সুদানে গোপন গণহত্যা: সার্বজনীন মানবতা অবক্ষয়ের আরেকটি উদাহরণ
এক টিকটকার সুদান রাজধানীর বীভৎস দৃশ্য তুলে ধরে: রাজধানী শহরে এখন পরিবেশগত স্বাস্থ্যের অবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ এবং এর কারণ হচ্ছে সেখানে অনেক মৃত্যুদেহের স্তূপ। এখানে অনেক মৃতদেহ জমে আছে যা কুকুরের খাবার মাত্র। শহরটি বিপথগামী কুকুরের মিলনস্থলে পরিণত হয়েছে...। মৃতদেহের সংখ্যা এমন যে পাখিরা তাদের স্বাভাবিক অভিপ্রয়াণ পথ পরিবর্তন করে শুধু এখানে থামছে...।
রাজধানী খার্তুম থেকে সহিংসতা এবং নিপীড়ন দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছেছে। বিশেষ করে দারফোর অঞ্চলে গণহত্যার পরিস্থিতি স্পষ্ট। নারীদের যৌন নিপীড়ন দেশে একটি যুদ্ধের অস্ত্র হয়ে উঠেছে। স্বজনদের সামনে নারীদের গণধর্ষণ একটি অকল্পনীয় অপরাধ। অবশেষে অনেক মহিলা আত্মহত্যায় বাধ্য। গ্রামের পর গ্রামে হত্যা চলছে এমনকি নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীসহ অসহায় শ্রেণীও রেহাই পাচ্ছেনা।
আনুমানিক পরিসংখ্যান
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর)-এর আনুমানিক অনুসন্ধান অনুসারে: ২০২৩ সালের এপ্রিলে সুদানে যে সংঘাত শুরু হয়েছিল তার ফলে বছরের সবচেয়ে বড় বাস্তুচ্যুতি সংকট দেখা দেয়, ৬.১ মিলিয়ন (৬১ লক্ষ) সুদানী দেশের অভ্যন্তরে অন্যান্য অঞ্চলে পলায়ন করে এবং ১.৫ মিলিয়ন মানুষ বিদেশে নিরাপত্তার সন্ধান করে। বাস্তবে সংখ্যার হার আরও বেশি। এক স্থানীয় সংবাদ মাধ্যম (www.dabangasudan.org) অনুসারে: সুদানের চলমান যুদ্ধে ১১ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। অন্য এক প্রতিবেদনে মৃতের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়েছে।
কিছু প্রশ্ন
এতো পরিসংখ্যান দেখিয়ে বৈশিক স্তরে তথাকথিত সার্বজনীন শান্তির বাহক আন্তরাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলি কেন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছেনা? তাদের কোন শক্তি বাঁধা দিচ্ছে? এটা কি তাদের ঘোষিত নৈতিক নীতিমালার অবক্ষয় নয়? বিশেষ করে নরসংহারে নিযুক্ত বাহিনী রক্তক্ষয়ী দলগুলির কোনো মানবিক পরিচয় আছে কি? বোঝা যাচ্ছে বৈশ্বিক বিষয় নিয়ে আলোচনা ভুল কামরায় হচ্ছে।
৯১ শতাংশ মুসলিম অধ্যাসিত এই আফ্রিকার দেশে গোপন গণহত্যা কেন ঘটছে এবং এর পিছনে কার রক্তাক্ত হাত লুকিয়ে আছে? গাজার মতো পরিস্থিতি হয়েও কেন বিশ্ব সচেতন নয়? কেন মিডিয়া রিপোর্টিং এবং আলোচনা শুনা যায়না? এর কারণ কেবল কি সুদান একটি কম গুরুত্বপূর্ণ, অনুন্নত দেশ? না আফ্রিকান? না মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ? কোথাও কি যুদ্ধবিরতি অভিযান দেখা গেছে? এই নীরবতাকে কেন ধরে রাখা হচ্ছে? কোথায় সব তথাকথিত যুদ্ধবিরোধী, শান্তিবাদী এবং মানবতাবাদী পতাকাবাহীর দল?
অস্থির বর্তমান, অনিশ্চিত ভবিষ্যত
সুদানের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক ইতিহাস এবং গৃহযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রধান দলগুলি সম্পর্কে পূর্বের এক আলোচনায় সূচনাস্বরূপ তুলে ধরা হয়েছিল। নতুন ব্যাপার হল সুদানিজ আর্মড ফোর্স (এসএএফ) এবং আধাসামরিক রেপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)-এর মধ্যে যুদ্ধ গত এপ্রিলে দ্বিতীয় বছরে প্রবেশ করেছে। এর মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক লাভের উদ্দেশ্যে এই সংঘাতে জটিলতার জন্য কিছু বিদেশী শক্তি এবং প্রক্সির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে।
উপসাগরীয় দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে যে অভিযোগ উঠেছে তা কি সত্য, যা দেশটি প্রত্যাখ্যান করেছে? এবং হাজার বারের প্রশ্ন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে পশ্চিমা ষড়যন্ত্র ও অস্ত্রের কাজ কি, যা এই অঞ্চলটিকে একটি অ-নিরাময় ক্ষতের সাথে আহত করেছে? ভূ-রাজনীতি কীভাবে মানবতা এবং মানুষের জীবন রেখাকে অস্পষ্ট করে দেয়?
আর দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে এই সুদান সিংহাসন জয়ের যুদ্ধে দুই দলের মধ্যে চাপা পরে বহু নিরীহ বেসামরিক মানুষ নিহত হচ্ছে। যুদ্ধবিরতি ও শান্তি চুক্তির সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ; তাছাড়া এর জন্য উদ্যোক্তাদের মধ্যে আগ্রহের অভাব। এমনকি সাহায্য কর্মীরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। হাসপাতালের মৌলিক ওষুধের ঘাটতি। খাদ্য এবং যথাযথ স্বাস্থ্যবিধির অভাব অনাহারের মতো পরিস্থিতিতে হাজার হাজার মানুষকে ঠেলে দিয়েছে। যত সময় যাচ্ছে, পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। এসব নিয়ে ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মধ্যে সুদান। সমাধানের উপায় কেবলমাত্র সকল সংস্থার আন্তরিক উদ্যোগ এবং যুদ্ধে জড়িত সমগ্র দলের একত্রিত প্রচেষ্টা। বর্তমান সময়ে গাজা ও সুদান একই শিক্ষা দিয়েছে - পশ্চিমা অভিধানে সংজ্ঞিত সার্বজনীন নীতিমালাসমূহ অন্য বিশ্বের কাছে ভণ্ডামি এবং বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া আর কিছু নয়।