বই পর্যালোচনা: অনামারি শিমেলের এন্ড মুহাম্মাদ ইজ হিজ মেসেঞ্জার
“মুহাম্মাদের আগমন উম্মত যথা (মুসলিম) সম্প্রদায়ের জন্য সূরাহ ৯৭-এ উল্লেখিত ‘ফেরেশতাদের অবতরণ’-এর চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ, যেহেতু মুহাম্মদ ফেরেশতাদের থেকে শ্রেষ্ঠ…” (পৃ. ১৪৪)
ধ্রুপদী গ্রন্থ থেকে শক্তিশালী প্রমাণ, যুগ যুগ থেকে বর্তমান পর্যন্ত আবর্তিত ঐতিহাসিক ঘটনা ও সাংস্কৃতিক সূক্ষ্ম মসৃণ বর্ণনার সঙ্গে জার্মান প্রাচ্যবিদ পন্ডিত অনামারি শিমেল তাঁর ‘এন্ড মুহাম্মাদ ইজ হিজ মেসেঞ্জার’ বইয়ের মধ্যে প্রিয় নবীজির কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দিক চিত্রিত করেছেন। নবীজির (ﷺ) উম্মত মুসলিম সম্প্রদায় কেমন করে তাঁকে সম্মান, অনুসরণ ও উদযাপন করে খুব সুন্দরভাবে তিনি এই অধ্যয়নের মধ্যে তুলে ধরেছেন। ধার্মিক মুসলমানরা চূড়ান্ত রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি তাদের ভালবাসা প্রকাশ করতে কি কি বিষয়বস্তু অবলম্বন করে বইটিতে একটি বিশেষ কভারেজ পেয়েছে। উক্ত বৈশিষ্ঠটিই শিমেলের এই বইটিকে আকর্ষণীয়, মাধুর্যপূর্ণ ও সবার পাঠ্য করে তুলে।
লেখিকা ও তাঁর বই: একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ
অনামারি শিমিমেল (মৃ: ২০০৩) ইসলামী সুফিবাদ বিশেষজ্ঞ একজন জার্মান ওরিয়েন্টালিস্ট এবং প্রফুল্ল লেখক ছিলেন। সমসাময়িকদের বিপরীতে, তাঁর সুষম ও ন্যায্য পদ্ধতির জন্য তিনি ব্যাপকভাবে উদযাপিত। প্রাচ্য বিষয় উপস্থাপন করতে শিমেলকে অন্যদের তুলনায় অনেক সৎ ও নিরপেক্ষ হয়ে পাওয়ার যায। শিমেল রচিত জনপ্রিয় বইগুলির মধ্যে এটি সর্বশ্রেষ্ট।
‘এন্ড মুহাম্মাদ ইজ হিজ মেসেঞ্জার’ বইটি মূলত জার্মানিতে সর্বপ্রথম ‘উন্ড মুহাম্মদ ইস্ত সেইন প্রফেট’ (Und Muhammad ist sein Prophet) শিরোনামে প্রকাশিত হয়। পরে আরও সংযোগনের সঙ্গে ১৯৮৫ সালে উত্তর ক্যারোলিনা প্রেস দ্বারা প্রথমবার ইংরেজি সংস্করণ (And Muhammad is His Messenger) প্রকাশিত হয়। এই কাজটি বিশ্বজুড়ে ব্যাপক স্বীকৃতি পেয়েছে; গভীর গবেষণা, সুষম চিত্রনাট্য এবং ব্যাপক বর্ণনার জন্য উভয় প্রশংসা ও সমালোচনা দেখা যায়। পরবর্তীতে, সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে বইটি তুর্কি সহ অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষাতেও অনুবাদ করা হয়। এই বইটির মূল উপসংহার হল যে লেখিকা নবী মুহাম্মদ (ﷺ)-এর একটি চিত্তাকর্ষক বিবরণ উপস্থাপন করেছেন যাতে বর্ণনা করা হয়েছে যে কীভাবে মুসলমান অনুসারীরা তাঁকে (ﷺ) অনুধাবন করে, তাঁর প্রতি (ﷺ) শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে এবং তাঁকে (ﷺ) তাদের জীবনে উদযাপন ও অনুসরণ করে থাকে।
শিরোনাম এবং অন্যান্য অধ্যায়
‘ইসলাম ধর্মে নবীজির কেন্দ্রীয় অবস্থান’ সংজ্ঞায়িত করার জন্য ইসলামী বিশ্বাস স্বীকার্যের দ্বিতীয়ার্ধ (ওয়া মুহাম্মাদান রাসূলুহ) ওপর গঠিত ‘এন্ড মুহাম্মাদ ইজ হিজ মেসেঞ্জার’ (এবং মুহাম্মদ তাঁর রসূল) শিরোনামটি বেছে নেওয়া হয়েছে (শিমেল, ১৯৮৭, পৃ. ৩)। বারোটি অধ্যায়ে বিভক্ত, প্রথমে বইটি নবী মুহাম্মাদের (ﷺ) জীবনীমূলক এবং হাজিওগ্রাফিক নোট (পৃ. ৯-২৩) দিয়ে শুরু হয় যা আগামী আলোচনার জন্য একটি ভিত্ত উপাদান হিসেবে করে। পরবর্তী অধ্যায়গুলি বিশ্বব্যাপি মুসলমানরা প্রতিনিয়ত চর্চা করতে থাকে এমন বিভিন্ন ভক্তিমূলক দিক নিয়ে আলোচনা করে - নবীজির (ﷺ) ব্যক্তিত্ব বৈশিষ্ট্য এবং বিশেষ গুণাবলী যেমন সর্বোত্তম ভূমিকা, সৃষ্টির কারণ, স্বয়ং আল্লাহ কর্তৃক শেখানো উম্মী, মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান, শারীরিক এবং আধ্যাত্মিক সূক্ষ্মতা, নাম, নূর, অলৌকিক ঘটনা যেমন হৃদয় খোলা, চাঁদ বিভক্ত হওয়া এবং স্বর্গীয় আরোহ বা মিরাজ ইত্যাদি।
মওলিদ এবং এর উদযাপন অষ্টম অধ্যায়ে (পৃ. ১৪৪-১৫৮) আলোচনা করা হয়েছে। শেষ অধ্যায়ে নবীর সম্মানে আরবিসহ অন্যান্য স্থানীয় ও লোকভাষায় রচিত কবিতার সংক্ষিপ্ত বিবরন রয়েছে। বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি থেকে সংগৃহীত অনেক ক্যালিগ্রাফিক উপস্থাপনা এবং প্রেম লিপির মোটিফ বইটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যা এটিকে একটি জীবন্ত প্রাণবন্ত করে তুলে।
সারাংশ ও প্রস্তাবনার পাঠ
যেমনটি শিমেল তাঁর ভূমিকায় উল্লেখ্য করেছেন, সাধারণত এই বইটির মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে ‘তাঁর (ﷺ) প্রতি মুসলমানদের ভালবাসা কতটা গভীর, তাঁর (ﷺ) জন্য তাদের আস্থা কতটা উষ্ণ, মুসলিম মানসে তাঁকে (ﷺ) কতটা ব্যাপকভাবে সম্মান করা হয়… (পৃ. ৪)। অনুরূপ আলোচনা নিয়ে রচিত বর্তমানে এটি প্রথম বইগুলির মধ্যে একটি। সাম্প্রতিক সময়ে, বিখ্যাত ইবনে আরাবি বিশেষজ্ঞ ক্লদ অ্যাডাস তাঁর ঐতিহাসিক ‘হাউস অফ দ্য প্রফেট: ডেভোশন টু মুহাম্মাদ ইন ইসলামিক মিস্টিসিজম’ (House of the Prophet: Devotion to Muhammad in Islamic Mysticism) শিরোনামে উক্ত শ্রেণীর অনুরূপ পাণ্ডিত্যপূর্ণ একটি প্রচেষ্টা দেখিয়েছেন যেখানে তিনি নবীজির (ﷺ) অসাধারণ ও সম্পূর্ণ (কামিল) ব্যক্তিত্বকে কেন্দ্র করে তাত্ত্বিক দিকসহ এক মুসলিমের ব্যক্তিগত এবং সামাজিক পরিসরে পরিচালিতভ ভক্তিমূলক অনুশীলনগুলি ব্যাপকভাবে তদন্ত করেছেন।
ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিক সূত্রের ব্যাখ্যাসহ তুরস্ক থেকে মালয়েশিয়ায় অবস্থিত বিশাল মুসলমান সমাজের জাতিগত অনুশীলনের বিশ্লেষণ শিমিমেলের তদন্তে দেখতে পাওয়া যায়। অবশ্যই ভারতীয় ভৌগলিক স্তরও এই সীমারেখায় অন্তর্ভুক্ত। শিমেলের প্রায় রেফারেন্স সরাসরি ইসলামের প্রাথমিক উৎসের উপর ভিত্তি করে উদ্ধৃত। সুফি, দার্শনিক, কবি এবং মুসলিম ঐতিহ্য থেকে বিশিষ্ট সংস্কারক এবং তাদের মূল চিন্তাধারা ও মতবাদ এই বইটিতে বিশেষ স্থান পায়। তবুও, (বোঝাবার সহয়ার্থে) অদ্ভুতভাবে কিছু খ্রিস্টান নীতিমালার তুলনা এবং কিছু অযোগ্য দৃষ্টিভঙ্গির উপস্থাপন, এবং কখনও কখনও, কোন ব্যাখ্যা ছাড়াই অপরিচিত বিদেশী শব্দের ব্যবহার বইটির মধ্যে কিছু নিন্দার উপকরণ যা এক পাঠককে বিরক্ত করতে পারে। যাইহোক, যখন আবেগ এবং শ্রদ্ধা থাকে, তখন পাঠ্যটি স্বাদে মিষ্টি, গতিতে মৃদুভ প্রবাহমান এবং অনুভূতিতে প্রেমের জাগরণ হয়ে যায়।