিক । সমস্যা থাকলে তার সমাধান কোন প্রাধান্য পাবে না । বিকল্প বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগ কেন নেওয়া হচ্ছে না? যতদিন বিকল্প বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করা যেতেই পারে। এরকম ব্যবস্থাপনায় ইসলামে তো তেমন কোন বাধা নেই। প্রয়োজনে যে একসঙ্গেও শিক্ষা নেওয়া যায় তার দৃষ্টান্তের অভাব ইসলামে নেই। ইসলামের ইতিহাসে এমন বেশ কিছু মহিলা হাদিসবেত্তার নাম পাওয়া যায়, যারা শুধু ঘরের মধ্যেই বিদ্যাচর্চা করতেন না। তারা রীতিমত প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষাদানও করতেন – উচ্চপর্যায়ের। তাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেক পুরুষও থাকতেন । সেই সব মহিলা হাদিসবেত্তাদের কাছ থেকে শিক্ষাসমাপনান্তে সার্টিফিকেটও প্রাপ্ত হতেন । অর্থাৎ, মহিলা হাদিসবেত্তারাও তাদের ছাত্র- ছাত্রিদের শিক্ষাদান শেষে সার্টিফিকেট প্রদানের যোগ্য অধিকারী ছিলেন এবং তা সর্বত্র স্কীকৃতি বা মর্যাদাও পেত। এমনই কয়েকজন বিদুষী মহিলা হাদিসবেত্তাদের একজন – আমরা বিনতে আব্দুর রহমান (তাবেউন) । তার হাদিসের ক্লাসের শিক্ষা নিয়ে যারা বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করেন তাদের অন্যতম ছিলেন ‘৫ম খালিফা ‘ হযরত উমার বিন আব্দুল আযীযের শসনামলে পবিত্র মদিনা নগরীর বিচারক আবু বকর বিন হাযম।আম্রা–র হাদিসের উপর উন্নত ব্যাখ্যায় খালিফা এতটাই সন্তুষ্টচিত্ত হন যে, তিনি আবু বকর বিন হাযমকে নির্দেশ দেন – আম্রা কাছে যত হাদিস রয়েছে তা যেন লিপিবদ্ধ করে নেওয়া হয় ।
আম্রার মতই ভুমিকা পালন করেন – নাফিল করেন । নাফিসা (হাসান বিন যিয়াদেরকন্যা) , আবিদা , আর যায়নাব বিনতে সুলাইমান (মৃত্যু ;১৪২ হিজরী ) প্রমুখ। এদের মধ্যে আবিদা প্রথম জীবনে ক্রীতদাসী ছিলেন। এর পরও তিনি জ্ঞানের আলোর জগতে বিচরণ করেন। আর যায়নাব ছিলেন আব্বাসী খালিফা বংশের কন্যা। তার পিতা সুলাইমান ছিলেন আব্বাসী বংশের প্রতিষ্ঠাতা আল্ সাফ্ফার ভ্রাতুষ্পুত্র।
আহমাদ দুহিতা ফাতিমা (মৃত্যু ;৪৬৩ হিজরি) আর এক উজ্জ্বল নাম । তিনি সহিহ আল্-বুখারীর ব্যাখ্যাতা হিসেবে প্রসিদ্ধি অর্জন করেন এবং বহু নারী –পুরুষ শিক্ষার্থীকে হাদিসের শিক্ষা দান করেন । এমন জানা যায় , আফগানিস্তানের হিরাতের বিখ্যাত হাদিসবিশারদ আবুযার ফাতিমা উচ্চ প্রশংসা করেন এবং পুরুষ শিক্ষার্থীদের বুখারী শরীফের পাঠ নিতে উৎসাহিত করেন । ‘ক্যালিগ্রাফি বিশেষজ্ঞ, হাদিসের মহান কর্ত্রী ও নারীত্বের গৌরাভ ‘ আখ্যা দেওয়া হয় শুদা বিনতে আবু নাসের (মৃত্যু৫০৬ হিজরি ) । শুদা সহিহ আল্ –বুখারীর উপর যে বতৃত্তগুলি করতেন তার আকর্ষণে বহু নামী ছাত্ররাও অংশ নিত । শুদার জ্ঞানের সৈরভ এতটাই ছড়িয়ে পড়েছিল যে ‘ তার ছাত্র’ এই পরিচয় দেওয়াটা গর্বের বিষয় হয়ে উঠেছিল। এই রকম বহু প্রসিদ্ধ মহিলা হাদিসবেত্তার নাম করা যায় যাদের কছে হাদিসের (এবং পবিত্র কুরানেরও বটে) ন্যায় খাঁটী ইসলামি শিক্ষানিতে পুরুষরা যেমন কুণ্ঠিত ছিলেন না, তেমনি সেই সব প্রাজ্ঞ মহিলা মনীষীরাও পুরুষের সামনে পাঠ দানে শঙ্কাবোধ করতেন না ।
হাদিস শাস্ত্রকারদের মধ্যে অতি প্রসিদ্ধ নাম ইবনে হাজার আসকালানী । তিনি একটি অমুল্য জীবনীগ্রন্থ রচনা করেন যারা হাদিস শাস্ত্রে বিশেষ অবদান রেখেছেন । গ্রন্থটির নাম- “আর-দুরার আল –কামীনাহ্। তিনি এই গ্রন্থে অষ্টম হিজরীর ১৭০ জন বিশিষ্ট মহিলা সাহাবীর নাম তাদের জীবনপঞ্জী-সহ উল্লেখ করেছেন।
একসময় কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতা, লেনিনের সহকারি এম,এন রায় (মানবেন্দ্রনাথ রায়) তার কারাবস্থায় লেখা বই “দ্য হিস্টারিক্যাল রোল অফ ইসলাম” বলেভহেন ; “ ইসলাম যে আদর্শবাদের জন্য দিয়েছে ,তা-ই কালে-কালে জগতে নানা সামাজবিপ্লবে সাহায্য করছে”। ইসলাম শিক্ষাক্ষেত্রেও এই সমাজবিপ্লবী অবদান রেখেছেন । সেকালের মুসলিমরা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ছিল প্রাগ্রসর সমাজ । তাদের হাত ধরেই আধুনিক রেনেসার সুত্রপাত । বিশ্বনাবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) তার বিপ্লবী আদর্শ প্রতিষ্ঠায় নারীদের অধিকার ও মর্যদা প্রদান করেন। তাঁর স্ত্রীরাও জ্ঞানার্জন বিদুষী হয়ে উঠেছিলেন। মা আয়শা (রাঃ) ছিলেন শ্রেষ্ঠ হাদিস সংগ্রহকদের অন্যতম। তিনি সাহাবাদেরও পবিত্র কুরানের অর্থ বুঝাতে সাহায্য করেন।অনেকের মতো তিনিও কবিতা রচনা করেন । ইসলাম উপর থেকে বিধি-নিষেদ আরোপের চাইতে আত্মশক্তি জাগ্রত করে অশ্লিলতার মতো বিষয়গুলি প্রতিরোধে বেশি গুরুত্ব দেয়। যারা পাশ্চাত্য দেশ –সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অফিস-আদালাত , সংসদ , শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান , খেলার আসর , হোটেল, রাস্তাঘাতে যে হিজাবের অধিকার নিয়ে লড়াই করছেন তারা তো এই ঈমানের আত্মশক্তির জোরেই করেছেন।
প্রসঙ্গত বলতে হয়, বাংলার বিদুষী নারী , নারী জাগরণের অগ্রপথিক বেগম রকেয়া কখনই ইসলামি শরীয়তকে উপক্ষা করার কথা বলেন নি , বরং ইসলামি শরীয়াতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকেই তিনি নারীজাগরণের কথা বলেন । আজকের আফগানিস্তাঙ্কে যদি এগিয়ে যেতে হয়,তবে ইসলামের এই প্রগতিশীল তাকে অবলম্বন করেই এগোতে হবে নচেৎ পিছিয়ে পড়তেই হবে । সে বিষয়ে সরকার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন বলে ইতিমধ্যে জানিয়েছেন তালিবান মুখপত্র সুহেল শাহিন । সুহেল শাহিন বলেছেন ,যে এটা স্পষ্ট করে দিতে চাই , উচ্চশিক্ষা গ্রহনের ক্ষেত্রে মেয়েদের ওপর চিরতরে নিষেধাজ্ঞা চাপানো হয়নি। যতক্ষণ পর্যন্ত পরিস্থিতি অনুকুল না হয়। তা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। যষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত নাবালিকাদের পঠন- পাঠন জারি থাকছে। তাঁরা দাবি,’ আফগানিস্তান ‘ মেয়েদের উচ্চশিক্ষার বিরোধী নয় সরকার । তবে তার জন্য অনুকুল পরিবেশ প্রয়োজন ।