ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবেশ রক্ষার নীতি ও প্রকৃতি সংরক্ষণে ইসলামের ভূমিকা

“পরিবেশ সুরক্ষায় ইসলামের ভূমিকা”

ভূমিকা 

 পরিবেশ সংরক্ষণে ইসলাম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মানুষের সুস্থ, সুন্দর ও স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ করা জরুরি। প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গাছপালার ভূমিকা অপরিসীম। ইসলামে গাছ লাগানোর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। রাসুল (স) বলেন, "যদি নিশ্চিতভাবে জানো যে, কিয়ামত এসে গেছে আর তখন যদি হাতে একটি গাছের চারা থাকে যা রোপন করা যাবে, তবে সেই চারাটি লাগাবে" (বোখারি)। প্রকৃতিক পরিবেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যেমন- মাটি, পানি ও বায়ু দূষণ ইসলামে নিষেধ। যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা না ফেলে নির্দিষ্ট জায়গায় ডাস্টবিন স্থাপন করে সেখানে ফেলতে হবে এবং সময়মতো সেটি পরিষ্কার করতে হবে। রাসুল (স) বলেন, "পানির ঘাটে, রাস্তার মাঝে এবং বৃক্ষের ছায়ায় মলত্যাগ থেকে বিরত থাকবে” (আবু দাউদ)।

পরিবেশ সুরক্ষা, বা পরিবেশ সুরক্ষা বলতে প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা, দূষণ রোধ এবং পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণকে বোঝায় ।  ব্যক্তি, অ্যাডভোকেসি গ্রুপ এবং সরকার কর্তৃক পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। উদ্দেশ্যগুলির মধ্যে রয়েছে বিদ্যমান প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ এবং, যখন সম্ভব, ক্ষতি মেরামত এবং ক্ষতিকারক প্রবণতাগুলি বিপরীত করা। 

আল্লাহ তায়ালা মানবজাতির বসবাসের জন্য প্রাকৃতিক ভারসাম্যতা বজায় রেখে পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছেন। মানুষের প্রকৃতি ও সত্তাগত চাহিদার সাথে সঙ্গতি রেখেই পৃথিবীর প্রত্যেকটি জিনিসকে সৃষ্টি করা হয়েছে, যা প্রতিনিয়তই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মানুষের কল্যাণ এবং সেবায় ব্যবহূত হচ্ছে। পৃথিবীর সমস্ত সৃষ্টির উপাদানের নির্যাস দিয়ে মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তাই সৃষ্টিকুলের মাঝে যদি ভারসাম্যতা বজায় রাখতে হয় তাহলে মানুষকেই তার সঠিক পরিচর্যার দায়িত্ব নিতে হবে। কোরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী মানুষ এই পৃথিবীর উত্তরাধিকারী এবং দায়িত্বশীল। একজন দায়িত্বশীলের যেমন ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব থাকে তেমনই যাদের ওপর তাকে কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছে, তাদের সবার (প্রাণিকুলের) প্রতি কর্তব্যও রয়েছে। মানুষকে পৃথিবীর দায়িত্বশীল প্রাণী হিসেবে তৈরি করে এমন একটি ব্যবস্থা সৃষ্টি করা হয়েছে, যাতে মানুষ ও প্রাণীর মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকে। অর্থাৎ মানুষ প্রকৃতি ও প্রাণিকুলের সাথে বিবেক সম্মত আচরণ করবে তাহলেই পরিবেশের স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আর মহান আল্লাহ আকাশকে করেছেন সমুন্নত এবং স্থাপন করেছেন ভারসাম্য’ (সুরা রহমান-৭)। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘এই পৃথিবী সুন্দর ও সবুজ এবং নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে এখানে পাঠিয়েছেন প্রতিনিধিরুপে, যাতে তোমরা কেমন কাজ করো তা তিনি দেখতে পারেন’ (সহিহ্ মুসলিম)। মানুষের এই প্রতিনিধিমূলক দায়িত্বের সঙ্গে রয়েছে পরীক্ষাও। অর্থাৎ দুনিয়ায় যাবতীয় কাজকর্ম সুষ্ঠু, সঠিক ও প্রশংসনীয় উপায়ে হয়েছে কিনা তা বিচার দিবসে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে হিসাব করে প্রতিদান দেওয়া হবে।

মহান রবের অনুগ্রহশীল সৃষ্টিকে উপেক্ষা করে যেখানে-সেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলে রাখা, প্রয়োজন ব্যতীত গাছ কাটা, আবাদযোগ্য জমি নষ্ট করার ফলে জলবায়ু ও পরিবেশের ব্যাপক পরিবর্তনের ফলে মানুষ চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। অপরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্রীয় নিয়ম না মেনে গড়ে উঠছে বহু কলকারখানা যার দূষিত ধোঁয়া ও বিষাক্ত বর্জ্যগুলো প্রতিনিয়ত প্রকৃতির অমূল্য সম্পদ বায়ু ও নদী-নালাকে মানুষের ব্যবহারের অনুপযোগী করে তুলছে। প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ করার বৈধতা ইসলাম রাখেনি। আল্লাহ বলেন  ‘শান্তি প্রতিষ্ঠার পর তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না। তাঁকে ভয় ও আশার সহিত ডাকবে। নিশ্চয় আল্লাহর অনুগ্রহ সৎকর্মপরায়ণদের নিকটবর্তী’ (সুরা-৭ আরাফ, আয়াত ৫৬)। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনে কাসির (র.) বলেন, যেসব কর্মকাণ্ড পৃথিবীকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তা করতে আল্লাহ তায়ালা নিষেধ করেছেন। কেননা, যখন কাজকর্ম শান্ত পরিবেশে চলতে থাকে, তখন যদি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, তবে তা হবে বান্দাদের জন্য বেশি ক্ষতিকর। অর্থাৎ যদি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করো তাহলে জলে, স্থলে, শূন্যে তোমাদের অন্যায় কর্মকাণ্ডের ফলে বিপর্যয় নেমে আসবে।

ইসলামে পবিত্র পানি ছাড়া পবিত্রতা অর্জন সম্ভব নয়। এই হেকমতীয় অনিবার্যতা পানি দূষণ রোধ করে বিশুদ্ধ পানির নিশ্চয়তা বজায় রাখার পাশাপাশি সুরক্ষিত পরিবেশ গড়তে সহয়তা করে।আল্লাহ তায়ালাও কোরআনুল কারীমে বিশুদ্ধ পানির গুরুত্ব তুলে ধরে বলেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা যে পানি পান করো, তা সম্পর্কে ভেবে দেখেছ কি? তোমরা তা মেঘ থেকে নামিয়ে আনো, না আমি বর্ষণ করি? আমি চাইলে তা নোনা করে দিতে পারি। এরপরও কেন তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো না?’ (সুরা ওয়াকিয়াহ, আয়াত  ৬৮-৭০)

পৃথিবীতে কীভাবে বসবাস করলে এই প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্যতা বজায় থাকবে এবং মানবজীবনের বসবাস সুন্দর হবে, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট নীতিমালা দিয়েছে ইসলাম। কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘আমি পৃথিবীকে বিস্তৃত করেছি এবং এতে পর্বতমালা স্থাপন করেছি এবং পৃথিবীর প্রত্যেকটি বস্তুকে সুনির্দিষ্ট পরিমাপে উৎপন্ন করেছি। আর এতে তোমাদের জন্য জীবিকার ব্যবস্থাও রয়েছে এবং তোমরা যাদের অন্যদাতা নও তাদের জন্যও (অর্থাৎ প্রাণিকুলের জন্যও জীবিকার ব্যবস্থা করেছি)। প্রতিটি বস্তুর ভান্ডার রয়েছে আমার কাছে আর আমি তা সুষম পরিমাপে সরবরাহ করে থাকি। আমি বায়ুকে উর্বরকারীরূপে প্রেরণ করি অতঃপর আকাশ থেকে বৃষ্টিবর্ষণ করি এবং আমি তা তোমাদেরকে পান করাই। বস্তুত এসবের ভান্ডার তোমাদের কাছে নেই’ (সুরা হিজর-আয়াত ১৯-২২)।

নবীজীর (সা.) গাছ লাগানোর গুরুত্ব 

হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে—অর্থ  হজরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্ল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কোনো মুসলিম যদি কোনো শস্য চাষ করে বা কোনো গাছ রোপণ করে এবং তা থেকে যদি কোনো মানুষ, কোনো পাখি, কোনো পশু, কোনো হিংস্র প্রাণী বা অন্য কোনো প্রাণী যদি [ফল, পাতা, লতা, ডাল] খায়, তাহলে এর বিনিময়ে সে [জীবিত ও মৃত উভয় অবস্থায় ওই ফল, পাতা, লতা, ডাল ইত্যাদি] দান করার সাওয়াব পাবে। [সহিহ বুখারি শরিফসহ আটটি গ্রন্থ, বুখারির হাদিস নম্বর  ২১৯৫]

 হজরত জাবির রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্ল্লাম বলেছেন, কোনো মুসলিম যদি কোনো গাছ রোপণ করে, তাহলে তা থেকে যা কিছু খাওয়া হবে, তা তার জন্য সদকা বলে গণ্য হবে। তা থেকে যা চুরি হবে, তা-ও তার জন্য সদকা বলে গণ্য হবে। আর তা থেকে যদি কোনো পাখি বা কোনো হিংস্র প্রাণী খায়, তাহলে সেটাও তার জন্য সদকা বলে গণ্য হবে। আর যদি কেউ ওই গাছের কোনো ক্ষতি করে, তাহলে সেটাও তার জন্য সদকা বলে গণ্য হবে। [সহিহ মুসলিম শরিফ, হাদিস  ১৫৫২]

 হজরত আমর ইবনুল আসি রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্ল্লাম বলেছেন, কোনো মুসলিম যদি কোনো গাছ রোপণ করে বা কোনো শস্য চাষ করে এবং তা থেকে যদি কোনো মানুষ বা কোনো পাখি খায়, তাহলে এর বিনিময়ে সে [জীবিত ও মৃত উভয় অবস্থায় ওই ফল, পাতা, লতা, ডাল ইত্যাদি দান করার] সাওয়াব পাবে। [তবরানি আওসাত, হাদিস  ৮৯৮৭]

বর্তমান বিশ্বে পরিবেশ সংকট 

বর্তমান বিশ্বে পরিবেশ সমস্যা একটি বৈশ্বিক উদ্বেগে পরিণত হয়েছে। শিল্পায়ন, নগরায়ন, বন উজাড়, অতিরিক্ত ভোগবাদ এবং প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহারের ফলে পৃথিবীর পরিবেশ ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, সমুদ্র-পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, হিমবাহ গলনসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয় দিন দিন ঘন ঘন দেখা দিচ্ছে। মানুষের অনিয়ন্ত্রিত কর্মকাণ্ডে বায়ুদূষণ, জলদূষণ, মাটির উর্বরতা হ্রাস এবং জীববৈচিত্র্যের দ্রুত বিলুপ্তি পৃথিবীর ভারসাম্য নষ্ট করে দিচ্ছে। উন্নত ও উন্নয়নশীল সব দেশই পরিবেশ ধ্বংসের নেতিবাচক প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ পরিস্থিতি মানবতার ভবিষ্যৎকে যেমন হুমকির মুখে ফেলছে, তেমনি মানব আচরণের চরম দায়িত্বহীনতা ও নৈতিক অবক্ষয়ের প্রতিফলনও প্রকাশ করছে।

বর্তমানে পরিবেশ সংরক্ষণ নিয়ে বিশ্ববাসী উৎকণ্ঠিত। বিজ্ঞানীরা নিরন্তর গবেষণা করে যাচ্ছেন কীভাবে পরিবেশ সংরক্ষণ করে পৃথিবীকে ধ্বংসের কবল থেকে রক্ষা করা যায়। কিন্তু পরিবেশ সংরক্ষণে যে জিনিসটা সবচেয়ে বেশি দরকার তা হচ্ছে, সৃষ্টির প্রতি আমাদের সচেতনতাবোধ। কিন্তু আদৌ কি এ সচেতনতাবোধ আমাদের মাঝে তৈরি হচ্ছে?

সৃষ্টির সেরা জীব হয়েও আমরা পরিবেশ দূষণে মত্ত হয়ে আছি। নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন করছি, পাহাড় কেটে সমভূমি তৈরি করছি, যেখানে সেখানে কফ-থুতু যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা নিক্ষেপ করছি। আমরা পানি, বায়ু, মাটি দূষণ করছি, আর এসব দূষণের ফলে দূষিত হচ্ছে আমাদের পরিবেশ। অথচ এসব আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অত্যন্ত জরুরি। আল্লাহ আমাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসাবেই এসব নিয়ামত দান করেছেন। কিন্তু আমরা নিজেরাই নিজেদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার পথের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছি।

পরিবেশ দূষণের ফলে স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হয়। দূষিত পরিবেশ রোগব্যাধি সংক্রমণের প্রধান আবাসস্থল। তাই পরিবেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে সংরক্ষণ করার মাধ্যমে মারাত্মক ও সংক্রামক রোগ-ব্যাধি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। সুস্থতা, সৌন্দর্য, মননশীলতা, উৎকর্ষ ও সমৃদ্ধির কথা বলে ইসলাম। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ক্ষেত্রে ইসলামের অবস্থান অত্যন্ত স্পষ্ট। রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইমানের অঙ্গ।’ (মুসলিম  ২২৩)। অর্থাৎ মুসলিম হিসাবে, ইমানদার ব্যক্তি হিসাবে এবং একজন প্রকৃত মুমিন হিসাবে জাহির হতে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বিকল্প নেই।

প্রতিটি জীবের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন সুস্থ ও মনোরম পরিবেশ। অনুকূল পরিবেশ ছাড়া কোনো জীবের অস্তিত্ব রক্ষা করা সম্ভব নয়। তাই আমাদের উচিত ইসলামের আলোকে পরিবেশ সংরক্ষণ করা এবং এ বিষয়ে সোচ্চার হওয়া। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নির্ভরযোগ্য পরিবেশ সৃষ্টি করতে বৃক্ষ নিধন নয়, পরিবেশের পরিচর্যা করতে হবে। রাসূল (সা.) প্রকৃতি-পরিবেশ সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিশেষভাবে দিকনির্দেশনা আরোপ করেছেন।

পরিবেশের সংরক্ষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ইসলামে রয়েছে স্বতন্ত্র ও পূর্ণাঙ্গ নির্দেশনা; যা অনুসরণ করলে বিশ্বব্যাপী একটি সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব। পরিবেশ সংরক্ষণে রাষ্ট্র ও সমাজ ইসলামের আলোকে নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে সামর্থ্য হলে বৈশ্বিক পরিবেশ বিপর্যয়ের হার বহুলাংশে কমে আসবে ইনশাআল্লাহ।

ইসলামে যেমন ইবাদতের তাৎপর্য রয়েছে, তেমনি রয়েছে পরিবেশের গুরুত্ব  

কোন পরিবেশে বসবাস করলে মানুষের সুবিধা হবে বা মানুষ সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে পারবে, ইসলাম তা সুনিশ্চিত করেছে। আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে, যেমন—গাছপালা, বাড়িঘর, মাটি, পানি, বায়ু, জীবজন্তু, পশুপাখি, রাস্তাঘাট, নদীনালা, পাহাড়-পর্বত, যানবাহন, কলকারখানা ইত্যাদি নিয়েই পরিবেশ। এগুলো সবই মহান আল্লাহর শ্রেষ্ঠ নেয়ামত। এরশাদ হচ্ছে—‘আমি পৃথিবীকে বিস্তৃত করেছি এবং এতে পর্বতমালা সৃষ্টি করেছি। আমি পৃথিবীতে প্রতিটি বস্তু সুপরিমিতভাবে সৃষ্টি করেছি। এতে তোমাদের জন্য জীবিকার ব্যবস্থা করেছি। আর তোমরা যাদের জীবিকাদাতা নও, তাদের জন্যও। প্রতিটি বস্তু ভান্ডার আমার কাছে রয়েছে। আমি তা প্রয়োজনীয় পরিমাণে সরবরাহ করে থাকি। আমি বৃষ্টিগর্ভ বায়ু প্রেরণ করি। এরপর আকাশ থেকে মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষণ করি। তা তোমাদের পান করতে দিই। এর ভান্ডার তোমাদের কাছে নেই।’ (সুরা হিজর  ১৯-২২)

পরিবেশ ও প্রকৃতির বিপর্যয় রোধে বৃক্ষকর্তনের পরিবর্তে বৃক্ষরোপণ ও বনায়ন জরুরি। ইসলাম বৃক্ষরোপণে বিপুলভাবে উৎসাহিত করে। যদি জানা যায় যে আগামীকাল কেয়ামত, তথাপিও আজ যদি কারও হাতে কোনো বীজ বা চারাগাছ থাকে, তবে তা বপন করে দিতে রাসুলুল্লাহ (সা.) নির্দেশ দিয়েছেন। অথচ কতিপয় বনখেকো মানুষ যে কী পরিমাণে বনভূমি উজাড় করেছেন, তার হিসাব করলে উদ্বিগ্ন হতে হয়। এমনকি এসব কাজে কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তিদেরও জড়িত থাকার খবর শোনা যায়। অথচ অনর্থক গাছ কাটা ও বন উজাড় করাকে ইসলামে শরিয়ত গর্হিত কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। রাস্তাঘাটে বা মাঠে-ময়দানে যেসব বৃক্ষমালা ছায়া দেয়, যেখানে মানুষ বা পশু বিশ্রাম নেয়, এমন গাছকে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কেটে ফেলা অত্যন্ত জঘন্য অপকর্ম। যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে তার কোনো ফায়দা ছাড়া গাছ নিধন করেছে, যার নিচে পথিক ও পশু আশ্রয় নেয়, তার শাস্তি সম্পর্কে নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যে অকারণে একটি কুলগাছও কেটেছে, তাকে আল্লাহ মাথা নিচু করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।’ (আবু দাউদ)

প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মানুষ গাছ থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে এবং সেই অক্সিজেনে বেঁচে থাকে। তেমনি প্রশ্বাসের সঙ্গে মানুষ যে কার্বন ডাইঅক্সাইড ত্যাগ করে তা গ্রহণ করে গাছ বেঁচে থাকে। এজন্য পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গাছ অপরিহার্য। গাছ আল্লাহতায়ালার গুণগান করে। তার ধ্যানে সর্বদা মত্ত থাকে, সিজদা করে। পরিপূর্ণভাবে প্রভুর হুকুম মেনে চলে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তুমি কি দেখো না, আল্লাহকে সিজদা করে যা কিছু আকাশমণ্ডলীতে ও পৃথিবীতে, সূর্য, চন্দ্র নক্ষত্রমণ্ডলী, পর্বতরাজি ও বৃক্ষলতা, জীবজন্তু ও মানুষের মধ্যে অনেকে।’ ইসলামের দৃষ্টিতে গাছ লাগানোকে ইবাদত হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। হজরত আনাস (রা‍.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যদি কোনো মুসলিম বৃক্ষ রোপণ করে অথবা ক্ষেতে ফসল বোনে, মানুষ কিংবা চতুষ্পদ প্রাণী খায়, তাহলে তা তার জন্য সদকা হিসেবে গণ্য হবে।’ (বোখারি  ২৩২০)। কোনো ব্যক্তির লালন-পালনে বেড়ে ওঠা বৃক্ষ থেকে কেউ উপকৃত হলে তার সওয়াব ওই ব্যক্তির আমলনামায় লেখা হবে। লোকটি মারা গেলেও এর সওয়াব সে পাবে। নবীজি (সা.) বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি বৃক্ষরোপণ করে তা ফলদার হওয়া পর্যন্ত তার পরিচর্যা ও সংরক্ষণে ধৈর্য ধারণ করে, তার প্রতিটি ফল যা নষ্ট হয়, তার বিনিময়ে আল্লাহ পাক তাকে সদকার নেকি দেবেন।’ (মুসনদে আহমদ  ১৬৭০২)।

আসলে পরিবেশ নির্দিষ্ট কোনো দেশ বা জাতির সম্পদ নয়, পরিবেশ সবার সম্পদ এবং এর বিপর্যয় নির্দিষ্ট কোনো এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং মানবজাতির বিপর্যয় হিসেবে গণ্য হয়। তাই পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার। তা না হলে মানুষকে হাশরের ময়দানে আল্লাহর দরবারে আসামির কাঠগড়ায় জবাবদিহির জন্য দাঁড়াতে হবে। আগামী প্রজন্মের জন্য দূষণমুক্ত পরিবেশ গঠনে বিশ্বব্যাপী পরিবেশের প্রতি যত্নশীল হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প, দাবদাহ ও তাপপ্রবাহ থেকে বাঁচতে হলে প্রচুর পরিমাণে বৃক্ষরোপণ ও সবুজ বনায়ন করা প্রয়োজন। তাই দেশের মানুষের উচিত যে কাজে জাতির ক্ষতি হয়, দেশের সর্বনাশ হয়, তা থেকে অবশ্যই বিরত থাকা। মানুষের অন্যায় অপকর্ম থেকে ফিরে এসে পৃথিবীকে বিপদমুক্ত ও নিরাপদ পরিবেশ বজায় রাখা একান্ত প্রয়োজন।

উপসংহার  

পরিবেশ রক্ষা একটি নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি, যা ইসলামিক শিক্ষা ও আচরণের কেন্দ্রবিন্দু। কুরআন ও হাদীসের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা পরিবেশ ও প্রকৃতির প্রতি মানুষের দায়িত্বশীল আচরণ এবং তা রক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। ইসলামে পৃথিবীকে আল্লাহর সৃষ্টি হিসেবে সম্মানিত করা হয়েছে এবং এটি মানুষের ব্যবহারের জন্য নয়, বরং আমানত হিসেবে অর্পিত। ইসলামের দৃষ্টিতে পরিবেশকে ধ্বংস করা বা এতে অবিচার করা অত্যন্ত গর্হিত কাজ, কারণ প্রকৃতি মানুষের জন্য এক মহান আশীর্বাদ।

যতটা সম্ভব, ইসলাম পরিবেশে ভারসাম্য বজায় রাখতে, জল, বায়ু, বন এবং জীবজগতের সুরক্ষা করতে নির্দেশ দিয়েছে। এভাবে ইসলামের পরিবেশ-নীতি শুধু মানব সমাজের জন্যই নয়, বরং পুরো পৃথিবীর সুরক্ষার জন্যও প্রযোজ্য। পরিবেশগত সংকটের প্রেক্ষিতে মুসলিম সমাজের কর্তব্য হলো—কুরআনের নির্দেশনা অনুসরণ করে প্রকৃতি রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা পালন করা। পৃথিবীর বিপদ থেকে রক্ষা পেতে এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখতে ইসলামের পরিবেশবাদী নীতির চর্চা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।



Related Posts

Leave A Comment

Voting Poll

Get Newsletter