বিষাদ সিন্ধু: এক পর্যালোচিত অমর উপন্যাস
কিছুদিন পূর্বে আমরা সকলেই আরবী হিজরী ক্যালেন্ডারের প্রথম ও আল্লাহর মাস মুহাররম মাসে পদার্পন করেছি। এই মাসে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনা। তাই ভাবলাম যে একজন মুসলিম হিসেবে এই প্রসঙ্গে কিছু জানা উচিৎ। তাই, গ্রন্থাগার থেকে তুলে নিলাম মীর মোশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’ উপান্যাস। কিন্তু পড়ার পর মনে হল, নিশ্চয় এর একটি পর্যালোচনা একান্ত আবশ্যক। তবে সাহিত্য সমালোচনার করার মতো অত জ্ঞান আমার নেই এবং কবি, পাঠক, সমালোচক যেই হোক না কেন তাদের প্রতিও আমার কোনো ক্রোধ, ঈর্ষা কিছুই নেই। তবে আমি মনে করি আমার এই ক্ষুদ্র জ্ঞান দ্বারা বইটি পর্যালোচনা করার প্রয়াস ব্যর্থ বা অগ্রাহ্য হবে না বরং নব-পাঠকগণেরই সুবিধা ও সহায়ক হয়ে উঠবে, প্রকৃত-সত্য বিষয়ই উন্মচিত হবে। এই আশা রেখেই পর্যলোচনাটি লিখতে বাধ্য হলাম।
- লেখক পরিচয়
ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যের অগ্রপথিক মুসলিম সাহিত্যক মীর মোশারফ হোসেন ১৮৪৭ খ্রীস্টাব্দের ১৩ই নভেম্বর তদানীন্তন নদীয়া জেলার কুষ্টিয়া মহুকুমার লাহিনীপাড়া গ্রামে (বর্তমানে বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলায়) এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন। তিনি বাংলা ভাষায় মুসলিমদের মধ্য হইতে প্রথম ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও গদ্যলেখক। এমনকি তিনি সাময়িক পত্র-জগতে মুসলমান সম্পাদিত প্রথম সাহিত্য পত্র ‘আজীজন নেহার’(১৮৭৪) নামক একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত করেন। তিনি মোট ৩৫টি গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। একাধারে প্রবন্ধ, উপন্যাস, প্রহসন, নাটক, জীবনি প্রভৃতিতেই সুখ্যাতি অর্জন করেন। তন্মধ্যে তিনার জনপ্রিয় ও সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা উপন্যাস ‘বিষাদ সিন্ধু’। অধিকন্তু তিনার প্রথম উপন্যাস ‘রত্নবর্তী’(১৮৬৯), প্রথম নাটক ‘বসন্তকুমারী’ (১৮৭৩), ‘জমিদার দর্পণ’ (১৮৭৩) নাটক, ‘গোজীবন’(১৮৮৯) প্রবন্ধ, ‘এর উপায় কি’(১৮৭৬) প্রহসনও বেশ কালউত্তীর্ণ হয়ে রয়েছে। পরিশেষে ১৯ ডিসেম্বর ১৯১২ সালে নবাবপুর, বালিয়াকান্দি, রাজবাড়ী হইতে এই দুনিয়া ফানিকে চিরতরে বিদায় দেন এবং পদমদীতে তিনাকে দাফন করা হয়।
- নামকরণ
গল্প, কবিতা, উপন্যাস যাই হোক না কেন মূখ্য ভূমিকা পালন করে এর নাম। নামের মাধ্যমে যেমন উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু প্রকাশ পায় তেমনি পাঠকদের প্রধান আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু প্রতিষ্ঠিত হয়। নামটাই বলে দেয় ভিতরের কাহিনীর খন্ডভাগ। লেখক শিরোনামটি প্রকাশ্য বিষয়বস্তু না নিয়ে অন্তর বিষয়বস্তু কেন্দ্র করে দিয়েছেন। নামটি যথাযথভাবে গ্রাহ্য ও আকর্ষণীয়। যেহেতু এই কাহিনি কেবল দুঃখ, মনবেদনা, হৃদয়বিদারক-এরই উপখ্যান।
বিষাদ সিন্ধু দুটি আলাদা আলাদা শব্দ। বিষাদ ও সিন্ধু। বিষাদ শব্দের অর্থ দুঃখ, বিষন্নতা, ভরাক্রান্ত ইত্যাদি এবং সিন্ধু শব্দের অর্থ সাগর বা সমুদ্র। সহজ কথায় বিষাদ সিন্ধু অর্থ দুঃখের সাগর বা দুঃখের সমুদ্র।
আবার কিছু ওলামা এবং শিক্ষাবীদগন আবার বিষাদ সিন্ধুর ব্যাখ্যা করেছেন একটু ভিন্ন ভাবে। তারা বলেছেন : বিষাদ শব্দের অর্থ বিষে ভরা এবং সিন্ধু হচ্ছে নদীর নাম। অর্থাৎ বিষে ভরা সিন্ধু নদীকেই বিষাদ সিন্ধু বলা হয়।
- পুস্তক সারসংক্ষেপ
প্রাচীন ও জনপ্রিয় উপন্যাসটি তিনটি পর্বে বিভক্ত। ১।মহরম পর্ব। এই পর্বে মোট ২৬ টি অধ্যায় রয়েছে। এই পর্বে লেখক এজিদের বর্বরতা, নিষ্ঠুরতারসহ ইমাম হাসানের মৃ্ত্যু ও হিজরি ৬১ সালে মহররম মাসে সংঘটিত কারবালার হৃদয়বিদারক মর্মান্তিক ঘটনা ও জয়নাল আবেদিনের বেঁচে যাওয়ার প্রসঙ্গে সমুদয় বৃত্তান্ত দিয়েছেন।
২।উদ্ধার পর্ব। এখানে মোট ৩০ টি অধ্যায় রয়েছে। কারবালার যুদ্ধ শেষ হবার পর এজিদ জয়নাল সহ, ইমাম বংশের সব মহিলাকে তারা গৃহবন্দী করে রাখেন। উদ্ধার পর্বে উল্লেখ আছে, মোহাম্মদ হানিফা এসে এজিদ গৃহে বন্দী ইমাম বংশীয় সকলকে উদ্ধার করবেন।
৩।এজিদ-বধ পর্ব। শেষ পর্ব এটি। উপসংহারসহ মোট ৬ টি পর্ব রয়েছে এই অংশে। এ পর্বে এজিদের বিনাস, জয়নাল আবেদীনের দামেস্ক সিংহাসন লাভের ঘটনা খুব সুন্দর ভাবে বর্নিত রয়েছে।
এগুলো যথাক্রমে ১৮৮৫, ১৮৮৭ ও ১৮৯১ সালে তিন ভাগে প্রকাশীত হয়। যা পরবর্তীতে বিষাদ সিন্ধু নামক একটি সম্পূর্ণ বই আকারে বের হয়। ২০১৬ সালে অধ্যাপক ফকরুল আলম কর্তৃক দঃখের মহাসাগর শিরোনামে বাংলা একাডেমী থেকে এটি সর্বপ্রথম ইংরেজিতে অনূদিত হয়। রচনার সময়, বাংলা খুব কম প্রকাশিত উপন্যাস ছিল এবং মোশারফ হোসেন বাংলা উপন্যাসের একটি নতুন ঐতিহ্যের পথিকৃৎ লেখক সম্প্রদায়ের অংশ ছিলেন।
- লেখার বৈশিষ্ট্য
বিশুদ্ধ বাংলায় এক বিশাল কলেবরের একটি ট্রেজেডি উপন্যাস। একটি সুখপাঠ্য মহাকাব্য! একটা সুখকর ইতি। অসাধারণ লেখনী। বাংলা সাহিত্যের দৃষ্টকোণে এক অমর পুস্তক। এই গ্রন্থটি একাধারে ইতিহাস-আশ্রিত রোমান্টিক ও গদ্য কাব্যোপন্যাস। সম্পূর্ণ উপন্যাসটি সাধু ভাষায় রচিত অথচ সহজবোধ্য ভাষারীতিতে রচিত। লেখকের লিখনশৈলীর প্রশংসা অবশ্য কাম্য। কিন্তু বইটির আদ্যপান্ত ভাষাগত কিছু বিষয় ইসলামি আকিদার সাথে যায় না। উপন্যাসটি যেহেতু বিশেষ করে হিন্দু পাঠকদের নিকট সহজে বোধগম্য যেন হয় সেজন্য লেখক তাদের ব্যবহার্য শব্দসমূহ দিয়ে উপন্যাসটি রচনা করেছেন। লেখক বারংবার আল্লাহকে ঈশ্বর বা ভগবান, নবীকে প্রভূ, সাহাবীকে শিষ্য, ইমাম বা মৌলভিকে পুরোহিত, নামাযকে আরাধনা বা উপাসনা বা ধর্মালোচনা, সালামকে নমস্কার বা প্রণিপাত, মসজিদকে মন্দির, মুআবিয়া (রা.) কে মাবিয়া বলেই উল্লেখিত করেছেন। এছাড়া যেইসব শব্দ মুসলিম সংস্কৃতিতে নেই সেগুলি বেশ ভালো করেই ব্যবহার করেছেন উদাহরণস্বরুপ- করজোড়ে প্রার্থনা, ভগবানের প্রসাদ, পদচুম্বন, পদধূলী গ্রহণ, সন্ধ্যাদেবী, সূর্যদেব ইত্যাদি ইত্যাদি। অনেকের আবার ধারণা এটি একটি জঙ্গনামা ও এই জাতীয় অন্যান্য পুঁথির সাধুভাষায় রূপান্তর মাত্র।
প্রকৃতপক্ষে বইখানা যখন প্রকাশিত হয় তৎসময়ে মুসলিম সম্প্রদায় শিক্ষার ক্ষেত্রে হিন্দুদের থেকে অনেক পিছিয়ে ও নিম্নবিত্ত মুসলমান ছাড়া অবশিষ্ট মুসলমানগন বাংলা চর্চা করতেন না বললেই চলে, আরবী ফার্সি উর্দুই ছিল তাদের প্রাত্যহিক ভাষা। তাই লেখক সেই দিকটিকে লক্ষ্য রেখে রচনাটিতে মনোনিবেশ করেছিলেন। রচনাকার পাঠকের বোধগম্য এবং ভাষা রুচির উপর ভর করেই রচনাটি শিল্প গুন করে তুলেছেন। লেখকের এই উদ্দেশ্যকে স্বাগত জানাতেই হয়।
- বিষয়বস্তু
উপন্যাসটিতে বিভিন্ন চরিত্র, মানবজীবনের বেদনা ও যন্ত্রনা, মানুষের প্রতি ঈর্ষা ও ঘৃণা চিত্রিত হয়েছে এবং একই সঙ্গে সিংহাসন নিয়ে সংঘর্ষ, সংগ্রাম, রক্তস্নান, হত্যা, রাজনৈতিক বন্ধনমুক্তি, মানুষের জীবন-মুক্তির সাধনা ইত্যাদির একটি ঐতিহাসিক পটভূমি তুলে ধরা হয়েছে। নারী, স্ত্রী, সপত্নিাবদ প্রসঙ্গে বাস্তববিক দিকগুলি বেশ ভালো করেই উল্লেখিত রয়েছে। তাছাড়া এই পুস্তকে যুদ্ধশাস্ত্রের নীতিনিয়ম, কিছু ক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়তের বিভিন্ন রীতিনীতিগুলিও তুলে ধরা হয়েছে। মোটকথায় লেখক উপন্যাসে তৎসময়ের রাজনৈতিক অবস্থা অঙ্কিত করেছেন।
লেখক উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভাবে গল্প এগিয়ে নিয়েছেন। পর্যায়ক্রমে ধীরে ধীরে খুব সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন সব কাহিনী গুলো। সাহিত্যমূলের দিক থেকে জয়নবকে মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্য বা চরিত্রের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। আবার কেউ ইলিয়াড কাব্যের হেলেন চরিত্রের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
- ঐতিহাসিক ও ধার্মিক দৃষ্টিপাত
বইটিতে এমন কিছু উপকাহিনী রয়েছে যা প্রকৃতিতে ঐতিহাসিক নয়। এর প্রধান চরিত্রগুলোর নাম এতিহাসিক, কিন্তু চরিত্র চিত্রয়াম ও অন্যান্য খুঁটিনাটির দিক থেকে কাল্পনিক। এটি ইতিহাস আশ্রয়ে রচিত বলা হলেও এই উপন্যাসে অসংখ্য অবিশ্বাস্যকর কাহিনী ফুটে উঠেছে। সাথে উপন্যাসে অসংখ্য বিভ্রান্তিকর ইতিহাসও তুলে ধরা হয়েছে যা অকল্পনীয়। উপন্যাসে দেখা যায়, ইমাম হোসেনের শির কাটার পর যখন সিমার তা এজিদের দরবারে নিয়ে পৌঁছায় তখন ইমামের শির আপনা-আপনি উপরে উঠতে থাকে। এবং একসময় অন্তর্ধান হয়ে যায়। উপন্যাসে আরও দেখা যায়, কারবালা প্রান্তরে ইমামকে দাফন করার জন্য তার মা-বাবা স্বর্গ থেকে নেমে আসে। সাথে আসে অসংখ্য পয়গম্বর-ফেরেশতা। পৌত্তলিক আজর যে নিজ হাতে তার তিন পুত্রকে হত্যা করলো- এই ঘটনা কোথায় পেয়েছেন? মোহাম্মদ হানিফা কর্তৃক এজিদ বধের ঐতিহাসিক ভিত্তি কী? রওজা শরীফ সাত বার তওয়াফ করতে হয়? প্রথমবার দেখলাম, তাও এই উপন্যাসে!…
এছাড়াও মুআবিয়া (রা.) মুত্রত্যাগকালে কুলুখের মাধ্যমে বিষগ্রস্থ হন এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে বর্ণিত ঘটনার সত্যতা কতটুকু? ভিত্তি কী? প্রকৃতিতে ইমাম হাসান, হোসেনের প্রতি এজিদের হিংস্র মনোভাব দামেস্ক সিংহাসন, রাজনৈতিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে কারবালার ঘটনা সূচিত হয়। কিন্তু উপন্যাসে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে উপেক্ষা করে জয়নাব (ইমাম হাসানের তৃতীয় স্ত্রী) প্রাপ্তি লাভ না হওয়াকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। ইয়াজিদের যে ক্ষমতা বাড়িয়ে নিজ শাসন দীর্ঘস্থায়ী করার রাজনৈতিক অপপ্রয়াস ছিল ষড়যন্ত্রের পেছনে মূল উদ্দেশ্য লেখক তা পুরো স্কিপ করে গেছেন। ধর্মীয় ব্যাখ্যার তুলনায় জয়নাবের রূপে আকৃষ্ট হয়ে তাকে পাবার আশায় এজিদের এক একটি কুকর্ম সাহিত্যরসে মিশ্রিত হয়ে উপন্যাসে স্থান পেয়েছে। তার ওপরে জায়েদার দ্বারা ইমাম হাসান (রা.) কে বিষ প্রয়োগে হত্যার ইতিহাস যে বিতর্কিত, তা তিনি আমলে না নিয়ে সত্য হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। রাসুল (স.), জিবরাইল (আ.), ফাতিমা(রা.) প্রমুখের কথোপকথনরত অবস্থাগুলোও সংশয়পূর্ণ ও সঠিক ইতিহাস জানলে পড়তে কষ্ট হয় এমনকি কারবালার বিকৃত কাহিনী ও পার্শ্ব চরিত্রগুলোর অত্যধিক অতিরঞ্জন, ঐতিহাসিক তথ্যের ভুল বর্ণনা, কিছু ক্ষেত্রে ইসলাম অপসংস্কৃতি মান্য দেয় বলে উপস্থাপন, শব্দচয়নে অসচেতনতাসহ প্রধান বিষয়গুলো পাশ কাটিয়ে অপ্রধান বিষয়গুলোর বর্ণনা একেবারেই অগ্রাহ্য।
আসলে মনে হয় পুরো উপন্যাসটি গড়ে উঠেছে লোকমুখে প্রচারিত পুঁথি অনুসারে। কোনো সুনির্দিষ্ট ইতিহাস আশ্রয়ে এটি রচিত হয়নি। যদিও লেখক নিজে দাবি করেছেন বইটি পারস্য ও আরব্য গ্রন্থের সারাংশ নিয়ে বিচরিত করেছেন। তা উপকরণ যেখান থেকেই তিনি সংগ্রহ করুন, এই বইখানিতে তাঁর যে -কৃতিত্ব প্রকাশ পেয়েছে তা অনন্য সাধারণ।
পরিশেষে হয়ত প্রশ্ন করতেই পারেন "উপন্যাসে কী আসলেই ইতিহাসগত সব ভুল ছেটে রাখতে হয়?"
না, আমি এমন মনে করি না। ইতিহাস ও সাহিত্য দুটি ভিন্ন শাস্ত্র, ধারাবহকতা রক্ষার্থে এরকম ঐতিহাসিক উপন্যাসে বাস্তবের সঙ্গে কিছু কিছু কাল্পনিক বিষয় যুক্ত হতে পারে। ইতিহাসে থাকে বড় কিছু ঘটনা, উপন্যাসে পুরো জীবন, আবেগ আর আরো অনেক কিছু। সুতরাং উপন্যাসে কল্পনার আশ্রয় নিতে হবেই। কিন্তু আমার ধারণা যখন কেউ ইতিহাস থেকে উপাদান নিয়ে উপন্যাস লিখেন, তখন বাস্তব না লিখুন, বিকৃত কোনো ইতিহাস লেখা উচিৎ নয়। অন্তত ধর্মীয় দৃষ্টিকোণে নিরপেক্ষ থেকে হাসান-হুসাইন (রা.) বা অন্যান্য কোনো মুসলিম নবী, সাহাবী-এর মতো মহাব্যক্তিবর্গের বাস্তব চরিত্রগুলো ব্যবহার করে এমন কোনো কাহিনী রচনা করা কখোনোই উচিত নয় যেটা পাঠকদের প্রকৃত সত্য থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
- মূল্যয়ন
আমি মনে করি বাংলা সাহিত্যের অমর এক সৃষ্টি এই “বিষাদ সিন্ধু”। তবে পুস্তকটিকে একটি স্বার্থক উপন্যাস হিসেবে নেয়াই শ্রেয় কোনো ভাবেই ধর্মগ্রন্থ হিসেবে গন্য করা যায় না। অনেক আলেম ওলামাগনও তাই মনে করেন। যদিও ঐতিহাসিক উপন্যাস হিসেবে এর কাহিনীটি মন্দ নয়। তবে এমন একটি ধর্মীয় ঐতিহাসিক ঘটনার ওপর কলম ধরার জন্য বিশুদ্ধ উৎস হতে মূল ঘটনাগুলো নেওয়া আবশ্যক ছিল। কিন্তু সেটা না করে তিনি অধিকাংশ জাল, বানোয়াট ও অতিরঞ্জিত কাহিনী দিয়ে ভরপুর করে রেখেছেন। বিশুদ্ধ-অবিশুদ্ধ উৎস থেকে ঘটনার সারাংশ নিয়ে আর তার সাথে নিজের কলমের খোঁচা দিয়ে শিয়া মতবাদকে অনুসরণ করেই প্রণয়ন করেছেন। এই ব্যাপারে হয়তো লেখক কল্পনাপ্রসূত ভাবাবেগের আশ্রয় না নিলেও পারতেন।
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করলে এরকম আরো অসংখ্য প্রশ্নের উদয় হয়। তবুও সকল বাধা পেড়িয়ে গিয়ে প্রায় ১৪০ বছর পূর্বের উপন্যাস এখনও এর আবেদন ঠিক আগের মতই আছে। সুতরাং, স্পষ্টভাবে বোঝায় যাচ্ছে এই উপন্যাসের সাহিত্য কতই না সৌন্দর্য ও মাধূর্যপূর্ণ। অতএব, বাংলা সাহিত্যরসিক ও প্রেমিকদের অনুরোধ করবো অবশ্যই বইটি পড়েবেন কিন্তু কাহিনিকে প্রকৃত ভাববেন না। সুতরাং, আগ্রহী সকল পাঠকগনকে কিংবা যিনারা পড়ে ফেলেছেন তিনাদের অনুরোধ করব অনুগ্রহ করে পূর্নাঙ্গ প্রকৃত ইতিহাস জানতে অবশ্যই কারবালার খাঁটি দালিলিক ও নির্ভরযোগ্য ইতিহাস সংক্রান্ত বই সংগ্রহ করে পড়ুন। উদাহরণস্বরুপ- ফরিদ আল-বাহরাইনির “কারবালা: কল্পকথা বনাম বাস্তবতা” বইটি পড়তে পারেন। তবে বিশেষ করে আরবী বা উর্দু ভাষায় পাঠ করলেই শ্রেয়। যাইহোক, তার এই অসার্থক নিয়তি পূজার কথা ভুলে তাঁর সাহিত্যিক শক্তির স্বাভাবিক বিকাশ যাতে লাভ হয়েছে তারই অনুসরণ কর্তব্য ।