তসলিমা নাসরিনের মন্তব্য ও ইসলামের প্রকৃত বার্তা

সম্প্রতি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে তসলিমা নাসরিনের একটি বিতর্কিত টুইটার মন্তব্য, যেখানে তিনি বলেন—“ইসলামকে আর শান্তির ধর্ম বলা উচিত নয়।” এই মন্তব্যটি এসেছে ঢাকার গুলশান এলাকায় সংঘটিত ভয়াবহ জঙ্গি হামলার প্রেক্ষিতে, যেখানে কুড়ির অধিক নিরীহ মানুষ নির্মমভাবে নিহত হন। তসলিমার যুক্তি ছিল, এই হামলায় অংশগ্রহণকারীরা উচ্চশিক্ষিত এবং উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে আগত হওয়ায়, এটি ইসলাম ধর্মের সহিংস প্রবণতার প্রমাণ বহন করে।

কিন্তু প্রশ্ন হলো—একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা পক্ষপাতদুষ্ট বিশ্লেষণ কি সত্যের নিরপেক্ষ মানদণ্ড হতে পারে? কোনো ধর্মকে তার অনুসারীদের বিচ্ছিন্ন বা বিকৃত আচরণ দিয়ে বিচার করা কি ন্যায়সংগত?

সন্ত্রাসবাদ বনাম ধর্ম: একটি মৌলিক বিভাজন

ইসলাম’ শব্দের অর্থই হলো ‘শান্তি’ এবং ‘আত্মসমর্পণ’—আল্লাহর ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে প্রকৃত শান্তি অর্জনের আহ্বান। ইসলামের পথপ্রদর্শক, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবন আমাদের শিক্ষা দেয় ধৈর্য, ক্ষমাশীলতা এবং ন্যায়বিচারের মাধ্যমে প্রতিকূলতার জবাব দেওয়ার আদর্শ।

পবিত্র কুরআনে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে—
“যে কেউ কোনো নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে, সে যেন পুরো মানবজাতিকে হত্যা করল।”
(সূরা আল-মায়েদা: ৩২)

তাহলে কীভাবে এমন একটি ধর্ম, যার মৌলিক শিক্ষা হলো মানবিকতা ও সহমর্মিতা, তাকে সন্ত্রাসবাদের উৎস বলা যায়?

সন্ত্রাসবাদ একটি রাজনৈতিক, সামাজিক ও মানসিক সমস্যার ফল। ভুল মতাদর্শে প্রভাবিত হওয়া, বিকৃত ক্ষমতালিপ্সা, এবং বিভ্রান্ত চিন্তাভাবনা—এই সবই সন্ত্রাসবাদের জন্ম দেয়, ধর্ম নয়। ইসলামসহ বিশ্বের সব প্রধান ধর্মই শিক্ষা দেয় শান্তি, সহনশীলতা এবং মানবকল্যাণের।

কুরআন আরও ঘোষণা করে:
“ধর্মে কোনো প্রকার জবরদস্তি নেই।”
(সূরা আল-বাকারা: ২৫৬)

সুতরাং, ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা কখনোই নিরীহ মানুষের বিরুদ্ধে সহিংসতা নয়; বরং তা আত্মসংযম, ন্যায়পরায়ণতা এবং সকলের জন্য নিরাপত্তা ও সম্মান নিশ্চিত করার শিক্ষা দেয়। যারা ইসলামের নামে সন্ত্রাস করে, তারা ধর্মকে ব্যবহার করে শুধুমাত্র তাদের রাজনৈতিক বা মানসিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করে—এবং এর দায় কোনো ধর্মের নয়।

তসলিমার বক্তব্য: বিশ্লেষণ ও প্রাসঙ্গিকতা

তসলিমা নাসরিন নিজেকে নারীবাদী ও মানবাধিকারের পক্ষে অবস্থানকারী একজন লেখিকা হিসেবে উপস্থাপন করে থাকেন। কিন্তু তাঁর লেখনী ও মন্তব্যে প্রায়শই ধর্মবিশ্বাসীদের প্রতি উপহাস, বিদ্বেষ এবং প্ররোচনামূলক ভাষার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এ ধরণের বক্তব্য স্বাধীন মতপ্রকাশের সীমা অতিক্রম করে পরিকল্পিত অবমাননার পর্যায়ে পড়ে।

ঢাকার গুলশানে সংঘটিত ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর তিনি মন্তব্য করেন—“ইসলামকে আর শান্তির ধর্ম বলা উচিত নয়।” তাঁর যুক্তি ছিল, যেহেতু হামলাকারীরা উচ্চশিক্ষিত ও ধনী পরিবার থেকে এসেছে, সেহেতু সন্ত্রাসের মূল উৎস দারিদ্র্য বা অশিক্ষা নয়, বরং ইসলামের মাঝেই সহিংসতার প্রেরণা নিহিত।

এই বক্তব্য শুধু বিভ্রান্তিকর নয়, বরং গোটা একটি ধর্ম ও এর লক্ষ কোটি অনুসারীর প্রতি অবজ্ঞা ও ঘৃণার প্রকাশ। একজন লেখকের দায়িত্ব হওয়া উচিত হতো যুক্তি ও প্রেক্ষাপটসম্মত বিশ্লেষণ তুলে ধরা, ব্যক্তিগত বিদ্বেষ নয়। এমন মন্তব্য শুধু মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে না, বরং সামগ্রিকভাবে সমাজে বিভাজন, উত্তেজনা ও ঘৃণার বীজ বপন করে।

ইসলামের প্রকৃত বার্তা: শান্তি ও মানবকল্যাণের আহ্বান

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যার মূল ভিত্তি হলো শান্তি, ন্যায়, সহমর্মিতা ও মানবিকতা। ‘ইসলাম’ শব্দটির অর্থই হলো ‘শান্তি’ ও ‘আত্মসমর্পণ’—আল্লাহর ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে প্রকৃত শান্তির সন্ধান।

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন:
“যে ব্যক্তি কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে, সে যেন গোটা মানবজাতিকে হত্যা করল।”
(সূরা আল-মায়িদা, আয়াত ৩২)

রাসুলুল্লাহ ছিলেন মানবিকতা, ক্ষমাশীলতা ও সহনশীলতার জীবন্ত আদর্শ। তাঁর জীবনে প্রতিপক্ষকেও তিনি ন্যায়বিচার ও দয়ালুতা দিয়ে মোকাবিলা করেছেন। ইসলাম শিক্ষাদান করে প্রতিবেশীর হক আদায়, গরিব-দুঃখীদের প্রতি সহানুভূতি, এবং সর্বোপরি, অহিংস ও ন্যায়পরায়ণ জীবন যাপনের।

সুতরাং ইসলামকে সন্ত্রাসের উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা নিছক অজ্ঞতা, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার বা ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ছাড়া কিছু নয়। ইসলামের প্রকৃত বার্তা সর্বদা শান্তি, মানবকল্যাণ ও ন্যায়পরায়ণতার দিকে আহ্বান জানায়। আর সে আহ্বান শুধুই মুসলমানদের জন্য নয়—সমগ্র মানবজাতির জন্যই এক কল্যাণকর পথনির্দেশ।

ধর্মের অপব্যাখ্যা: একটি ভয়াবহ বিপথগামিতা

প্রতিটি ধর্মেই কিছু ব্যক্তি থাকেন যারা ভুল ব্যাখ্যার মাধ্যমে ধর্মের মূল শিক্ষা থেকে বিচ্যুত হন। ইসলামও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে এই বিপথগামী মানুষগুলো ইসলাম বা এর মূল নীতিমালার প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব করেন না। সন্ত্রাসীরা ইসলাম ধর্মের নাম ব্যবহার করলেও, ইসলাম তাদেরকে সে অনুমতি কখনও দেয় না।

যারা ইসলামের নাম ভাঙিয়ে সহিংসতা ও সন্ত্রাস ছড়ায়, তারা আল্লাহভীতি, ন্যায়বিচার ও মানবতার শিক্ষাকে পদদলিত করে শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্বার্থ, ক্ষমতার লালসা বা ব্যক্তিগত প্রতিশোধ চরিতার্থ করতে চায়। কোরআনের আয়াতকে খণ্ডিত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্যাখ্যা করে মানুষ হত্যা কোনোভাবেই ইসলামের শিক্ষা নয়, বরং এটি ইসলামের চরম অবমাননা।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন—
"যে ব্যক্তি আমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।"
(সহীহ বুখারী, হাদীস: ৬৫১৬)

সুতরাং যারা ইসলামের নামে সন্ত্রাস চালায়, তারা মুসলমানদের নয়, বরং ইসলামেরই শত্রু। ইসলামকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে যারা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে, তাদের কার্যকলাপ ইসলামের বিরুদ্ধে এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়।

উপসংহার: গঠনমূলক সমালোচনা হোক মুক্ত মতের প্রকৃত চর্চা

তসলিমা নাসরিনের মতো লেখকদের উচিত ধর্ম ও সমাজ নিয়ে মত প্রকাশের সময় ব্যক্তিগত ক্ষোভ নয়, বরং বস্তুনিষ্ঠ ও গঠনমূলক বিশ্লেষণকে প্রাধান্য দেওয়া। ইসলাম সম্পর্কে ভিন্নমত থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু সেটি যেন গবেষণালব্ধ যুক্তি ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে হয়—বিদ্বেষ বা প্ররোচনার নয়।

ইসলাম শুধু একটি ধর্ম নয়—এটি শান্তির এক সুসংবদ্ধ জীবনব্যবস্থা। এটি ইতিহাস, কোরআন, হাদীস এবং মুসলিমদের জীবনাচারে বারবার প্রমাণিত হয়েছে।

তাই সত্যকে তার প্রকৃত ভাষায় তুলে ধরা আমাদের দায়িত্ব। আর অপবাদ ও ভুল ধারণার মোকাবিলায় যুক্তিবাদী প্রতিক্রিয়া দেখানো শুধু দায়িত্ব নয়, বরং আজকের যুগে এটি এক প্রকার ইবাদত।

Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter