দেশে শুধু সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ নয়, ভাষাগত বিদ্বেষও আছে, কেন?
ভাষারও ধর্ম থাকে কি করে?
প্রতি বছরের মতো এবারেও ১৮ই ডিসেম্বরে পালিত হল বিশ্ব আরবি দিবস। হ্যাঁ, আরবী ভাষা দিবস। অনেকেই এই আরবি কিংবা সংস্কৃত ভাষা দেখা বা শুনা মাত্রই কেটে পরে। কেন? প্রতুত্তের অধিকাংশই বলবে, আরবি মুসলমানদের ভাষা ও সংস্কৃত হিন্দুদের ভাষা। কিন্তু তাদেরকে আমার একটি প্রশ্ন, ভাষারও কি ধর্ম রয়েছে? আরবি যদি মুসলিমদের মাতৃভাষা হয়, তাহলে পূর্ব বাংলার সাত কোটি মুসলিমদের মাতৃভাষা বাংলা কাদের ভাষা? যদি উর্দু মুসলিমদের ভাষা হয়ে থাকে তবে পাকিস্তান দ্বিরাষ্ট্রে পরিণত হয়ে বাংলাদেশের সৃষ্টি কেন হয়েছিল? তারা কী মুসলিম ছিল না? তাছাড়া বর্তমানে যে সাতান্নটি মুসলিম দেশ রয়েছে সেই সকল দেশের সংখ্যালঘুদের (অমুসলিমদের) মাতৃভাষা কি আরবি ভাষা নয়? খলিল জিবরান খলিল, মিখাইল নাইমার মতো আরবি সাহিত্যিকরা কিংবা ফিরাখ গোরাখপুরি, মুনশি শঙ্কর লাল সাকির মতো উর্দু সাহিত্যকরা কি অমুসলিম ছিল না? হ্যাঁ, তাঁরা ছিল অমুসলিম (খ্রিষ্টান, ইহুদি কিংবা হিন্দু)। এমনকি বাঙালি লেখক ও সাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ, ভাষাবিদ ড. শহীদুল্লাহ তারা কি সংস্কৃত জানতেন না? যদি সংস্কৃত হিন্দুদের ভাষা হয় তবে তাঁরা কি মুসলিম ছিলেন না? অবশ্যই তাঁরা ছিল একজন প্রকৃত মুসলিম ও তার সাথে সাথে ছিল একজন প্রকৃত বাঙালী ও একজন প্রকৃত ভাষাপ্রেমী।
ভাষা পার্থক্য নির্বিশেষে ঈশ্বর কি সব প্রার্থনা শোনেন না?
ভগবান তো সব ভাষায় বোঝেন, তাই না? ঈশ্বর তো ভাষার কোনো ধর্ম দেয়নি। তবে কেন একেপরের প্রতি ভাষা বিদ্বেষ। আল্লাহ তো নিজেই বলেছেন, কেবল বলেই থাকেননি বরং তাগিদ দিয়ে বলেছেন যে, আমি কোনো নবী-রসূলকে (দূত) প্রেরণ করিনি ব্যাতীত তাদের স্বজাতির (কওমের) ভাষায় যেন তাঁরা তাদেরকে আমার বাণী স্পষ্টভাবে বোঝাতে পারে।(সূরা ইব্রাহীম:৪) অতএব বোঝা যায়, তিনি সকল ভাষা বোঝেন। সুতরাং তিনার সদিচ্ছা, মানব যে ভাষায় বুঝতে পারবে সেই ভাষাতেই ধর্মকে বোঝাতে হবে যেন সকলেই তাঁকে বুঝতে পারে। এছাড়াও বোঝা যায়, ভাষা মূলত মানুষের একেপরের ভাব-ভঙ্গিমা, চিন্তা-ধারণা, ইচ্ছা-আকাঙ্খা প্রকাশের মাধ্যম। আর বাস্তবে তো এটিই ভাষার প্রকৃত সংজ্ঞা। সমগ্র ধর্মের অনুসারীরা তো আস্ত একটা মানব। তবে কেন এই ভাষা বিদ্বেষ? মহাভারত, রামায়ণ কোন ভাষায় রচিত--সংস্কৃতিতে তায় না? তবে কেন তাকে বাংলায় বা অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ করা হল? এমনকি অন্যান্য ধর্মের ধর্মগ্রন্থগুলিও তো পৃথিবীর নানা ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। যদি ঈশ্বরের ভাষা একটিই হত তবে তো মানুষ একটি ভাষাতেই কথা বলত, তাই না? কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বর হলেন প্রজ্ঞাময়। তিনি সকল ভাষায় বোঝেন। সকল ভাষাতেই তিনাকে আরাধনা করা যায়। তিনাকে যে ভাষাতে ডাকা হয় সেই ভাষাই তিনি বোঝেন। তবে হ্যাঁ, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তিনাকে তিনার প্রিয় ভাষায় ডাকা হলে শ্রেয়। উদাহরণস্বরূপ, মুসলিমদের নিকট আরবী, হিন্দুদের নিকট সংস্কৃত, ইহুদিদের নিকট হিব্রু। তবে সেই ভাষাগুলি যে সেই ধর্মেরই ভাষা তা কিন্তু কখনোই না। যেমনকি পবিত্র কুরআনে আরও বলা হয়েছে, “আল্লাহর আরও একটি নিদর্শন হচ্ছে, নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের সৃর্জন এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র, নিশ্চয়ই এতে জ্ঞানীদের জন্য রয়েছে নিদর্শন।” (সূরা রুম:-২২) তাই তো কোনো এক কবি তার কবিতাতে কতই না সুন্দরভাবে বলেছেন, “যারে যেই ভাবে প্রভু করিল সৃজন/সেই ভাষা তার তরে অমূল্য রতন। আল্লাও বুলিছে, মুঞি যে দেশে যে ভাষ/ সে দেশে সে ভাষে কৈলু রসুল প্রকাশ”।
দেশে ভাষাগত বিদ্বেষের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
কিন্তু বড়ো দুঃখের বিষয়, আজ ভারতবর্ষের কিছু হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল এই ভাষা বৈচিত্রের ঐক্য, ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক মিলন ও একইছত্রকে ভঙ্গ করে একেপরের মাঝে অনৈক্য ও বিদ্বেষ সৃষ্টিতে লেগে পড়ে রয়েছে। এক ধর্মের সহিত আর এক ধর্মের। এক জাতির সাথে অন্য এক জাতি। এক জাতের সঙ্গে আরেক জাতের। এক বর্ণের সহিত আরেক বর্ণের। বাংলা, তামিল, তেলগু, মালয়ালাম ভাষার সহিত হিন্দি ভাষা। মোদ্দায়, এক ভাষার সহিত আরেক ভাষার দাঙ্গা বিবাদের প্রয়াস চালানো হচ্ছে। এমনকি, নানা কুচক্রান্তও করা হচ্ছে। আর এর ফাঁদেও পড়ছে অন্ধভক্ত ধর্মপিপাসুরা জনসাধারনরা। ঠিক যেমন ফাঁদে পড়েছিল সেই ১৯৪৭ সালে বাঙালীরা। অখন্ড ভারতকে ধর্ম ও দ্বিজাতির নামে বিভক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু হৃদয়ের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা সেই বিষ বের করেছিল ঠিক কয়েক বছর পরেই ১৯৫২ সালে। ঘোষণা দেওয়া হয় উর্দু পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা। অথচ, সেই সময় পাকিস্তানের ভাষা পরিসংখ্যানে ঊর্ধ্বে ছিল বাংলা ভাষা। সেই পরিসংখ্যনটি একবার দেখলেই তার সত্য অতিনিমিষেই উন্মচন হয়ে যায়। সেই সময় পাকিস্তানে (পাকিস্তান ও বাংলাদেশ) ৫৪.৬% নাগরিক বাংলা ভাষী ছিল, পাঞ্জাবি ছিল ২৭.১%, পুশতো ছিল ৬.১ %, উর্দু ছিল ৬%, সিন্ধি ছিল ৪.৮% এবং ইংরেজি ছিল ১.৪%। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে যে, যে ভাষাটি পাকিস্তানের পরিসংখ্যানে বলা যেতে পারে কমের দিক থেকে প্রথম, তাকেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। অতএব, জলের ন্যায় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, এটি ছিল কেবল এক রাজনৈতিক চক্রান্ত যা ছিল নিজেদের স্বার্থকে পূরণের অসীলা মাত্র। ছিল কেবল নিজেদের ক্ষমতা বহাল রাখা। ছিল দীর্ঘকাল রাজত্ব করার আকাঙ্খা। না ছিল কোনো ধর্মের নামে দেশভাগ।
মন্তব্য
এই ইতিহাস থেকে সকলের শেখার বিষয় ছিল যে ভবিতব্যে এমন আর যেন না ঘটে অথচ আজ সেটিকেই হাতিয়ার বানানো হয়েছে এবং ঠিক একই অবস্থা দেখা যাচ্ছে বর্তমান ধর্মনিরপেক্ষ, গণতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্র ভারতবর্ষেও। ভারতের ধর্মগত, ভাষাগত, জাত-জাতিগত সেই যুগ যুগের বৈচিত্রের ঐক্য, মিলন, বহুত্ববাদকে একদল নেকড়ের পাল গুড়িয়ে দিতে চাইছে নিজেদের রাজনৈতিক ক্ষমতারস্বার্থকে বহাল রাখতে। তারা ভূলে যাচ্ছে কবিগুরুর সেই অমূল্য বাণীকে, “হেথায় আর্য, হেথা অনার্য হেথায় দ্রাবিড় চীন / শক হুন দল পাঠান মোগল এক দেহে হল লীন”। অর্থাৎ, নানা ভাষা, নানা মত, নানা জাতি, নানা জাত বর্ণের মানুষ ভারতবর্ষের মাটিতে এক দেহে লীন হয়ে আছে যুগ যুগ ধরে। কিন্তু বড়ো আক্ষেপের বিষয়, সেই পরম্পরাকে ভাঙতে এক মূর্খের দল রাজনৈতিক ক্ষমতা হাসিলের লক্ষেই সেগুলিকে হাতিয়ার বানিয়ে দেশের মধ্যে অপ্রত্যাশিত ও ক্ষতিকারক বিদ্বেষের বীজ রোপন করছে সাধারণ মানুষের হৃদয়ে।
সুতরাং, এমতাবস্থায় দেশের স্বার্থে দেশের জনগনের স্বার্থে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে হিন্দু-মুসলিমসহ সকল সম্প্রদায়ের মানুষ বিশেষ করে বিপক্ষ দল প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারলে, ভারত যে এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সম্মূখিন হবে তা কখনো অপ্রত্যশিত নয়।