ইসলামের ভাষায় ইকিগাই শিক্ষার ব্যবহারিকতা
পরীক্ষামূলক বাস্তবতা এবং তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক তথ্য ‘ইকিগাই: দ্য জাপানিজ সিক্রেট টু অ্যা লং অ্যান্ড হ্যাপি লাইফ’ (Ikigai: The Japanese Secret to a Long and Happy Life) বইটিকে শিরোনামের সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলে। বইটির এইসব বৈশিষ্ট্যই পাঠকদের মধ্যে আকর্ষণীয় প্রভাব সৃষ্টি করে। শিরোনামটির বাংলা অর্থ হয় - ইকিগাই: দীর্ঘায়ু, সুস্থ এবং আনন্দে ভরা জীবন যাপনের জাপানি রহস্য। অবশ্যই, বাংলাতেও সম্পূর্ণ বইটি অনুবাদ করা হয়েছে।
জাপানি বিশেষজ্ঞ স্পেনীয় হেক্টর গ্রাসিয়া এবং সাংবাদিক ফ্রান্সেস মিরালেসের লিখিত বইটি জাপানের ঐতিহ্যপূর্ণ ইকিগাই দর্শনের কথা তুলে ধরেছে যা দেশীয় মানুষ এখনও প্রয়োগ করে থাকে। উক্ত জীবনাদর্শ জাপানের ওকিনাওয়া, বিশেষ করে ওগিমিকে বিশ্বের দীর্ঘায়ু এবং সুপার-শতবর্ষের গ্রাম করে তোলে।
‘ইকিগাই’ - জাপানিদের দর্শনে একটি রহস্যময় এবং জাদুকরী শব্দ। এই শব্দটি দিয়েই আরম্ভ হয় বইটির শিরোনাম। নিজ ধর্ম ও সম্পর্কে কিঞ্চিত জ্ঞান রেখেও, সহজেই এই বই পর্যালোচনার লেখক নিজ নীতি ও আদর্শের সঙ্গে মিল খেয়ে যায় অনেক বৈশিষ্ট্য প্রত্যক্ষ করতে পেরেছে।
যাইহোক, ভাববার বিষয় প্রথম আদর্শের প্রয়োগ প্রচুর পরিমানে বিদ্যমান এবং দুর্ভাগ্যক্রমে দ্বিতীয়টি শুধুমাত্র গ্রন্থ-অক্ষরে রক্ষিত এক গর্বের উত্তরাধিকার। সহজ শব্দে, সাধারণ জাপানি বাসিন্দারা ইকিগায়ের আদর্শকে তাদের জীবনাদর্শে পরিবর্তন করেছে, আর সাধারণ মুসলমান ইসলাম প্রদত্ত প্রায় একই আদর্শকে ভুলে বসেছে। অন্যান্য অনেক বিষয়ের মতো, মুসলমানদের এই উপলব্ধি সম্পর্কিত যথেষ্ট জ্ঞান আছে কিন্তু, শুধুমাত্র বাস্তবসম্মত প্রয়োগই গুরুত্বপূর্ণ। কথাটি মনে রাখা উচিত: শব্দের চেয়ে কর্মের ওজন বেশি!
আশ্চর্যজনকভাবে কিছু কার্যকলাপ এবং তার গুণাবলী আপাতদৃষ্টিতে এতই সাদৃশ্যপূর্ণ যে মনে হচ্ছে আঞ্চলিক-ভাষিক বিভিন্নতার সঙ্গে একই অভিসন্ধি থেকে উদ্গত যেমন মুসলমান এবং জাপানিদের জন্য যথাক্রমে ইবাদত (উপাসনা) এবং ইকিগাই।
কিছু অপরোক্ষ উদাহরণ নিয়ে আসা যেতে পারে - ইকিগায়ের ভাষায় প্রথম নিয়ম: সক্রিয় থাকো; অবসর নেবে না। নবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর অবতীর্ণ স্বর্গীয় প্রত্যাদেশ পবিত্র কুরআনে বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের স্রষ্টা আল্লাহ তাআ'লা বলেন, “অতএব, আপনি যখন অবসর হবেন, তখন লেগে যান (অন্য কর্মে)।” (সূরা ইনশিরাক, ৯৪:৭)
স্পষ্টতই, এই অধ্যবসায় বা উপাসনাকর্মের ধারাবাহিকতাটি চূড়ান্ত লক্ষ্যের প্রত্যাশায় আন্তরিকতার সঙ্গে আনন্দ, উত্সাহ ও মধ্যম গতির সাথে সম্পন্ন হওয়া চায়। অন্যথায়, তাড়াহুড়ো এবং উদ্বেগের মধ্যে কিছু করা নিরর্থকতা; কোন ফায়দা নেয়।
অনুরূপ আর একটি উদাহরণ, একজন ভালো মুসলমানের পরিচয় হল তার সামাজিক হওয়া। যেমন নবী (সাঃ)-এর বাণী, “যে মুমিন ব্যক্তি মানুষের সাথে মেলামেশা করে এবং তাদের জ্বালাতনে ধৈর্যধারণ করে সে এমন মুমিন ব্যক্তির তুলনায় অধিক সওয়াবের অধিকারী হয়, যে জনগণের সাথে মেলামেশা করে না এবং তাদের জ্বালাতনে ধৈর্য ধারণ করে না।” (সুনান ইব্ন মাজাহ)
একই ‘সামাজিক অনুভূতি’ ওগিমির বাসিন্দাদের মধ্যেও পাওয়া যায় যারা স্বাভাবিকভাবেই ইকিগাইয়ের ‘অমৃত-মায়া’-এর সাথে জড়িত। প্রতিবেশীদের সাথে দেখা করা, বন্ধুত্ব তৈরী করা, অন্যদের সাহায্য করা, ভ্রাতৃত্বের অনুভূতি প্রভৃতি বার্ধক্য বিরোধী উপাদান এবং সুখের রহস্য। নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) তাঁর অনুসারীদের শিক্ষা দিয়েছেন: “যে ব্যক্তি চায় যে, তার রুযী (জীবিকা) প্রশস্ত হোক এবং আয়ু বৃদ্ধি হোক, সে যেন তার আত্মীয়তার সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখে।” (বুখারী ও মুসলিম)
“মানুষ পেটের চেয়ে নিকৃষ্ট কোন পাত্র ভর্তি করে না। আদম সন্তানের জন্য যতটুকু আহার করলে মেরুদন্ড সোজা রাখা সম্ভব, ততটুকু খাদ্যই তার জন্য যথেষ্ট। এরপরও যদি কোন ব্যক্তির উপর তার নফস (প্রবৃত্তি) জয়যুক্ত হয়, তবে সে তার পেটের এক-তৃতীয়াংশ আহারের জন্য, এক-তৃতীয়াংশ পানির জন্য এবং এক তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য রাখবে।” (সুনান ইব্ন মাজাহ)
উপরুক্ত নবীয় বাণী ইসলামের আদর্শ তুলে ধরে। ইকিগায়ের ঠিক অনুরূপ কথা, কিন্তু এক-তৃতীয়াংশের পরিবর্তে শতাংশের আশি বলা হয়েছে। মূল করণীয় কর্তব্য একই - সম্পূর্ণ পেট ফুলে খাওয়া চলবে না।
কিন্তু, দুর্ভাগ্যজনক বা বৈষম্যমূলক যাই বলা যাক না কেন এতো নিপুণতার সঙ্গে দুই আদর্শের মিলন হলেও ইসলামী শিক্ষার সামান্য পরিনাম বর্ণনা নেয় বইটিতে যেখানে লেখকদ্বয় ইসলাম ব্যাতিত ভিন্ন সভ্যতার ঐতিহাসিক ভাঁজে আটকে থাকা বিভিন্ন উদাহরণ বের করে এনেছেন। এর পিছনে যাই বা কারণ হোক না কেন, মুসলমানের অলসতার ফলে তাদের আমল বা ব্যবহারিক কর্মের সুন্দর ও একাডেমিক উপস্থাপনার অভাব তার মধ্যে একটি। (যদিও ইসলামী আমলের একমাত্র উদ্দেশ্য একমাত্র সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি এবং তাঁর সান্নিধ্য অর্জন)।
এছাড়াও, ইসলাম এবং ইকিগাইয়ের শিক্ষায় আরও অনেক নীতি, নিয়ম এবং অনুশীলন একই লাইনে নিয়ে আসা যেতে পারে। কিন্তু মৌলিক যে বিষয়ের ওপর বৈপরীত্য দেখা যায় সেটা হল বিশ্বাসের ক্ষেত্রে ইসলামের ভিত্তি তৌহিদ বা একেশ্বরবাদের ওপর গঠিত আর যেখানে ওগিমি বাসিন্দারা তাদের পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্যবাহী আইকনগুলির উপাসনা করে থাকে। দুই জীবনের সফলতার বাস্তবতা ইকিগাই জীবন আদর্শ এখনও উপলব্ধি করতে পারেনি। এই সিদ্ধিলাভের জন্য আন্তরিক প্রার্থনা থাকলো।
সমস্ত মতভেদ উপেক্ষা করে, স্বাস্থ্য, সুখ, উদ্দেশ্য এবং আয়ুষ্কালের ক্ষেত্রে সর্বাধিক পঠিত বই ইকিগাই এবং অবশ্যই পড়া বইগুলির মধ্যে একটি। স্পষ্টভাবে লেখার পাশাপাশি, লেখক বিশ্বের অন্যান্য কোণ থেকে সহায়ক তথ্য সহ জাপানিদের দীর্ঘ এবং সুখী জীবনের গোপনীয়তা প্রকাশ জন্য খুব ব্যাপক পদ্ধতি প্রয়োগ করেছেন। অবশেষে, বইটি অত্যন্ত আকর্ষক এবং সব বয়সের পাঠকদের পড়ার উপযুক্ত।