জলের উপর পানি: সদ্য সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরষ্কার প্রাপক এক উপন্যাস

ভারতের সর্বোচ্চ ভাষা সাহিত্য পুরষ্কার জ্ঞানপীঠ পুরস্কারের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পুরষ্কার হল সাহিত্য অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডএই পুরষ্কারটি প্রতি বছর ভারতের বিভিন্ন ভাষায় রচিত উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, ছোটোগল্পের সংকলন বইগুলিকে ভাষা সাহিত্যের জন্য প্রদান করা হয়। ২০২৩ সালে বাংলা ভাষায় ‘জলের উপর পানি’ উপন্যাসের জন্য এই পুরষ্কারের অধিকারী হন স্বপ্নময় চক্রবর্তী। যার জেরে, অধিশীঘ্রই পুস্তকটি গ্রন্থাগারে নিয়ে আসা হল এবং বইটি দেখা মাত্রই হাতে তুলে নিলাম ও দীর্ঘ কয়েকদিন পর পাঠ করা সমাপ্তও করলাম। বই পর্যালচনায় বিশেষজ্ঞ না হলেও পড়া শেষ হওয়া মাত্রই এর বই পর্যালোচনা লেখা একান্ত প্রয়োজন বলে মনে করলামতাই, কলম হাতে তুলতে আর মোটেই বিলম্ব করলাম না। 

  • লেখক পরিচিত

স্বপ্নময় চক্রবর্তীর ২৪ আগস্ট, ১৯৫১ সালে উত্তর কলকাতায় জন্মগ্রহন করেনতিনি রসায়নে বিএসসি (অনার্স), বাংলায় এমএ, সাংবাদিকতায় ডিপ্লোমা করেছেন। তিনি সাহিত্যজীবন শুরু করেন সত্তর দশকে। প্রথম দিকে কবিতা লিখতেন কিন্তু গল্প ও উপন্যাসেই তিনি প্রসিদ্ধি লাভ করেতিনি প্রায় ৩৫০টি গল্প লেখেনতিনার প্রথম উপন্যাস ‘চতুষ্পাঠী’ প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে শারদীয় আনন্দবাজার পত্রিকায়। তিনি বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধ এবং কলাম কিংবা রম্যরচনাতেও সিদ্ধহস্ত। তাঁর রচিত ‘হলদে গোলাপ' উপন্যাসটি ২০১৫ সালে আনন্দ পুরস্কারে সম্মানিত হয়। ‘অবন্তীনগর' উপন্যাসের জন্য ২০০৫ সালে বঙ্কিম পুরস্কার পান তিনি। এ ছাড়া মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পুরস্কার, সর্বভারতীয় কথা পুরস্কার, তারাশঙ্কর স্মৃতি পুরস্কার, গল্পমেলা, ভারতব্যাস পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেনসাহিত্যের বাইরে তিনি গণবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। এবং তিনার জনপ্রিয় ও শ্রেষ্ঠ সাহিত্য হল এই উপন্যস যার জেরে তিনি ২০২৩সালে সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরষ্কার প্রাপক হন।

  • নামকরণ 

লেখক এই নামটি গৌতম ঘোষ পরিচালিত ‘মনের মানুষ’ চলচ্চিত্রের ব্যবহৃত শাহযাদ ফিরদাউস রচিত একটি গানের প্রথম চরণের প্রথম অংশ থেকে নেন। প্রথমবার শিরোনামটি শুনেই বা দেখেই হয়তো ভাবছেন যে, এ আবার কেমন নাম? জল বা পানির মধ্যে পার্থক্যটা কী? দুটোই তো একই জিনিস। বিশেষ করে মুসলিম পাঠকগনের মনে এ সংশয় জাগবেই জাগবে। তাই প্রথমেই সংশয়টা মেটানো যাক। হিন্দি ও উর্দু ভাষায় জলকে পানি বলা হয় কিন্তু বাঙালি মুসলিমরাও জলকে সাধারনত পানিই বলে থাকে এবং হিন্দু বাঙালিরা জলকে জল বলে থাকে। তাই, যদি কোনো হিন্দু বাঙালি এই পানি শব্দটি কোনো ব্যক্তির নিকট হতে শুনে তবে অতি নিমিষেই চেনে ফেলে যে এ ব্যক্তিটি মুসলিম। আর যেহেতু এই বইয়ের মূল বিষয়বস্তুও হল হিন্দু ও মুসলিম। তাই এরই হেতু লেখক বইটির নাম ‘জলের উপর পানি’ রাখেন। কিন্তু ‘জলের উপর পানি’ কেন? কেন নয় পানির উপর জল? এই প্রশ্নের উত্তরে লেখক অবশ্য জবাব দিয়েছেন যে, শাহযাদ ফিরদাউস রচিত গানটি একবার পাঠ করলেই বুঝতে পারবেন যে কেন রাখা হয়েছে। তবে আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানের মতে, লেখক শিরোনামটি এই জন্যই দিয়েছেন যে, (তিনি এই পুস্তকে উল্লেখ করেছেন)পশ্চিমবঙ্গে ১৯৪৬ এবং ‘৬৪ পর কয়েকদিন ছাড়া মুসলিমদের উপর বড় ধরনের নিপিড়ন হয়নি। যেসব মুসলিম পশ্চিম থেকে পূর্বে গেছে বেশিরভাগই স্বেচ্ছায় গেছে। বিতাড়িত হয়ে নয়, কোনো কোনো এলাকা থেকে আতঙ্কিত হয়ে শান্তির অভিপ্রায়ে গেছে”। অতএব উদ্ধৃত অংশটি থেতে বোঝা যাচ্ছে যে মুসলিমদের উপর তেমন এক অত্যাচার হয়নি বরং হিন্দুদের উপরই বেশি অত্যাচার হয়েছে। যার জেরে লেখক ‘জলের উপর পানি’ রেখেছেন, পানির উপর জল নয়। 

তিনার এই দাবি কতটা সত্য তা আমি সমালোচনা করতে চাইনা, তবে বর্তমানে যে ভারতবর্ষে মুসলমানদের উপর অত্যাচার নিপিড়ন চলছে তা নিয়ে লেখককে অবশ্যই ‘পানির উপর জল’ শীর্ষক অন্য একটি উপন্যাস লেখা একান্ত প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। যেহেতু এই উপন্যাসে তিনি ১৯৯৮সাল পর্যন্তই থেমে গিয়েছেন। অতএব, অবশ্যই লেখককে ১৯৯৮ থেকে আজ পর্যন্ত যে ঘটনাবলী তা নিয়ে দ্বিতীয় পার্টটি লেখা অত্যন্ত জরুরী 

  • বইপ্রেক্ষাপট-

উপন্যাসটির প্রথম সংস্করণ ২০২১ সালের ১ ডিসেম্বর দেজ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত হয়। বিভিন্ন প্রচ্ছেদে বিভক্ত এই উপন্যাস। সেই প্রচ্ছদগুলি এঁকেছেন দেবব্রত ঘোষবইটি উৎসর্গ করা হয়েছে সাহিত্যিক প্রফুল্ল রায়-কে। বইটি ৪৩২ পৃষ্ঠায় রচিত। স্বপ্নময় চক্রবর্তীর অন্যান্য উপন্যাসের মতোই এটিও তন্নিষ্ঠ গবেষণার ফসলযদিও লেখকের মতে এটি একটি প্রেমের উপন্যাস। তিনি এই বইটি সম্পন্ন করতে নানা গ্রন্থপুঞ্জি ব্যবহার করেছেন যা তিনি বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠায় আলোচনা করেছেন। তিনি যে এক দীর্ঘ সময়ের সত্য ভিত্তিক ঘটনা একটি উপন্যাস হিসেবে প্রনয়ণ করেছেন তা বাস্তবেই সাহিত্য অ্যাকেডেমি পুরষ্কারের গ্রহণযোগ্য।

পুস্তকটি মূলত চলিত ভাষায় রচিত কিন্তু কিয়দংশে বঙ্গালী ভাষারও প্রয়োগ করা হয়েছে। হয়তো পাঠকগণ পড়তে একটু বিরক্তি বোধ করতেই পারেন তবে তাতে কোনো অসুবিধের কারণ বলে আমি মনে করিনা বরং তা সুবিধারই এক ফলক হিসেবে বিবেচিত করি। যেহেতু সেই ভাষাগুলি যখন কোনো পুস্তকে লেখা হয় তা দ্বারা বাস্তব ও প্রকৃত চিত্রটি পরিষ্ফূটিত হয়। মনে হয় যেন তেমনই এক পরিবেশে মুখোমুখি ঘটনাটি ঘটছে।

এছাড়াও পুরো বই জুড়ে অনেক সংস্কৃত শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন। যা অর্থবহ এবং আনন্দদায়ক বাগ্মিতা প্রদান করে। উদাহরণস্বরুপ, "কৃতং মৌনং কোকিলৈজলদাগমে/ দর্দুরা যত্র বক্তারস্ত্রত মৌনং হি শোভনম”অর্থাৎ, কোকিল বর্ষাকালে গান গায় না কারণ পাখিদের কিচিরমিচির করার সময় এটি করা তার পক্ষে অশোভন। ইদৃশ বর্তমানেও প্রাসঙ্গিক শ্লোকগুলি তুলে ধরেছেন। তাছাড়াও ব্যবহার করা হয়েছে বেশকয়েকটি প্রবচন, প্রবাদ ও ধাঁধা।

গ্রন্থটি অধিকাংশই সত্য ইতিহাসে পরিপূর্ণ কিন্তু ঘটনাগুলি ধারাবাহিকভাবে ব্যাখ্যা করা হয়নি। হয়তো এটিও পাঠকগন একটি জটিল বিষয় মনে করবে কিন্তু প্রথমেই বলা হয়েছে; লেখক এটিকে কোনো ইতিহাসের গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত করেননি বরং তিনি এটিকে একটি উপন্যাস হিসেবেই প্রনয়ণ করেছেন। তাই তিনাকে উপন্যাস হিসেবে ঘটনাগুলিকে খ্যাপ খাওয়াতে হয়েছে। যার জেরে একটু উলোট পালোট করেই লেখা হয়েছে। সুতরাং, কোনোভাবেই লেখক দোষারোপ করা যায় না বরং এই কৃতিকার্যের জন্য লেখককে স্বাগতই জানাতে হয়। আর যদি আপনি সত্যিই ইতিহাসই জানতে চান তবে এমন এক সাহিত্যরসে পরিপূর্ণ বই হাতে না তুলে কোনো ইতিহাস বই হাতে তোলায় শ্রেয়। 

  • বইটির বিষয়বস্তু

উপন্যাসে অনঙ্গমোহন আর বিলু, এই দুইজনকে কেন্দ্রীয় চরিত্র মনে হলেও আসল প্রোটাগনিস্ট এখানে নিপীড়িত মানুষ ও তার দেশ। এই বই ইতিহাসের, দর্শনের, নৃতত্ত্বের, ধর্মচারণের, রাজনীতির, সমাজনীতির, মানবিকতার, ভালোবাসার। এই বিশাল ব্যাপ্তি নিয়ে এক মহাউপন্যাস 'জলের উপর পানি'। তার সাথে সাথে রয়েছে বাঙালির প্রেম, ভালোবাসা, মায়া-মমতা, সুখ-দুখ, আচার-আচরণ, সংস্কৃতি, রীতিনীতি ও দৈনন্দিন জীবনযাপনের ক্রিয়াকলাপ। এই উপন্যাসে পুরোপুরি বিংশ শতাব্দীর অখন্ড ভারতের অর্থাৎ ভারতীয় উপমহাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ও ধার্মিক প্রাসঙ্গিক বিষয়বলী তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষ করে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন থেকে আরম্ভ করে একবারে ১৯৯৮ সালের কুয়েম্বতুর বোমবিং আক্রমন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিক ঘটনাগুলি বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। কীভাবে একের পর এক বিভিন্ন রাজনৈতিক পার্টির প্রতিষ্ঠা ও তাদের ক্রিয়াকলাপ সমস্তই উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লেখ করা হয়েছে অখন্ড ভারত কীভাবে দ্বিখন্ডিত হয় এবং তা হইতে আবার পাকিস্তান কীভাবে দ্বিরাষ্ট্রে পরিণত হয়লেখক এতেই থেমে যাননি বরং ভারত ভাগের পরবর্তী যে দুর্বাস্থা তা সবিশেষ আলোচনা করেছেন। আলোচনা করেছেন পরবর্তী ধর্ম কেন্দ্রীক ইন্দো-পাক রাজনীতি। এছাড়াও রয়েছে ওপার থেকে আসা বা এপার থেকে ওপার যাওয়া ছিন্নমূল মানুষদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম। পরিষ্ফুটিত হয়েছে ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকা রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক ঘটনাবলী বিহারের দাঙ্গা, মুক্তিযুদ্ধ, জরুরি অবস্থা, নকশাল আন্দোলন, বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠা, মরিচঝাঁপি এবং অতি সম্প্রতি বাবরি মসজিদ ধ্বংসের উপখ্যানযেহেতু ধর্ম দেশভাগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, তাই বিভিন্ন জাতির ধর্ম ও রীতিনীতি নিয়ে, বিভিন্ন প্রসঙ্গে এবং বিভিন্ন চরিত্রদের মধ্যে বিস্তর আলোচনা উঠে এসেছে। মানব ইতিহাস জুড়ে ধর্ম কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে তার একটি বিবরণ পাওয়া যায় এই বইয়ে।

  • উপসংহার

আজ যদি একই বৃন্তে দুটি কুসুম হতো, তবে জাতিগত, সম্প্রদায়গত, ভাষাগত কিছুতেই অনৈক্য হত না বরং বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য গড়ে উঠত। গড়ে উঠত এক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এই লক্ষ্য উদ্দেশ্যকে পূরণ করতে লেখক সকল ধর্মেরই সমালোচনা করেছেন এবং পরিশেষে বলতে চেয়েছেন মানুষের ধর্মই হল মানুষত্ব, মানবিকতাযেমনকি লেখক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান হওয়ার আহব্বান করতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন, হিন্দু আর মোসলমান/ একই রক্ত একই জান/ দুনিয়াতে পইদা হইছ নিজ দোষে মইরো না/ দড়ি দিয়া বাইন্ধা রাখো, টানাটানি কইরো না।










Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter